বাংলাকে হতমান, বাঙালির অপমান, একাজ রুখতে লড়ব একসাথে

বাংলা ও বাঙালিকে অপমান করতে, বাংলার ইতিহাস ও গৌরবকে কলঙ্কিত করতে ময়দানে এখন বিজেপি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। ওদের বিষয়ে সচেতন করছেন শমিত ঘোষ

Must read

পৃথিবীর ইতিহাসে সিনেমা এমন একটি জনপ্রিয় মাধ্যম, যা দিয়ে খুব সহজেই একটা বৃহত্তর অংশের মানুষের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সিনেমার একটা অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। হয়তো সে কারণেই একশো বছর পেরিয়েও বিনোদনের এই মাধ্যমটি নিজের জনপ্রিয়তাকে আজও অটুট রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই, গত একশো বছরে বহু শাসক এই মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেছে নিজেদের মহিমা প্রচার করতে অথবা বিপক্ষকে বা শত্রুপক্ষকে ছোট করে দেখাতে। যেমন অ্যাডলফ হিটলার তাঁর নিজের মহিমা প্রচার করতে বানিয়েছিলেন, ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’ (Triumph of the Will)। আবার অ্যাডলফ হিটলার এবং তাঁর কার্যক্রমকে কার্যত ফালাফালা করে দিয়েছিলো চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত এবং নির্দেশিত ১৯৪০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। এরকম অজস্র চলচ্চিত্র আছে পৃথিবীর ইতিহাসে যা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে গৌরবার্থে নির্মিত হয়েছে অথবা আরেকটি জনগোষ্ঠী বা রাজনৈতিক মতামতকে ছোট করে দেখাতে নির্মিত হয়েছে। এমনকী বাণিজ্যিক ছবির আড়ালেও কোনও কোনও ছবি নিজেদের ‘প্রোপাগান্ডা’কে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আমেরিকা আর রাশিয়ার কোল্ড ওয়ার চলাকালীন এমনকী কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী হলিউড জেমস বন্ডের যে ছবিগুলো বানিয়েছে সেগুলোতে প্রধান ভিলেন কোনও-না-কোনও ভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে দেখানো হত। কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী সময়ে যদিও এই প্রবণতা অনেক কমে যায়। আবার ভিয়েতনামের যুদ্ধের পরে গোটা বিশ্ব যখন মার্কিন সেনাবাহিনীর সমালোচনা করছে, তখনই হলিউড নিয়ে এলো ‘র‍্যাম্বো সিরিজ’। যে ‘র‍্যাম্বো’ মার্কিন সেনাবাহিনীর বীরগাথা ফুটিয়ে তুলবে পর্দায়! কিন্তু, এই লেখায় হঠাৎ সিনেমার এত কথা আসছে কেন?

আরও পড়ুন-রাজরাজেশ্বরী রানী ভবানী

আসছে কারণ, সম্প্রতি ভারতের শাসক দল সিনেমাকে ব্যবহার করে ঠিক সেই কাজটাই করছে যা গত একশো বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন শাসকরা করে চলেছেন। অর্থাৎ, সিনেমাকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রচার। অথবা, চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে তাদের বিপক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানের কোনও রাজ্য বা জনজাতিকে ছোট করে দেখানো। একথা বলাই বাহুল্য ২০১৪ পরবর্তী সময়ে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই সর্বক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ‘ন্যারেটিভ’কে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি সুনিপুণভাবে করে চলেছেন। সেটা NCERT-র পাঠ্যক্রম বদল হোক অথবা একের পর এক নিজেদের ন্যারেটিভের প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রোপাগান্ডিস্ট চলচ্চিত্রের নির্মাণ। বিজেপি তাদের রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে বরাবর ব্যবহার করে আসছে সিনেমাকে।
সম্প্রতি ‘কেশরী ২’ নামক একটি চলচ্চিত্রে ক্ষুদিরাম বসুকে ‘ক্ষুদিরাম সিং’ এবং প্রফুল্ল চাকীর নাম বেমালুম ভুলিয়ে দিয়ে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নাম ‘বারীন কুমার’ বলে উল্লেখ করার মধ্যে দিয়ে বলিউড বুঝিয়ে দিয়েছে, তাঁরা বাংলা ও বাঙালির বীর সন্তানদের নিয়ে কতটা শ্রদ্ধাশীল! একটি ঐতিহাসিক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে এই ধরনের নাম বিকৃতি ক্ষমাহীন অপরাধ তা কি নির্মাতারা জানতেন না? তার মধ্যে যেখানে ছবিতে এই সংলাপ উচ্চারণ করছেন, ঘোষিত বিজেপি সমর্থক অক্ষয়কুমারের মতো অভিনেতা! অনেকে বলতেই পারেন, এটা তো চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকের দোষ! এখানে অক্ষয়ের দোষটা কোথায়? আর বিজেপিকেই বা খামোখা আক্রমণ কেন?
এটা একটু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যার প্রয়োজন। কারণ, এই ভুলের কারণ লুকিয়ে অনেক গভীরে। যখন কোনও ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তখন তাঁর গবেষণা বা ‘রিসার্চ পার্ট’টি অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ। বিখ্যাত পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরো প্রায় ১৮ বছর গবেষণা করে ‘গান্ধী’ ছবিটি নির্মাণ করেন। যে ছবি ১১টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে ৮টি অস্কার জিতে নেয়! অথচ, আজকের বলিউডের নির্মাতারা ন্যূনতম গবেষণা ছাড়াই বিকৃত নাম দিয়ে একটি ছবি বানিয়ে ফেলছেন। কারণ, তাদের কাছে শিল্পের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে নিজ দলীয় রাজনীতির প্রোপাগান্ডার প্রচার।
আজ যদি এরকম একই রকম বিকৃতি ভগৎ সিং কে নিয়ে হত। যদি ভগৎ সিং-এর বদলে চলচ্চিত্রের চরিত্র ‘ভগৎ ঘোষ’ বলতেন! অথবা, বল্লভভাই প্যাটেলের নাম ‘বল্লভ সাউ’ বলে উচ্চারণ করতেন তাহলে গোটা দেশ জুড়ে কী পরিমাণ প্রতিবাদের ঝড় উঠত কল্পনা করুন! কিন্তু, যখন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামকে এমন বিকৃতভাবে উচ্চারণ করা হয় তখন আমরা নিষ্প্রভ থাকি। তাই, অক্ষয়কুমাররা এমন বেমালুম ভুল করেও পার পেয়ে যান। বলিউড জানে, বাঙালি বীর বিপ্লবীদের নাম নিয়ে বিকৃত করলেও এক শ্রেণির বাঙালি তার কোনও প্রতিবাদ করবে না। বলিউডের নির্মাতারা জানে আজকের বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মবিস্মৃত। যার ফলে, এই জাতির বীরসন্তানদের নাম উচ্চারণের আগে কোনও বাড়তি গবেষণার প্রয়োজন বোধ করে না তারা।

আরও পড়ুন-মণিপুরে গুলিতে হত কুকি মহিলা

বলিউডের এই বিনির্মাণ একটি বৃহত্তম প্রক্রিয়ার অংশ। আপনি যদি ভেবে থাকেন, যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তাহলে, তাকে বলা যেতে অতিসরলীকরণ। কারণ, বলিউড এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গত কয়েক বছর ধরেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের বিনির্মাণের কাজটি করে চলেছে। এ-প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে, বছর দুয়েক আগে এই বলিউডই নির্মাণ করেছিল বিনায়ক দামোদর সাভারকারের বায়োপিক। সেই ছবির ট্রেলারে এক জায়গায় বলা হয়েছিল, ‘The man who inspired Netaji!’ কতবড় সত্যের অপলাপ! এই বিনায়ক দামোদর সাভারকারের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিরোধ সুবিদিত। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তখন প্রকাশ্য সভা থেকে সাভারকার হিন্দু যুবকদের আরো বেশি করে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এসবই ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বরাবরই সিনেমায় তাদের নিজস্ব প্রোপাগান্ডার প্রচার চালিয়েছে এইভাবেই। আদর্শগত ভাবে বিনায়ক দামোদর সাভারকার বরাবর সংঘ এবং বিজেপির প্রিয় চরিত্র। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বায়োপিকে সাভারকারকে এভাবেই মহিমান্বিত করা হয়, যে নেতাজি নাকি সাভারকারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যদিও বলিউডের এসব ফোড়েরা জীবনেও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাম শোনেননি, সেটা নিশ্চিত বলা যায়। কারণ, বাঙালি জাতি এবং বাংলার ইতিহাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণটা কোনও দিনই এদের আসল উদ্দেশ্য নয়। এরা ওই ইতিহাসের বিনির্মাণকারীদের অংশ।
আর সেই প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে বাংলার ইতিহাস, বাংলার দীর্ঘদিন ধরে লালিত সাম্প্রদায়িক একতার ছবিকে ভুলিয়ে দিতে বলিউড নির্মাণ করে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নামের চলচ্চিত্র। অর্ধসত্য মিথ্যের চেয়েও ভয়ংকর। কিন্তু, যারা প্রোপাগান্ডিস্ট ছবি বানায়। যারা রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে শিল্পকে ব্যবহার করে, তাদের শিল্পের প্রতি দায় থাকে না। ইতিহাসের প্রতিও না। তাদের তখন একমাত্র লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক প্রভুকে তুষ্ট করা। তাই, ইতিহাসের অপলাপ অথবা নিজেদের মেরুকরণের রাজনীতিকেই আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্য নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ-লেখার একেবারে শুরুতেই লিখেছি, চলচ্চিত্র এমন এক বিনোদন মাধ্যম যার এক অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। এ-দেশের একটা বড় অংশের মানুষ আজও সিনেমাকে বিশ্বাস করে। আর এই সুযোগটাই নেয় রাজনীতির কারবারিরা।

আরও পড়ুন-স্ত্রীকে উপহার দিতে স্বর্ণবিপণিতে ৯৩ বছরের বৃদ্ধ, মঙ্গলসূত্রের দাম নিলেন না মুগ্ধ দোকানি

এক শ্রেণির বাঙালি হয়তো এই আশু বিপদ বুঝতে পারছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন বিজেপি বা আরএসএস আসলে তাদের এই যাবতীয় কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বাঙালির মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কখনও বাঙালির ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে, কখনও বাঙালির রক্তাক্ত ইতিহাসের জখমকে ফের খুঁচিয়ে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক রাস্তাকে সুগম করতে চাইছে। সিনেমা সেখানে কেবলই আর একটি বিনোদনের মাধ্যম হয়ে থাকছে না, তা হয়ে উঠছে শাসকের প্রচারযন্ত্র!
সেখানে ক্ষুদিরাম বসু, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুদের নিয়ে বিকৃত ইতিহাস পরিবেশন করা যায় অনায়াসে। যেখানে বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে মেরুকরণের রাজনীতিকে হাওয়া দেওয়া যায় । গোটা দেশের সামনে বাংলা ও বাঙালিকে ছোট করে দেখানোর এই প্রবণতার বিরুদ্ধে বাঙালিকেই সরব হতে হবে।

Latest article