রান্নাঘরের রঙিন পাত্র হৃদরোগের কারণ নয়তো!

আমাদের নিত্যব্যবহার্য অন্যতম দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হল প্লাস্টিক। আমাদের ক্ষতি করছে না তো? মন বলছে না না। কিন্তু গবেষণা বলছে অন্য কথা, এই প্লাস্টিক আমাদের হৃদরোগের অন্যতম কারণ। আজ তারই আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই স্টিলের পাত্র ছেড়ে ভরসা করছে নমনীয়, হালকা, সুন্দর রঙের, দামে কম কিন্ত মানে ভাল প্লাস্টিকের বিভিন্ন পাত্রের ওপর। রান্না করা খাবার রাখতে বা ঠান্ডা খাবার গরম করতে প্লাস্টিকের পাত্রের জুড়ি নেই। কিন্তু গবেষণা বলছে, এই রঙিন পাত্রেই লুকিয়ে আমাদের হৃদরোগের কারণ।
বর্তমানে সামগ্রিক প্লাস্টিক উৎপাদন প্রতি বছর প্রায় ২০০০ লক্ষ টনেরও বেশি এবং বিশ্বব্যাপী এর বাজার ৫০০ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি। তবে, নতুন উদীয়মান বাজারের সঙ্গে চিকিৎসা যন্ত্রের সাধারণ ক্ষেত্রেও প্লাস্টিকের ব্যবহারের বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের যান্ত্রিক, তাপীয়, বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য নতুন প্রয়োগে কাজে লাগছে। যদিও চিকিৎসাখাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও তা যথেষ্ট পরিমাণে কম প্রায় ৩০ লক্ষ ডলারের মতো। আসলে একটি চিকিৎসাযন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতায় প্লাস্টিকের প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রায়শই প্লাস্টিকের নির্বাচন যন্ত্রের কার্যকারিতা এবং রোগের চিকিৎসা নির্ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন-দুর্ঘটনার কবলে তেজস্বীর কনভয়, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আরজেডির

প্লাস্টিক ও হৃদরোগ
আমাদের রান্নাঘরের প্লাস্টিকের পাত্র অথবা আমাদের খাবারের চারপাশের চকচকে মোড়ক খাবার ভাল রাখতে বা খাবার সঙ্গে করে কোথাও নিয়ে যেতে অবিশ্বাস্য সুবিধা প্রদান করে ঠিকই কিন্তু একটি গবেষণা অনুসারে জানা যায় এগুলি আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে বহুগুণ। ল্যানসেট ই-বায়োমেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে থ্যালেটস নামক একপ্রকারের রাসায়নিক পদার্থ সাধারণত প্লাস্টিকগুলিকে আরও নমনীয় এবং টেকসই করার জন্য প্লাস্টিকে যোগ করা হয়। এই থ্যালেট হৃদরোগজনিত মৃত্যুর সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্ত, আর এই হৃদরোগজনিত মৃত্যুতে ভারত বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। প্যাকেটজাত খাবারের বেশি ব্যবহার এবং প্লাস্টিকের পাত্র ঘন ঘন ব্যবহারের কারণে শহুরে বাসিন্দারা বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হন। মেকআপ, সুগন্ধী এবং লোশনের মতো থ্যালেটযুক্ত পণ্য বেশি ব্যবহারের কারণে নারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন বলে মনে করা হচ্ছে। গবেষকরা বিভিন্ন মহাদেশের স্বাস্থ্য তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে di(2-ethylhexyl) phthalates (DEHP) নামক রাসায়নিকযুক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে ভারতে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি ১ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু (১,০৩,৫৮৭) ঘটেছে। যা নাকি চিন (৬০,৯৩৭ মৃত্যু) এবং ইন্দোনেশিয়া (১৯,৭৬১ মৃত্যু)-কেও ছাড়িয়ে গেছে। অধিকন্তু, ভারতে থ্যালেট-সম্পর্কিত হৃদরোগজনিত মৃত্যুর কারণে জীবনকাল হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৯ লক্ষ বছর, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্যাকেজিং, প্লাস্টিকের পাত্রে আসা মেকআপ আইটেম, লিপস্টিক হোক বা যে-কোনও নরম ক্রিম, প্রতিটি পাত্রেই থ্যালেট থাকে। ডিটারজেন্ট পাউডারেও থ্যালেট ব্যবহার করা হয়। এমনকী নেইলপলিশ এবং পারফিউমেও থ্যালেট ব্যবহার করা হয়। Phthalates শ্যাম্পু, সাবান, চুলের স্প্রে, সুগন্ধী, লোশন এবং চুলে দেওয়ার জেলে-ও ব্যবহৃত হয়। শরীরের যত্ন নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত ব্যক্তিগত পণ্য এবং চিকিৎসা সরঞ্জামগুলিতে লুকোনো এই বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রতিদিনের সংস্পর্শে আসার কারণে জীবনে বাঁচার বয়সে কোপ পড়ছে হ্রাস পাচ্ছে জীবনকাল। এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোন হেলথের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে প্লাস্টিকের এক্সপোজার হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে অতিরিক্ত মাত্রায় সক্রিয় হয়ে প্রদাহ তৈরি করে, যা সময়ের সাথে সাথে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষকরা অনুমান করেছেন যে DEHP-এর সংস্পর্শে ৩,৫৬,২৩৮ জন মারা গেছেন, যা ২০১৮ সালে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে হৃদরোগের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ১৩ শতাংশেরও বেশি। গবেষণার প্রধান লেখক সারা হাইম্যান, এনওয়াইইউ গ্রসম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের সহযোগী বিজ্ঞানী, তাঁর এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘বিশ্ব জুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ থ্যালেটের সাথে যুক্ত, আমাদের অনুসন্ধান থেকে পাওয়া প্রমাণগুলির এক বিশাল অংশ একটি নির্দিষ্ট দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে যে এই রাসায়নিকগুলি মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি বিরাট বিপদ উপস্থাপন করতে চলেছে।’’ প্লাস্টিককে নরম এবং নমনীয় করতে Phthalates ব্যবহার করা হয়। এগুলি প্লাস্টিকের খাবারের পাত্র এবং মোড়ক, প্রক্রিয়াজাত এবং প্যাকেজ করা খাবার, সাবান, শ্যাম্পু, প্রসাধনী, সুগন্ধী, মেডিক্যাল টিউব, ইন্ট্রা ভেনাস ব্যাগ এবং রক্ত সংরক্ষণ ইউনিটে পাওয়া যায়। থ্যালেটস খাদ্য থেকে বেরিয়ে খাদ্য, ত্বকের সংস্পর্শ বা ধুলোর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। একবার রক্তে প্রবেশ করলে, তারা হরমোনের ক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, এরা রেনিন-অ্যাঞ্জিওটেনসিন- অ্যাল্ডোস্টেরন হরমোনের ক্রিয়াকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে রক্তনালিতে চর্বি জমে— যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। থ্যালেট প্রায় সবধরনের হৃদরোগ যেমন— মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস, কার্ডিয়াক অ্যারিদ্মিয়া-সহ ডায়াবেটিস-এরও ঝুঁকি বাড়ায়। এই তথ্যগুলির অনুসন্ধানের জন্য সাধারণত গবেষকের দল ২০০টি দেশ এবং অঞ্চল জুড়ে DEHP-এর সংস্পর্শ অনুমান করার জন্য কয়েক ডজন জনসংখ্যা জরিপ করেছে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত তথ্য ব্যবহার করেছে।
তথ্যের মধ্যে প্রস্রাবের নমুনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, কারণ সেখান থেকে প্লাস্টিক ব্যবহারকারী একটি মানুষের শরীরে কতটা থ্যালেট প্রবেশ করেছে বা করে চলেছে তার একটি অনুমান পাওয়া যাবে। মৃত্যুর তথ্য অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন থেকে প্রাপ্ত করা হয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের প্রবণতা শনাক্ত করার জন্য বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা তথ্য সংগ্রহ করে।

আরও পড়ুন-কংগ্রেসে পেয়েছি অপমান সম্মান দিতে জানে তৃণমূল

কেন ভারত সবার চর্চায়
গবেষণায় ভারতকে থ্যালেট-সম্পর্কিত মৃত্যু এবং হৃদরোগের জন্য বিশ্বব্যাপী হটস্পট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। চিনের তুলনায় ভারতে বয়স্ক জনসংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও, ভারতে DEHP-সম্পর্কিত মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। কারণগুলির মধ্যে সম্ভবত খাদ্য, প্রসাধনী এবং চিকিৎসা পণ্যগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের উচ্চ প্রয়োগ এবং প্যাকেটজাত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত। গবেষণায় বলা হয়েছে যে এর ফলাফল বিশেষভাবে উচ্চস্তরের শিল্পায়ন এবং প্লাস্টিক ব্যবহারকারী দেশগুলির জন্য প্রাসঙ্গিক।
এই বিশ্লেষণটি প্লাস্টিক উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রণের বিশ্বব্যাপী প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণও বটে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে দ্রুত বর্ধনশীল প্লাস্টিক শিল্প রয়েছে এবং প্লাস্টিক বর্জ্য এবং ভোগ্যপণ্য তৈরিতে পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি)-এর মতো সাধারণভাবে DEHP-সমেত প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে থ্যালেটের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি রয়েছে। এই সমস্ত কিছু প্লাস্টিক সামগ্রীর নিরাপত্তা মানদণ্ডের দুর্বল প্রয়োগ এবং জনসাধারণ ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মধ্যে সীমিত সচেতনতার দিকেও ইঙ্গিত করে। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারত সর্বোচ্চ পরিমাণে প্লাস্টিক নির্গমণ করেছে, যা প্রতি বছর মোট ৯৩ লক্ষ মেট্রিক টন। বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক প্লাস্টিক নির্গমণের অঞ্চলগুলিকে দক্ষিণ এশিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও এ-সমস্ত কথা মাথায় রেখেই ভারত তার খাদ্য প্যাকেজিং-এর খাতে DEHP বিধিনিষেধ অন্তর্ভুক্ত করেছে, তবে গবেষণায় বলা হয়েছে এই নিয়মগুলি খুবই সাম্প্রতিক।

আরও পড়ুন-নীরজের নয়া চ্যালেঞ্জ প্যারিস ডায়মন্ড লিগ

পরিসংখ্যান বলছে
ভারতের বয়স্ক জনসংখ্যা (৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি) দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। DEHP-এর সংস্পর্শে আসার কারণে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ১,০৩,৫৮৭ জন মারা গেছেন, আর এই অকালমৃত্যুর ফলে ২,৯০৪,৩৮৯ বছরের জীবন নষ্ট হয়েছে। চিনে ৬০,৯৩৭ জন মারা গেছে এবং ১৯ লক্ষ বছর জীবনকাল কমে গেছে; ইন্দোনেশিয়ায় ১৯,৭৬১ জন মারা গেছে এবং ৫৮৭,০৭৩ বছর জীবনকালের ঘাটতি পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল, এই দেশগুলিতে রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার হার বেশি, সম্ভবত কারণ তারা প্লাস্টিক উৎপাদনে ক্রমবর্ধমান গতিতে চলছে কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় এই উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের বিধিনিষেধ কম রয়েছে।
পুনশ্চ
এত তথ্য এত বিশ্লেষণ এত ঝুঁকি কি আমাদের প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে? আমরা কি একেবারে কাল থেকেই আমাদের ব্যবহার্য সমস্ত প্লাস্টিকের পাত্র রান্নাঘরের তাক থেকে সরিয়ে ফেলতে পারব? বিষয় হল– রোজ একটু একটু করে আমাদের প্লাস্টিকের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। একই প্লাস্টিকের পাত্র বারংবার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার রেখে তাকে গরম করা যাবে না। জলের জন্য প্লাস্টিকের বোতল এড়িয়ে চলাই ভাল। এই ছোট ছোট বিষয়গুলি যদি আমরা প্রত্যেকদিন একটু একটু করে মেনে চলতে পারি তাহলে হয়তো আমরা এই মৃত্যুমিছিল একটু হলেও আটকাতে পারব আর তা না হলে যে হারে জীবনকাল কমতে চলেছে এবার এই হৃদরোগের বয়সও আর ৫৫ থেকে ৬৪-র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সেটি নেমে আসবে ৪৫ বা তারও নিচে, যার শিকার হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাই তাদের বাঁচাতে আমরা আজ থেকেই এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপগুলি নিতে থাকি সবাই মিলে একটু একটু করে, ক্ষতি কী তাতে?

Latest article