দেশটার হল কী! একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিরামহীন দৌরাত্ম্যে। পর পর।
মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে ইন্দ্রায়ণী নদীর উপর ভেঙে পড়ল একটি সেতু! রবিবার দুপুরে ওই দুর্ঘটনার সময় সেতু থেকে প্রায় ২০ জন নদীতে পড়ে যান। পুলিশ সূত্রে খবর, তাঁদের মধ্যে ৫-৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ১০-১৫ জনের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খরস্রোতা নদীর জলের তোড়ে কয়েক জন ভেসে গিয়ে থাকতে পারেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুণের পিম্পরি-চিঞ্চওয়াড় থানা এলাকার কুন্দমালা গ্রামের কাছে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ইন্দ্রায়ণী নদীর কাছে এই পুরনো সেতুটি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। সপ্তাহ শেষের ছুটিতে নদীর ধারে এবং পুরনো সেতুর উপর অনেক পর্যটকই ভিড় করেন। রবিবারও পর্যটকদের ভিড় ছিল সেতু এবং আশপাশের এলাকায়। দুর্ঘটনায় যাঁরা তলিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই পর্যটক বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় একটি সূত্রে খবর, ভেঙে পড়া সেতুর নিচে দু’জন মহিলা আটকে রয়েছেন।
দুর্ঘটনাস্থলটি মহরাষ্ট্রের মভল বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। ইন্দ্রায়ণী নদীর উপর ওই লোহার সেতুটি প্রায় ৩০ বছরের পুরনো। বস্তুত, গত দু’দিন ধরেই পুণের এই গ্রামে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। তার ফলে নদীর জলস্তরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনুমান করা হচ্ছে, নদীর জলের তোড়েই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তবে স্থানীয় সূত্রে খবর, এলাকাবাসীরা দীর্ঘদিন এই সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন। গত ৪-৫ বছর ধরে এই সেতুটির কোনও সংস্কার হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীদের।
এই আবহেই ঘটেছে কপ্টার দুর্ঘটনা। ফের কেদারনাথের পথে দুর্ঘটনা। এবার কেদারনাথ থেকে গুপ্তকাশী ফেরার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ল হেলিকপ্টার। দুর্ঘটনার জেরে কমপক্ষে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত দেড় মাসের মধ্যে পাঁচ বার এমন কপ্টার দুর্ঘটনা ঘটল।
রবিবার ভোর ৫টা ২০ নাগাদ এই দুর্ঘটনা ঘটে। কেদারনাথ ধাম থেকে রওনা হয়ে আরিয়ান অ্যাভিয়েশনের কপ্টারটি গৌরাকুণ্ডের কাছে এসে একটি জঙ্গলের মধ্যে আছড়ে পড়ে। কপ্টারে পাইলট ও দু’বছরের একটি শিশু-সহ মোট ৭ জন যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার জেরে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
হেলিকপ্টারটি ফিরে আসার সময় আবহাওয়া হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। পাইলট চপারটিকে উপত্যকা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু গৌরাকুণ্ডের কাছে এসে সেটি ভেঙে পড়ে।
এর কারণের শিকড় অনেক গভীরে। সত্যি কথা বলতে কী, না আছে ঢাল, না তরোয়াল। দেশের অসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন সংস্থাগুলির দশা নিধিরাম সর্দারের শামিল! মাত্র তিন মাস আগেই এবিষয়ে মোদি সরকারকে সতর্ক করেছিল সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। চলতি বছর মার্চে সংসদে রিপোর্ট পেশ করে সাফ জানানো হয়েছিল, ‘বরাদ্দে অসঙ্গতি’ ও অসংখ্য শূন্যপদের কারণে বিমানযাত্রায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। খোদ অসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টর জেনারেল অব সিভিল এভিয়েশনেই (ডিজিসিএ) ৫৩ শতাংশ পদ ফাঁকা। এছাড়া ব্যুরো অব সিভিল এভিয়েশন সিকিওরিটি (বিসিএএস) এবং এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (এএআই) মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলিতে কোথায় কত পদ ফাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে, তার হিসেব পেশ করে কমিটি। বিমানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিকাঠামো ও দুর্ঘটনা নিয়ে উপযুক্ত তদন্ত চালানোর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। আমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিপর্যয়ের পর নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সংসদীয় কমিটির ওই রিপোর্ট। বরাদ্দ ও শূন্যপদ পূরণে মোদি সরকার আদৌ কোনও পদক্ষেপ করেনি।
জেডিইউ সাংসদ সঞ্জয় ঝায়ের নেতৃত্বে পরিবহণ, পর্যটন ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত ২৫ মার্চ সংসদে ওই রিপোর্টটি পেশ করে। সেখানে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ এভিয়েশন সংস্থাগুলিতে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে। ২০২৫-২৬ সালে বরাদ্দ মোট অর্থের প্রায় অর্ধেক, ৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ডিজিসিএর জন্য। সেই তুলনায় বিসিএএস এবং এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর (এএআইবি) জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ অনেক কম। কমিটির বক্তব্য ছিল, দেশে অসামরিক বিমান পরিবহণ পরিকাঠামোর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। ২০১৪ সালে বিমানবন্দরের সংখ্যা ছিল ৭৪টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৭টি। ২০২৫ সালের মধ্যে তা আরও বাড়িয়ে ২২০টি করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। পরিকাঠামো সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিমানের নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার উপযুক্ত তদন্তের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আগাম প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সূত্রেই বিভিন্ন সংস্থায় বরাদ্দ অর্থের ‘অসঙ্গতি’র বিষয়টি সরকারের নজরে আনা হয় কমিটির তরফে। একইসঙ্গে এইসব সংস্থায় যে প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাব রয়েছে, রিপোর্টে তারও উল্লেখ করা হয়। অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রককে এই রিপোর্টের মাধ্যমে কমিটি জানায়, ডিজিসিএতে মোট ১৬৩৩টি পদের মধ্যে ৮৭৯টি পদই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বিসিএএসে ৫৯৮টির মধ্যে খালি ২০৮টি (প্রায় ৩৫ শতাংশ) পদ। এএআইয়ের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল। ১৯,২৬৯টি পদের মধ্যে ৩,২৬৫টি (১৭ শতাংশ) ফাঁকা।
আমেদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার আবহে সংসদীয় কমিটির ওই রিপোর্ট স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিল।
আর এসবের মধ্যেই ভাইরাল একটা ছবি। ছবিটা বড্ড চেনা। যে কোনও বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর যেমন হয়ে থাকে। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া সারি সারি মৃতদেহের অস্থায়ী ঠিকানা হয়েছে হাসপাতালের মর্গ। সেই মৃতদের মধ্যে থেকে প্রিয়জনের নিথর দেহ ফিরে পেতে আপনজনদের আকুল অপেক্ষা। আমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনায় যেহেতু ভয়াল আগুনে ঝলসে দলা পাকিয়ে গিয়েছে দেহগুলি, তাই সংগত কারণেই পরিবারের সঙ্গে ডিএনএ মিলিয়ে মৃতদেহ আত্মীয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাত সরকার। কাজটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। কারণ মৃতদেহ বলে যা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে অনেকক্ষেত্রে দেহের অংশবিশেষ। তবু দ্রুত কাজ শেষ করতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে কর্মীরা দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করছেন। এই বিরল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও একটা ছবি প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাও বড্ড চেনা। অন্তত গত এক দশক ধরে। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের একটা অংশ মেডিক্যাল পড়ুয়াদের হস্টেলের ছাদ ফুঁড়ে ঝুলছে। তার নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্ভবত ফটোগ্রাফার মাটিতে শুয়ে পড়ে মোদির পিছন থেকে ছবিটি তুলেছেন। শুক্রবার নিজের রাজ্যের ওই দুর্ঘটনাস্থল, হাসপাতাল-সহ কয়েকটি জায়গা পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই ছবিতেই শুধু তিনি আর বিমানের ভাঙা অংশ যেভাবে ‘ছবি’ হিসাবে দেখা গিয়েছে তা চিত্র সাংবাদিকের মুনশিয়ানার দাবি রাখে।
বিস্তারিত মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
ভাঙনের কাল এল বুঝি তবে!
আকাশে, নদীতে, বিমানে সেতুতে শুধু মৃত্যুর খবর আসছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। সবকিছুর পেছনেই সরকারের গাফিলতি। তবু মোদির ঘুম আর ভাঙে না। লিখছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়
