অম্বুবাচী ভবেন্নিতং পুনঃস্থকাল বারয়ঃ

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে দেবী কামাখ্যা, রজঃস্বলা বা ঋতুমতী হন। এই সময় মন্দিরে মন্দিরে দেবীদর্শন বন্ধ থাকে। কেন? অম্বুবাচীর ইতিহাস ও শাস্ত্রীয় নিয়মই বা কী? এই সবকিছু নিয়েই লিখেছেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

হিন্দুধর্মের এক বিশেষ উৎসব হল অম্বুবাচী। লোককথা অনুসারে, আষাঢ় মাসের মৃগশিরা নক্ষত্রের তৃতীয় চরণ শেষ হলে ধরিত্রী মা ঋতুমতী হন।
ঠিক এই সময়ই পালন করা হয় অম্বুবাচী।
রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর অষ্টবিংশতি তত্ত্ব নামক গ্রন্থে তিথি তত্ত্ব ও কৃত্যতত্ত্বে অম্বুবাচী ও তার স্থিতিকাল নিয়ে লিখেছেন— ‘যস্মিন বারে সহস্রাংশু যতকালে মিথুনং ব্রজেত।
অম্বুবাচী ভবে ন্নিতং পুনঃস্থকাল বারয়ঃ।’
অর্থাৎ সূর্য আষাঢ় মাসে যে দিন, যে সময়ে, মিথুন রাশিতে আদ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে গমন করে সেই সময়কাল থেকে মাতৃস্বরূপা পৃথিবী এবং আদ্যাশক্তি মহামায়া, ঋতুমতী হন বা অম্বুবাচীর কাল শুরু হয়।
‘তাবত্কালোবধি বিংশতি দণ্ডাধিক দিন ত্রয়ম’
অর্থাৎ সূর্যের মিথুন রাশি গমনের কাল থেকে শুরু করে বিংশতিদণ্ডাধিক তিনদিন বা তিনদিন কুড়ি দণ্ড কাল সময় অম্বুবাচীর স্থিতি।
গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর যখন বর্ষার আগমনে ধরিত্রী সিক্ত হয় এবং নতুন রূপে বেশ ধারণের যোগ্য হয়ে ওঠে সেই সময়কেই বলা হয় অম্বুবাচী।
বাংলায় একটা প্রবাদ রয়েছে— ‘কীসের বার কীসের তিথি আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী।’ ধরিত্রীমাতা ঋতুমতী হওয়ার পরেই ফলে ফুলে ভরে যায় পৃথিবী।
এই সময় মাটিকাটা বা জমিতে লাঙল চালানোর নিয়ম নেই। ভারতের নানা স্থানে এই উৎসব রজঃ উৎসব নামে পালিত হয়।

আরও পড়ুন-অম্বুবাচী ভবেন্নিতং পুনঃস্থকাল বারয়ঃ

কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী
প্রতিবছর অম্বুবাচীর সময়ের জন্য কামাখ্যা মন্দির প্রসিদ্ধ। মহাশক্তি পীঠ কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। কামাখ্যায় দেবীর উৎপত্তি বিষয়ে বলা হয় সেগুলো স্ত্রী দেবী শক্তির অপর নাম দেবী কামাখ্যা— দেবীর উৎপত্তি সম্পর্কে একটি রহস্যময় কাহিনি আছে, সতীর পিতা যখন তাঁর বাড়িতে পুজোর অনুষ্ঠান করেন তখন তিনি দেবলোকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিন্তু ভগবান শিবকে বাদ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সতী তাঁর স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন— এই খবর দেখে, এ খবর জেনে মহাদেব ক্ষিপ্ত ওঠেন। এরপর তিনি দেবীকে কোলে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলে মহাবিশ্বের বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তারপর সবাই ভগবান শিবকে শান্ত করার জন্য ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করলে তখন শ্রীহরি বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। মানে দেবীর শরীর একান্নটি টুকরো হয়ে যায়।
প্রতিটি টুকরো যেখানে পড়ে সেখানে গড়ে ওঠে এক-একটি শক্তিপীঠ। তেমনি একটি টুকরো পড়েছিল আসাম অঞ্চলে। যে দেহখণ্ডটি পড়েছিল সেটি দেবী সতীর যোনি বলে কথিত। সেই থেকে দেবীর যোনিকে এখানে পুজো করা হয়। ও দেবীর নাম রাখা হয় কামাখ্যা। যিনি মাতৃত্ব ও ঊর্বরতার দেবী।
এই মন্দিরটি আসাম রাজ্যে গুয়াহাটিতে একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত। এই মন্দিরটি অন্যান্য শক্তিপীঠের থেকে একটু আলাদা। কারণ এই পীঠ তন্ত্রসাধনার জন্যও খুব বিখ্যাত। এই মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। সতীর যোনি অংশ এখানে পতিত হয়েছিল। তাই এখানে দেবীর যোনি অংশই পূজিত হয়, যা পাথরের আকারে বিরাজমান।
এখানে নীল পাথর যুক্ত যোনি রূপে মা কামাখ্যা বিরাজ করেন। যাঁরা এই শীলাকে উপাসনা করেন, দর্শন করেন এবং স্পর্শ করেন তাঁরা দেবী ভগবতীর সঙ্গ লাভ করে দৈব কৃপা ও মোক্ষ লাভ করেন। এমনটাই ভক্তদের বিশ্বাস।
এই শক্তিপীঠে দেবী চৌষট্টি জন যোগিনী ও দশমহাবিদ্যার সঙ্গে উপবিষ্ট আছেন। ভুবনেশ্বরী, বগলা, ছিন্নমস্তিকা, কালী, তারা, মাতঙ্গী, কমলা, স্বরস্বতী, ধুমাবতী এবং ভৈরবী এক জায়গায় উপস্থিত।
যদিও সমস্ত শক্তিপীঠেরই নিজস্ব গুরুত্ব এবং ঐতিহ্য রয়েছে।
তবে অন্য সকলের মধ্যে কামাখ্যা শক্তিপীঠকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। কালিকাপুরাণ অনুসারে, এই স্থানে কামদেব যিনি শিবের ত্রিনেত্র দ্বারা অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন তিনি তাঁর পূর্ব রূপ ফিরে পাওয়ার বর পেয়েছিলেন।
অম্বুবাচী শব্দটি অম্বু এবং বাচী এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত যেখানে অম্বু অর্থ জল এবং বাচী অর্থ প্রস্ফুটিত।
এই শব্দটি নারীর শক্তি এবং তাদের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে প্রতি বছর জুন মাসে দেবী কামাখ্যা রজঃস্বলা বা ঋতুমতী হন।
কথিত আছে, অম্বুবাচী যোগ উৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ যেদিন দেবী ঋতুমতী হন সেদিন থেকেই দেবীর গর্ভগৃহের দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় ভেতরে গিয়ে দেবীদর্শন নিষিদ্ধ থাকে। এই সময় ব্রহ্মপুত্র নদের জল তিনদিন লাল হয়ে যায়। তিনদিন পর ঋতুর শেষে, চতুর্থ দিনের ব্রাহ্মমুহূর্তে দেবীকে স্নান করিয়ে, সাজিয়ে বিশেষ পূজা অর্চনা শেষে ভক্তদের দর্শনের উদ্দেশ্যে মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার রীতি রয়েছে।
কথিত আছে, অম্বুবাচী চতুর্থ দিনে দেবী কামাখ্যা দর্শন করলে ভক্তদের পাপ বিনাশ হয়।
অম্বুবাচীর ধর্মীয় বিশ্বাস
অম্বুবাচী হিন্দু ধর্মের বাৎসরিক উৎসব। অম্বুবাচীকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অমাবতীও বলে।
হিন্দু শাস্ত্রে পৃথিবীকে মা বলা হয়।
পৌরাণিক যুগে পৃথিবীকে ধরিত্রীকে মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-বিধবা দিবসের গল্প

আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুমতী হন। এই সময়টিতেই অম্বুবাচী পালন করার রীতি। প্রতিবছর অম্বুবাচী তিনদিন পৃথিবীর ঋতুকাল হিসেবে ধরা হয়।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার থাকলেও এর সঙ্গে প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থা জড়িয়ে থাকা এটির একটা সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে অম্বুবাচী একটি কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান। এর অর্থ ধরিত্রী উর্বরতা দেখা যায় তিনদিন জমিতে কোনওরকম চাষ করা হয় না যাতে বর্ষায় সিক্ত পৃথিবী নতুন বছরে নতুন ফসল উৎপাদনের উপযোগী হয়ে ওঠে।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে এই উৎসব পালিত হয় এ সময় পরিবারের বয়স্ক বিধবা মহিলাদের তিনদিন ধরে অম্বুবাচী উপলক্ষে ব্রত পালন করতে দেখা যায়। অম্বুবাচী পড়ার আগে রান্না করে রাখা হয় পরের তিনদিন খাওয়ার জন্য অম্বুবাচী শুরু হয়ে গেলে রান্নার জন্য আগুন জ্বালানো বারণ। অম্বুবাচী ব্রত পালনের কিছু শাস্ত্রীয় নিয়ম রয়েছে। অম্বুবাচী চলাকালীন পুজোর সময় মন্ত্র পাঠ করা না করে শুধু ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রমাণ করার নিয়ম। বাড়িতে তুলসী গাছ থাকলে তার গোড়া মাটি দিয়ে উঁচু করে রাখা ইত্যাদি।
অম্বুবাচী চলাকালীন বিভিন্ন মন্দির ও বাড়ির ঠাকুর ঘরের মাতৃমূর্তি বা ছবিকে লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার নিয়ম। শেষ হওয়ার পর দেবীর আসন পাল্টে পরিষ্কার করে তারপর স্নান করিয়ে পুজোর নতুন করে শুরু করতে হবে। কোনও শুভ কাজ এই ক’দিন নিষিদ্ধ থাকে। এমনকী কৃষিকাজ বন্ধ রাখা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে, ঋতুমতী মেয়েরা অশুচি থাকেন। একইভাবে মনে করা হয় পৃথিবীও এই সময়কালে অশুচি থাকে। সেই জন্যই এই তিনদিন ব্রহ্মচারী সাধু সন্ন্যাসী পুরুষ এবং বিধবা মহিলারা পৃথিবীর উপর আগুনের রান্না করে কিছু খান না। কারণ পৃথিবীর বুকে কোনও আঘাত ঘটানো হয় না।
আধুনিক যুগে অম্বুবাচীর ধরন বদলেছে। বদলেছে নিয়ম ও রীতিও।
ধরিত্রী ও নারী এক মেনে এই ক’দিনে ধরিত্রীর যাতে আঘাত না লাগে তাই কোনওরকম লাঙল চালানো বা মাটি খোঁড়া এসব করা যায় না।
এককালে এই নিয়মনীতি বিধিনিষেধ শুধুমাত্র নারীদের জন্যই প্রযোজ্য হত। কিন্তু এই মঙ্গলে পা রাখার যুগে এই ধরাবাঁধা নিয়ম অনেকাংশেই তার মান্যতা হারিয়েছে।
তবে অম্বুবাচী বা কামাখ্যা মন্দিরের যে নিয়ম রীতি এবং তার যে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং তার মাহাত্ম্য ঐতিহ্য, তাৎপর্য ও বিশ্বাস আজও মানুষের মনে স্বমহিমায় অক্ষুণ্ণ রয়েছে।।

Latest article