বুকের কাঁটা

কী গো! তোমার হাতে তো আজ মিনিট দশেক সময় আছে, এখনও ন’টা বাজেনি। বড়টাকে একটু তেল মাখিয়ে মাথায় দু’মগ জল ঢেলে দাও না।  

Must read

সুকুমার রুজ
কী গো! তোমার হাতে তো আজ মিনিট দশেক সময় আছে, এখনও ন’টা বাজেনি। বড়টাকে একটু তেল মাখিয়ে মাথায় দু’মগ জল ঢেলে দাও না।
নীরার এই কথাগুলো শুনে শুভ শুধু হেডলাইনগুলোতে চোখ বুলিয়ে খবর-কাগজটা দোতলার বাড়িওয়ালাকে ফেরত দিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবে, টিউশনিতে ছেলেগুলোকে ন্যারেশনটা কালকে বোঝাবে বলে আশ্বাস দিয়ে আজ পনেরো মিনিট আগেই চলে এল। হাত-পায়ের নখগুলো কাটবে ভেবেছিল, তা আর বোধহয় হবে না।
খোল, খোল নন্দু, জামাটা তাড়াতাড়ি খুলে ফেল। আমার আবার অফিসে লেট না হয়ে যায়। তোর স্কুল বসে ক’টায়?
নন্দুর মিনমিনে গলার উত্তর চাপা পড়ে যায় নীরার কথাতে— কিচ্ছু লেট হবে না। দেখছ আমি একদিকে রান্না আর একদিকে ছোটটাকে নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি।
শুভ বড়ছেলের খালি গা দেখে বিমূঢ় হয়ে যায়। ছেলেটা রোগা, এ কথা মাঝেসাঝে আলোচনা হয়। কিন্তু ও যে এত হাড়-জিরজিরে এটা ওর চোখে পড়েনি। খালি গা অবস্থায় ছেলেটাকে দেখে আর কোথায়! সাতসকালে উঠে সাইকেল হাঁকিয়ে বেরোয় টিউশনিতে। ফিরে এসে কোনওরকমে গা-মাথা ভিজিয়ে, নাকে-মুখে গুঁজে অফিস-ফেরতা দুটো টিউশনি। যখন ঘরে ফেরে, ছেলেদুটো তখন ঘুমের দেশে। তেল মাখাতে গিয়ে ও নন্দুর বুকের পাঁজরে জোরে চাপ দিতে ভয় পায়। কোনও রোগ নেই ছেলেটার তবুও…। আসলে ছেলেটার এখন বাড়-বাড়ন্তর সময়। এখন একটু দুধটা, ঘি-টা, ভাল খাবারদাবার…। ক্লাস ফোরে উঠল। পড়ার চাপও বেড়েছে।
শুভর মনে অব্যক্ত যন্ত্রণা। এমন বাবা সে, ছেলে দুটোকে ভাল ভাল খাবারও ঠিকমতো জোটাতে পারছে না। কাল অফিসের পিয়ন হরিদাস গল্প করছিল, ফি-রোববার মাংস আনে, তা ছাড়া হপ্তায় তিনদিন মাছ, একদিন ডিম। তখন শুভ, যে কিনা অফিসের বড়বাবু; মনে করতে চেষ্টা করছিল শেষ কবে মাংস কিনে এনেছিল। ভেবেছিল, কী করেই বা কিনবে! ঘরভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, স্কুলের মাইনে, ছোটটার বেবিফুড— এসবের পর হাতে থাকে আর কত টাকা! কোম্পানিটার ‘বড়বাবু’ নামক গলাভরা পদে চাকরি করলেও মাইনে তো সেই…। শ্রম ও মেধার মূল্য তো এখন ডলার সাপেক্ষে টাকার মূল্যের অনুপাতে কমছে।
[দুই]
শুভ ভিড় বাসে গৌরাঙ্গের মতো দু’হাত তুলে রড ধরে দাঁড়িয়ে। মনের মাঝে বড় ছেলেটার হাড়-জিরজিরে শরীর। আচ্ছা, অফিসের মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি বলে-কয়ে এক ফাইল টনিক ম্যানেজ করা যায়। না, মিথ্যে বলে সে টনিক নিতে পারবে না। অফিস তো তার নিজের জন্য দেয়। ছেলের জন্য দেবে কেন? ধুস! ওসব টনিক-ফনিকে কিস্যু হয় না। আসল হচ্ছে খাদ্য। ভাল প্রোটিনযুক্ত খাবার। সকালে কাগজে চোখ পড়ল, চিকেনের দাম কমছে। বিদেশ থেকে মুরগির ঠ্যাং আমদানি হচ্ছে বাজারে। সস্তা। ওতে প্রোটিনের ভাগ কেমন থাকবে কে জানে। দেশি জিনিসই নাকি ভাল। দেশি মুরগির ডিম, দেশি টমেটো। আজকাল তো সব হাইব্রিড। আপেলের মতো টমেটো, টক নেই। লম্বা লম্বা ঝিঙে-ভেন্ডি; স্বাদ নেই। কাল অফিস যাওয়ার পথে লাল লাল আপেলের গায়ে গোল গোল স্টিকার মারা আছে দেখে অবাক হয়েছিল। ফলওয়ালাকে শুধিয়ে জেনেছিল, বিদেশি আপেল। আড়াইশো টাকা কিলো। মুরগির ঠ্যাংয়েও কি স্টিকার মারা থাকবে? ফেরার পথে একবার খোঁজ নেবে। যদি দাম একটু কম হয়। ছেলেটাকে অনেকদিন মাংস খাওয়ানো হয়নি।
বাসটা ডাইনে মোড় নিয়ে থামে। সামনের সিট খালি হয়। শুভ খেয়াল করেনি। ‘দাদা বসবেন না’ শুনে সম্বিত ফেরে। ধপ করে বসে ছোবড়া-ভরা শক্ত সিটটায়। মনের মধ্যে নন্দুর পাঁজরা। মাইনেটা যদি একটু বাড়ত! গ্রামের বাড়িতে উপার্জনহীন বুড়ো বাবা-মা। ওষুধপত্তর। নিজের হাতখরচ। কোনটা বাদ দেবে!
নন্দুর স্কুলের মাইনেটাও এ-বছর বাড়ল। বেসরকারি স্কুল। সরকারি স্কুলে ভরতি করা অনেক ঝকমারি! অ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়ার পর ক্যাপিটেশন ফি-এর মোড়কে ডোনেশন কয়েক হাজার টাকা। তারপরেও ইংরেজিতে কাঁচা। তেইশ বছর ইংরেজি প্রাথমিক স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার পর জনগণ ও রাজনৈতিক দলের চাপে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেও এখনও জং ছাড়েনি। বাধ্য হয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। মাসে সাতশো টাকা। তা ছাড়া হ্যান ফি-ত্যান ফি লেগেই আছে। শিক্ষা আর সাধারণ মানুষের জন্য নয়। আবার শিক্ষা না দিলেও নয়। কোনটাকে বাদ দেবে সে। সিগারেট ছেড়ে খৈনি ধরেছে। নীরার কোনও চাহিদা নেই তাই বাঁচোয়া। বহুদিন পর কাল নীরা একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘‘ময়লা ফেলার জন্য একটা প্লাস্টিকের বাস্কেট কিনে দেবে? কর্পোরেশন থেকে দেওয়া প্লাস্টিক বালতিটা ভেঙে গেছে। ওটা দিয়ে আর কাজ চলছে না।’’ ও বলেছিল, ‘‘এ মাসটা ওতেই চালিয়ে নাও। সামনের মাসে কর্পোরেশন থেকে আবার দেবে।’’
নীরা অস্ফুটে বলেছিল, আসলে…। আর কিছু বলেনি। পরের কথাগুলো শুভ অনুমান করেছিল, আসলে পাশের বাড়ির বউ কিংবা কাজের মেয়েটা সুদৃশ্য প্লাস্টিকের বাস্কেট উপুড় করে ময়লার গাড়িতে। নীরা ওই ভাঙা বালতিটা ওদের সামনে নিয়ে যেতে সংকোচ বোধ করে তাই…।
বাদুড়ঝোলা বাসটা সিগন্যালে থামে। শুভর চোখ জানলার বাইরে। ফুটপাথে। চমকে ওঠে ও। ফুটপাথে নন্দু দাঁড়িয়ে। খালি গায়ে, খালি পায়ে। বাচ্চাটা মুখ ফেরায়। না, নন্দু নয়। ওরই মতো রোগা। হাড়-পাঁজরা বের হওয়া। ওই তো আরও একটা কঙ্কালসার, সিকনি ঝরা নাকে, রুগ্ণ মহিলার ছেঁড়া আঁচল ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। মহিলা বাচ্চাটার পিঠে একটা চাপড় মারে। বাচ্চাটা কঁকিয়ে ওঠে। মহিলা ফুটপাথে থাপন গেড়ে বসে বুক উদোম করে। চিমসে বুকের বোঁটা গুঁজে দেয় কোলের রোঁয়াহীন মুরগির মতো দেখতে বাচ্চাটার মুখে।
শুভ ভাবে, সদ্য এসেছে হয়তো বর্ডার পেরিয়ে গুমো-হাবড়া লোকাল ধরে। এখন বাংলাদেশে যা চলছে!
[তিন]
শুভ সময়মতো অফিসে পৌঁছয়। ঘরে ঢুকে ফ্যান খুলে চেয়ারে বসে। পিয়ন হরিদাস কাচের গ্লাসে একগ্লাস জল টেবিলের উপর দিয়ে যায়। শব্দ হয় ঠকাস করে। শব্দটা শুভর মনে নাড়া দেয়। গ্লাসের শব্দটা কি তাকে অবজ্ঞার লক্ষণ! নাকি বিরক্তি! কিংবা ও কি অন্যমনস্ক ছিল! তাই ওকে জানান দিতে শব্দ করে গ্লাসটা রেখেছে হরিদাস। ঔদ্ধত্যও হতে পারে। পিয়ন হয়ে বড়বাবুর চেয়েও উন্নত জীবন যাপন করছে সে, তারই বহিঃপ্রকাশ হয়তো। পরক্ষণেই ভাবে, কী আবোল-তাবোল ভাবছে! সামান্য একটা গ্লাসের শব্দে…। এমন সময় ঘরে ঢোকে জে ডি প্রিন্টার্স-এর সাহাবাবু। সাহাবাবুর চোখে-মুখে হাসি— গুড মর্নিং স্যার। আমি আজ আবার এসেছি। কাল স্যার আপনি বোধহয় ঠিক মুডে ছিলেন না। তাই আমার প্রস্তাবে ওরকম রেগে গিয়েছিলেন। আগের বড়বাবু…।
আগের বড়বাবু কী করতেন তা আমার দেখার দরকার নেই। আমি তো কাল বলেছি ওসব দু’নম্বরি বিলে সই করতে পারব না।
দু’নম্বরি নয় স্যার। আপনি সই করে দিলেই সব একনম্বরি হয়ে যাবে। আপনি বিলটা পাশ করিয়ে দিচ্ছেন তার জন্য আমার কোম্পানি খুশি হয়ে আপনাকে পাঁচহাজার টাকা গিফট দিচ্ছে। এ তো স্যার বড়বাবুদের ন্যায্য পাওনা। আপনি অন্যভাবে নিচ্ছেন কেন?
শুভর মনের পর্দায় নন্দুর পাঁজরা। মুখে কোনও কথা নেই। দরজার বাইরে হরিদাসের হাসির শব্দ। সাহাবাবুর ডানহাত আস্তে আস্তে শার্টের বুকপকেটে।
[চার]
প্রতিদিনের মতো আজও শুভ অফিসের পরে টিউশনি সেরে শেষ বাসে বাড়ি ফিরছে। ঘামে শরীর জ্যাবজ্যাবে। আকাশটা গুমোট ভাব। ঝড়ের পূর্বাভাস যেন। চারিদিক কেমন থমথমে মনে হচ্ছে। শুভর মনটাও থমথমে। আজ ছাত্রকে অঙ্ক বোঝাতে গিয়ে ভুল করেছে। ছাত্রই তার ভুল ধরেছে। শুভর হাত মাঝেমাঝে বুকপকেটে। ওখানে দশটা পাঁচশো টাকার নোট খরখর করছে। ঠিক তার নিচে বুকের মধ্যে কী যেন একটা খচখচ করছে। কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা!
হঠাৎ দমকা হাওয়া ওঠে। রাস্তায় ধুলোবালি। জানলাগুলো দুমদাম বন্ধ হচ্ছে। বাসটা এসে থেমেছে সিগন্যালে। শুভর হঠাৎ মনে পড়ে যায় অফিস যাওয়ার পথে দেখা সেই হাড়-পাঁজরা বেরোনো ছেলেটার কথা। এই সিগন্যালের ওপাশেই আছে ছেলেটা আর তার মা ও ভাইদুটো। শুভ চকিতে নেমে পড়ে বাস থেতে। সামনের রাস্তা দিয়ে চলমান গাড়ির ফাঁক গলে দ্রুত রাস্তা পেরোয়। বাঁ-হাতটা বুকে। বুকপকেটে রাখা কাগজগুলো বুকে ব্যথা দিচ্ছে। ওর চোখ খুঁজছে ফুটপাথে সেই নন্দুমার্কা ছেলেটাকে। ওই তো, ওই তো শুয়ে আছে ওর মায়ের পিঠ ঘেঁষে। শুভ বুকপকেট থেকে দশখানা কড়কড়ে কাগজ বের করে। কাগজগুলো ভাঁজ করে ঘুমন্ত ছেলেটার হাতে গুঁজে দেয়।
ততক্ষণে সিগন্যালের আলো সবুজ হয়েছে। ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটা লাগামছাড়া হয়ে এগিয়ে আসছে। শুভ কোনওমতে রাস্তা পেরিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়ে। হাত যায় বুকপকেটে। পকেট ফাঁকা। বুকে বিঁধতে থাকা খচখচে কাঁটাটাও আর নেই। বাস চলছে দ্রুতগতিতে। দমকা হাওয়াতে গুমোট ভাবটা কেটেছে। এখন ফুরফুরে হাওয়া বইছে। একে একে বাসের জানলাগুলো আবার খুলে যায়। খোলে তার মনের জানলাও। ফুরফুরে বাতাস তার মনে, শরীরে ছড়িয়ে যায়। ধুলোবালিহীন মনের মাঝে ভেসে ওঠে বড়ছেলে নন্দুর মুখ। নাকি তার হাড়-জিরজিরে শরীর!
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article