১২৫ বছর আগে
অলিম্পিক পদক যে কোনও ক্রীড়াবিদের স্বপ্ন। কেউ পূরণ করতে পেরেছেন, কেউ ব্যর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন ইভেন্টে অলিম্পিক থেকে পদক পেয়েছেন বহু ভারতীয় ক্রীড়াবিদ। কেউ পেয়েছেন একটা পদক। কেউ আবার দুটো। সুশীল কুমার, পিভি সিন্ধুর জোড়া পদক প্রাপ্তি ঘটেছে পরপর দুটো অলিম্পিক থেকে। কিন্তু একই অলিম্পিকে দু-দুটো পদক ভারতীয় হিসেবে পেয়েছেন মাত্র দু’জন। দ্বিতীয় জন হলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম অ্যাথলিট মনু ভাকের। একই অলিম্পিকে দুটো পদক এনে চমকে দিয়েছেন তিনি। আর প্রথম জন হলেন নর্ম্যান গিলবার্ট প্রিচার্ড। যাঁর পরিচিতি ছিল নর্ম্যান প্রিচার্ড নামে। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে দুটো পদক জিতেছিলেন তিনি। সেই প্রথম অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব। আর প্রথমবারই স্রেফ পদক নয়, দুটো রুপো এনেছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। কোন কোন ইভেন্টে? ২০০ মিটার হার্ডলস ও ২০০ মিটার রেসে। আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগের ঘটনা, বরাবর আলোচনায় রেখেছে তাঁকে।
রবিনসন রোডের বাড়ি
নাম শুনলে একটু অ-ভারতীয়ই মনে হয়, তাই না? সেটাই রহস্য। শরীরে ব্রিটিশ রক্ত থাকলেও, তিনি ছিলেন খাঁটি ভারতীয়। ১৮৭৫ সালের ২৩ জুন, ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরের আলিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জর্জ পিটারসন প্রিচার্ড ছিলেন কেরানি। মা হেলেন মেনার্ড প্রিচার্ড। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ অলিম্পিক হিস্টোরিয়ানস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ান বুকানন ২০০০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর জার্নালে ভারতীয় অলিম্পিয়ান নর্ম্যান প্রিচার্ড-এর রহস্যের উপর কিছু আলোকপাত করেছেন। বুকানন এবং এই প্রকল্পে তাঁর অংশীদার গুলু এজেকিয়েল নর্ম্যান প্রিচার্ডকে ‘রহস্যময় পুরুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের জার্নালে বলা হয়েছে, কলকাতার ফ্যাশনেবল রবিনসন রোডের একটি বাড়িতে প্রিচার্ডরা থাকতেন।
ফুটবলে হ্যাটট্রিক
বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন নর্ম্যান প্রিচার্ড। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলোর প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ। দারুণ ফুটবল খেলতেন। পায়ে বল পড়লে হয়ে উঠতেন ম্যাজিশিয়ান। এক-একজনকে কাটিয়ে বল পাঠাতেন গোলে। আবার গোল বাঁচাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। ১৮৯৭ সালে শোভাবাজারের বিপক্ষে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের হয়ে তিনটি গোল করেন। দেশের একটি উন্মুক্ত ফুটবল টুর্নামেন্টে প্রথম হ্যাটট্রিক করার রেকর্ডটিও ছিল তাঁর দখলে। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত অ্যাথলিট। বিশেষ করে স্প্রিন্টার হিসেবে বেশ নাকডাক ছিল তাঁর। লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়াতেন। হরিণের মতো। ১৯৮৪ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত টানা বেঙ্গল ১০০ ইয়ার্ডসে একাধিক রেকর্ড করেছেন। বারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। জানা যায়, তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো স্প্রিন্টার সেই সময় দেশে ছিল না। এককথায় ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আসলে জন্ম থেকেই বিশ্বমানের অ্যাথলিট ছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। পড়াশোনা শেষ করে নামী ট্রেডিং কোম্পানি বার্ড অ্যান্ড কোম্পানিতে চাকরি পান। কিন্তু ফুটবল বা স্প্রিন্ট কোনওটাই ছাড়েননি তিনি।
আরও পড়ুন-মোহনবাগান রত্ন পাচ্ছেন টুটু বোস
প্যারিস গেমসে নির্বাচিত
১৯০০ সালে, ২৫ বছর বয়সে বাবা জর্জের সঙ্গে ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান নর্ম্যান প্রিচার্ড। ওই বছর ১২ জুন লন্ডন অ্যাথলেটিক ক্লাবে যোগ দেন। তিনি একাধিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেন এবং অ্যামেচার অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের সময় আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে পরিচিত হন। ট্রিপল এ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি চমকে দেওয়ার মতো পারফর্ম করেন। এখানেই ট্যুইস্ট। ট্রিপল এ চ্যাম্পিয়নশিপের ১১০ মিটার হার্ডলসে দুরন্ত পারফরম্যান্সের জন্য তিনি অলিম্পিক টিমে সুযোগ পেয়ে যান। বলা যায়, এই চ্যাম্পিয়নশিপ প্যারিস গেমসের ট্রায়াল হিসেবে কাজ করেছিল। নর্ম্যান প্রিচার্ড ১২০ মিটার হার্ডলসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেনজলিনের পরে দৌড় শেষ করেন। রানার-আপ হন। আরও বেশ কয়েকটি ইভেন্টে ভাল করেন এবং প্যারিস গেমসের জন্য নির্বাচিত হন। বারোটি ইভেন্টে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা হয়।
ভূমিপুত্র হিসেবে ভারতীয়
১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিক প্রোগ্রামে, নর্ম্যান প্রিচার্ড ১০০ মিটার দৌড়ে ‘ইংল্যান্ড’-এর অধীনে এবং ১০০ মিটার হার্ডলসে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’র অধীনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই দুই ইভেন্টে তিনি রৌপ্যপদক জিতেছিলেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে তাঁকে ‘ইংলিশম্যান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অলিম্পিকে নামার আগে তিনি নাকি বলেছিলেন, যে দেশে জন্মেছেন, অর্থাৎ ব্রিটিশ-ভারতের হয়েই অলিম্পিকে নামতে চান। কারণ, ভূমিপুত্র হিসেবে তিনি ভারতীয়ই। যদিও ব্রিটিশরা তাঁকে তাঁদের বলে দাবি করতে থাকেন। এই নিয়ে চলে জোর বিতর্ক। মনে রাখতে হবে, অলিম্পিক পদকজয়ী প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত ক্রীড়াবিদ তিনিই। এটা ঠিক, নর্ম্যান প্রিচার্ডের পরিবার গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অ্যাথলেটিক ক্লাবের পাশাপাশি লন্ডন অ্যাথলেটিক ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কিন্তু তাঁকে ভারতের অ্যাথলিট হিসেবেই মেনে নিয়েছে।
স্থায়ীভাবে বিদেশে
প্যারিস অলিম্পিকের পর কিন্তু ভারতেই ফিরে আসেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। তবে আর অ্যাথলিট বা প্লেয়ার হিসেবে তাঁকে দেখা যায়নি। হয়ে ওঠেন দক্ষ প্রশাসক। ১৯০০ সাল থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত পাঁচ বছর নর্ম্যান প্রিচার্ড ছিলেন আইএফএ-র সচিব। এর কিছুদিন পর ইংরেজ অভিনেতা এবং থিয়েটার মালিক স্যার চার্লস উইন্ডহ্যামের উৎসাহে তিনি অভিনেতা হয়ে ওঠেন। দিল্লিতে লর্ড কার্জনের একটি দরবারে তাঁর নাটকীয় বর্ণনা দেখা ও শোনার পর উইন্ডহ্যাম নর্ম্যান প্রিচার্ডকে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ১৯০৬ সালে ভারত থেকে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যান নর্ম্যান প্রিচার্ড। দ্বিতীয় ইংল্যান্ড সফরের পর বেশ কিছুকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ব্রডওয়েতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং তারপর নরম্যান ট্রেভর নাম নিয়ে একজন নির্বাক চলচ্চিত্র তারকা হয়ে ওঠেন। এই নামেই তিনি ব্রিটিশ চলচ্চিত্র আইকন রোনাল্ড কোলম্যানের হলিউড নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। আসলে অভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বহু আগে থেকেই। সুযোগ পেয়ে তাই হাতছাড়া করতে চাননি। তিনিই হলেন প্রথম অলিম্পিয়ান, যিনি নির্বাক হলিউড চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। রোনাল্ড কোলম্যানের মতো বিখ্যাত তারকাদের সঙ্গে ২৬টি নাটক এবং ২৭টি ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন-ওয়েবারকে উড়িয়ে নীরজই সেরা
দিয়েছেন দক্ষতার পরিচয়
নর্ম্যান প্রিচার্ড অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হল ‘আইভরি স্নাফ বক্স’ (১৯১৫), ‘দ্য ডটার পেস’ (১৯২০) ‘রোমান্স’ (১৯২০), ‘দ্য ব্ল্যাক প্যান্থারস কাব’ (১৯২১), ‘জেন আয়ার’ (১৯২১), ‘দ্য সাইড শো অফ লাইফ’ (১৯২৪), ‘রুলেট’ (১৯২৪), ‘ওয়েজেস অফ ভার্চু’ (১৯২৪), ‘দ্য ম্যান হু ফাইন্ড ইনিসেলফ’ (১৯২৫), ‘ড্যান্সিং মাদার্স’ (১৯২৬), ‘দ্য এস অফ ক্যাডস’ (১৯২৬), ‘দ্য সং অ্যান্ড ড্যান্স ম্যান’ (১৯২৬), ‘বিউ গেস্তে’ (১৯২৬), ‘দ্য ওয়ার্নিং’ (১৯২৭), ‘নিউ ইয়র্ক’ (১৯২৭), ‘আফ্রাইড টু লাভ’ (১৯২৭), ‘দ্য উইজার্ড’ (১৯২৭), ‘দ্য মিউজিক মাস্টার’ (১৯২৭), ‘চিলড্রেন অফ ডিভোর্স’ (১৯২৭), সোরেল অ্যান্ড সন (১৯২৭), ‘দ্য সাইরেন’ (১৯২৭), ‘ম্যাড আওয়ার’ (১৯২৮), ‘রেস্টলেস ইয়ুথ’ (১৯২৮), ‘দ্য লাভ ট্র্যাপ’ (১৯২৯)। ‘টু নাইট অ্যাট টুয়েলভ’ (১৯২৯) ছিল তাঁর অভিনীত শেষ ছবি। নানা ধরনের চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন মূলত পার্শ্বচরিত্রে। কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। তবে তিনি যে হলিউডের নির্বাক চলচ্চিত্রের অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। তাঁর হাঁটাচলা, চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। নর্ম্যান প্রিচার্ডের স্ত্রী ছিলেন ওয়ান্ডা। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অম্লমধুর।
অন্যতম সেরা অলিম্পিয়ান
নর্ম্যান প্রিচার্ডের যখন অভিনয় জীবন দারুণভাবে উপভোগ করছেন, ঠিক সেই সময়ে, ১৯২৯ সালের ৩০ অক্টোবর, তিনি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে লস অ্যাঞ্জেলেসে দীর্ঘস্থায়ী মস্তিষ্কের রোগের কারণে মারা যান। তাঁর অকালমৃত্যু সত্ত্বেও, ভারতের অন্যতম সেরা অলিম্পিয়ান হিসেবে আজও তাঁকে স্মরণ করা হয়। মৃত্যুর পর থেকেই প্রিচার্ডকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারণ ভারত এবং ব্রিটেন উভয়ই দাবি করেন যে, তিনি ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। উভয় পক্ষই বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি উপস্থাপন করে। যদিও এই ক্ষেত্রে ভারতের পাল্লা ভারী। ট্র্যাকে তাঁর অসাধারণ সাফল্য এবং সিনেমা জগতে তাঁর অগ্রণী মনোভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্রীড়াবিদ এবং শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করে আসছে। আগামী কাল তাঁর জন্মদিন। এবার জন্মসার্ধশতবর্ষ। তাঁকে নিয়ে আরও বেশি চর্চার প্রয়োজন।