বিধবা দিবসের গল্প

একটা সময় বিধবা হওয়া ছিল একটা অভিশাপের মতো। মনে করা হত বিধবারা পরিবারে দুর্ভোগ নিয়ে আসে। সমাজে বিধবাদের সেইভাবে সম্মান দেওয়া হত না একসময়। যুগ বদলেছে। এখন আর সমাজ বিধবাদের দিকে সেই ভাবে চোখ রাঙিয়ে তাকায় না। আগামী কাল বিশ্ব বিধবা দিবস। আর এই দিবসের গল্পই লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

আজ রুক্মিণীর বিয়ে। খুব ছোট বয়সেই বাবাকে হারিয়েছে সে। তার জগৎ ঘিরে শুধুই তার মায়ের আনাগোনা। জীবনের প্রতিটি বড় বড় পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার মা তাকে সাহায্য করেছে। এমত অবস্থায় তার মা নাকি তার বিয়ের কোনও কাজে হাত দিতে পারবে না, কারণ তিনি বিধবা। আর বিধবাদের নাকি শুভ কাজে হাত দেওয়া নিষিদ্ধ। আর এখানেই আপত্তি রুক্মিণীর। সে জানিয়ে দিয়েছে যে যদি তার মা বিয়ের কাজে হাত না দিতে পারে তাহলে সে শুধুমাত্র রেজিস্ট্রি বিবাহ করবে, কোনও নিয়ম-কানুন মানবে না। যে মা সারা জীবন ভেবে এসেছে তার মেয়ের কীসে ভাল হবে, কীসে শুভ হবে সেই মা তার শুভ অনুষ্ঠানে হাত দিলে অমঙ্গল হবে সেটা রুক্মিণী কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। রুক্মিণীর কথায় বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু রুক্মিণী সেই এক গোঁ, তার বিয়ের সমস্ত শুভ কাজে তার মায়ের হাত দিতে হবে, তাহলেই সে মন্ত্র পড়ে আচার অনুষ্ঠান মেনে বিয়ে করবে। শেষ অবধি রুক্মিণীর জেদের কাছে হাল ছাড়েন তার পরিবারের লোকজন। রুক্মিণীর বিয়েতে হাত লাগান তাঁর মা।
রুক্মিণীর মায়ের মতো কপাল কিন্তু সমস্ত বিধবাদের হয় না। বিধবাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ হচ্ছে ভারতীয় হিন্দু সমাজের একটি কলঙ্ক।

আরও পড়ুন-বৈধব্য এখন অতীত

সামাজিক বৈষম্যই ছিল প্রাচীন ভারতীয় সমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীদের জীবনে যন্ত্রণার প্রধান কারণ। সেই সময় বিধবাদের জন্য একটি অলিখিত নিয়ম ছিল। সেই অলিখিত নিয়মে বলা ছিল বিধবারা সামাজিক বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা তো স্বপ্নের মধ্যেও আনা বারণ ছিল। সেই সময় বেশিরভাগ হিন্দু বিধবাদের পরিবারগুলো তাদেরকে কাশী, বৃন্দাবন অথবা মথুরাতে পাঠিয়ে দিত। আর সেখানকার জীবন ছিল আরও ভয়ংকর। তবে ঐতিহাসিকদের অনেকের মতে ১৬ শতকে চৈতন্য মহাপ্রভু সতীদাহ থেকে বাঁচাতে বিধবা মহিলাদের একটি দলকে এই স্থানে নিয়ে এসেছিলেন। আর এরপর থেকে অনেক বিধবাই বাড়িতে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে এখানে পালিয়ে আসেন। কিছু জনের পরিবারের লোক নিজেরাই এসে ছেড়ে দিয়ে যায় তাদের। ক্রমে ক্রমে এই বিধবারাই বাতিলের দলে নাম লেখায়।
আগেকার দিনে বাল্যবিবাহ ছিল একটি সামাজিক প্রথা। তার আগেও ছিল সতীদাহ প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী সহমরণে যেতে হত বিধবাদের। স্বামীর জ্বলন্ত চিতারর উপরে উল্লাস করতে করতে সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষরা বিধবাদের জ্যান্ত অবস্থায় সেই চিতায় উঠিয়ে দিত। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সেই ঘৃণ্য প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। সতীদাহ প্রথা রদ করার পরে সমাজে বাল্যবিধবার সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। কিছু বোঝার আগে কিংবা যৌবন আসার আগেই সমস্তরকম সামাজিক সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে যেত তারা। সে-সময় বিধবাদের পুনরায় বিবাহ করা ছিল সম্পূর্ণ সমাজবিরুদ্ধ ব্যাপার। সেই বিরোধিতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের বিল পাশ করেছিলেন। কিন্তু তবুও সেসময় বিধবারা চরম কষ্টে তাঁদের দিন যাপন করতেন। সেই সময় স্বামীর মৃত্যুর পর কম বয়সে বিধবাদের বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। স্বামীর গৃহে তাদের স্থান হত না। সিঁথির সিঁদুর মুছে, সাদা থান পরে, গায়ের সমস্ত গহনা খুলে, চুল কেটে, একবেলা কোনওরকমে নিরামিষ খাবার খেয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাতেন সেই সময়ের বিধবারা। শুধু মাছ মাংস ডিম নয়, তার সাথে মুসুরির ডাল, পেঁয়াজ, রসুনও বর্জন করতে হত তৎকালীন বিধবাদের। সে-সময় বাপের বাড়িতেও বিধবা মহিলাদের স্থান ছিল নিচে। বাড়ির সমস্ত কাজ তাদের দিয়েই করানো হত। তৎকালীন সমাজের দাবি ছিল বিধবারা শুদ্ধ মনের পবিত্র জীবন যাপন করবে এবং সংসারের সমস্ত কাজ করবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই সময়কার বিধবারা নিজেদের সংসারেরই কোনও পুরুষের লালসার শিকার হতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দোষ হত সেই বিধবার। অনেক ক্ষেত্রে সেই সময় বিধবাদের জোর করে তীর্থক্ষেত্রে তথা বারাণসীতে ছেড়ে রেখে আসা হত। আর সেখানে সেই সব বিধবারই জীবন কাটত চরম দারিদ্র আর অবহেলার মধ্য দিয়ে।
আগেকার দিনের মতো এত কষ্ট সহ্য করতে না হলেও আজও সমাজের বুকে বেশিরভাগ বিধবাই অবহেলিত এবং অবাঞ্ছিত। আজও বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানের তাঁদের যোগ দিতে দেওয়া হয় না। কোনও কোনও জায়গায় তাঁদের আমিষ খাওয়ার উপর চরম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই বিধবাদের নিয়ে বিচিত্র রীতি রয়েছে। যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনকও। আর যেগুলো তাঁদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। ঘানার বিধবাদের স্বামী মরে যাওয়ার পর সেই মৃত স্বামী শরীরের অংশ দিয়ে বানানো স্যুপ খেতে হয়। এছাড়াও মৃতদেহকে যে জল দিয়ে স্নান করানো হয় সেই জলও খেতে হয় তাদের। ওখানকার উচ্চবিত্ত মহিলারা বর্তমানে এই রীতি না মানলেও দরিদ্র বিধবারা এই না মানার সাহস দেখাতে পারেন না। পৃথিবীর বহু জায়গায় বিধবাদের মাছ মাংস ডিম খাওয়া নিষিদ্ধ। স্বামী মারা গেলে আজও উজ্জ্বল বা রঙিন শাড়ি, গয়না পরার অধিকার হঠাৎ করেই তার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের জীবন থেকে সমস্ত আনন্দই হারিয়ে যায় এই সময়। আর এই সমস্ত আচার-আচরণের ফলে মানসিক অবসাদ গ্রাস করে বিধবাদের। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর লেখা দোরোখা একাদশীতে লিখেছিলেন “উড়িয়ে লুচি আড়াই দিস্তে দেড় কুড়ি আম সহ, একাদশীর বিধানদাতা করেন একাদশী,… ওদিকে ওই ক্ষীণ মেয়েটি নিত্য একাহারি, একাদশীর বিধান পালন করছে প্রাণে মরে, কণ্ঠাতে প্রাণ ধুঁকছে, চোখে সর্ষে ফুলের সারি, তৃষ্ণাতে জিভ অসাড়, মালা জপছে ঠাকুরঘরে। অবাক চোখে বিশ্ব দেখে হায় গো বিশ্বনাথ, দোরখা এই বিধান পরে হয় না বজ্রপাত”।

আরও পড়ুন-রথের নিরাপত্তা দেখতে দিঘায় ডিজি

বিশ্ব জুড়ে ২৫৮ মিলিয়ন বিধবা রয়েছেন আর তাঁদের ১০ জনের মধ্যে একজন দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় বিধবার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ স্বরূপ দেখানো হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ। সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে ১০ জন বিবাহযোগ্য বয়সি নারীদের মধ্যে একজন বিধবা। বৈধব্যের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে দ্য লুম্বা ফাউন্ডেশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুন বিধবা দিবস পালনের পেছনেও রয়েছে একটি ঘটনা। দ্য লুম্বা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত লর্ড লুম্বা ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারের সভাপতি। ১৯৫৪ সালের ২৩ জুন লর্ড লুম্বা পিতৃহীন হয়েছিলেন ফলে তাঁর মা শ্রীমতী পুষ্প ওয়াতি লুম্বা বিধবা হয়েছিলেন ওই দিন। লর্ড লুম্বা তাঁর মায়ের বিধবা জীবনের কষ্ট নিজের চোখে দেখেছেন, খুব অল্প বয়সেই তাঁর মা বিধবা হয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর দাদি তাঁর মাকে রঙিন শাড়ি খুলে এবং সিঁথির সিঁদুর মুছে সাদা থান কাপড় পরতে বলেছিলেন। বিধবার বেশে লর্ড লুম্বার মাকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভীষণ কষ্টে জীবন কাটাতে হয়েছিল। আর সেই কারণেই বিধবা দিবস প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য লুম্বা ফাউন্ডেশন বিধবা দিবস বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের অনুমোদনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ পরিষদে পেশ করা প্রতিবেদনে তাঁরা বলেছিলেন যে বিশ্বে ছয় কোটির বেশি বিধবা নারী স্বামী হারিয়ে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এছাড়াও তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদনে আরও জানিয়েছিলেন যে এই সমস্ত বিধবা সামাজিক কলঙ্ক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনারও শিকার হচ্ছেন। এই সমস্ত অসহায় নারীদের দেখার মতো কেউ নেই। আর এরপরেই নিদারুণ নিঃসঙ্গতা ও কষ্টের মধ্যে থাকা বিশ্বের কোটি কোটি বিধবার অধিকার ও সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৩ জুনকে আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। বিধবাদের জন্য অনেক দেশে অনেকরকম সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত আছে সেগুলো যাতে বন্ধ করা যায় অর্থাৎ যাতে বিধবা মহিলারা নিজের পছন্দমতো পোশাক পরতে পারেন, পুষ্টিযুক্ত পছন্দসই খাবার খেতে পারেন এবং দরকার হলে পুনরায় নিজের ইচ্ছেমতো বিবাহ করতে পারেন সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখার জন্য প্রতিটি দেশের নিয়ম-কানুন থাকা দরকার।

আরও পড়ুন-রাজরাজেশ্বরী রানী ভবানী

আমাদের দেশের বিশেষ করে বাংলার বিধবাদের কোনওদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তাঁরা কীভাবে বাঁচতে চান। উপরন্তু স্বামী মারা গেলে আনন্দ, কামনা, স্বাদ, গন্ধ, শখ সবকিছু তাঁদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়ে আদ্যোপান্ত বেরঙিন করে দেওয়া হয় তাঁদেরকে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান উৎসব সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হন তাঁরা। কিন্তু এই একবিংশ শতকে সেই সমস্ত বেড়া ভাঙার লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন বিধবারা। আজকের দিনে হোলি খেলাও শুরু করেছেন তাঁরা। কৃষ্ণের বৃন্দাবনে ২০১৩ সাল থেকে প্রকাশ্যে হোলি খেলেন বিধবারা। মথুরা, বৃন্দাবন সব জায়গাতেই তাঁরা হোলি খেলেন। একটা সময় সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষজন হোলিকে তাঁদের নিজস্ব উৎসবে পরিণত করেছেন। কৃষ্ণের শহর বৃন্দাবনকে অনেকে বিধবাদের শহর বলেন। এই শহরেই রয়েছেন কয়েক হাজার বিধবা। আর উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের প্রায় বেশিরভাগই পশ্চিমবাংলা থেকে এখানে এসে বসবাস করছেন। এই সমস্ত বিধবাদের কেউ রাস্তায় বা মন্দিরের গলিতে ভিক্ষা করতেন। মন্দিরের সিঁড়ি হচ্ছে তাঁদের রাতের থাকার জায়গা, শোবার ঘর। তাঁদের পরনে শুধুই সাদা কাপড় আর জীবন জুড়ে ছিল অনিশ্চয়তা আর অধিকারহীনতা। ২০১২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিস অথরিটি চ্যারিটি’র দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে এই সমস্ত বিধবার ভরণপোষণের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সেই থেকে বৃন্দাবনের বিধবাদের জীবনের উন্নতি নিয়ে সুলভ ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা নানান ধরনের কাজ করে চলেছে। এছাড়াও স্থানীয় বহু দাতব্য সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, মন্দির, আশ্রম এই বিধবাদের সেবার জন্য নিয়োজিত রয়েছে।
আস্তে আস্তে আমাদের সমাজ উন্নত হচ্ছে। বিধবাদের কাছ থেকে জোর করে কোনও কিছু আজ আর কেড়ে নেওয়া হয় না। আজ তাঁরা অনেকটাই স্বতন্ত্র ও রঙিন। নিজেদের ন্যায্য অধিকার লাভের জন্য এখন তাঁরা লড়াই করতে শিখেছেন। কেউ কেউ নিজেদের পছন্দমতো দ্বিতীয় বিবাহও করছেন। আজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের চোখরাঙানি বন্ধ হয়ে গেছে।

Latest article