স্মরণে সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়

জনপ্রিয়ধারার লেখক। বেশকিছু কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা। পেয়েছেন পাঠক-সমাদর। তাঁর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমা-সিরিয়াল-টেলিফিল্ম। আশা-হতাশা, চাহিদা-বঞ্চনা, ভালবাসা-বিরহ তাঁর সাহিত্যে শক্তিশালী ভাবে উঠে এসেছে। অথচ নিজে পার্থিব জগৎ নিয়ে ছিলেন উদাসীন। তিনি সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়। ১৯ জুন, চিরবিদায় নিলেন। তাঁকে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

চাহিদার লেখক
নদীর মতো ছিলেন। একলা পাখির মতো। কোনও বাধা আটকে রাখতে পারত না। মন ছিল মুক্ত। স্বাধীন। তাই পরতে চাননি বেড়ি। সেই কারণেই হয়তো বাঁধা চাকরির প্রতি ছিল অনীহা। লেখালিখিই বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। যদিও কিছুদিন দুটি সংবাদপত্রের বিনোদন বিভাগের গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। সযত্নে প্রকাশ করেছেন নিজেকে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই। শক্তিমান এবং সৎ লেখক ছিলেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস সহজেই ছুঁয়ে যেত পাঠকের মন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন। ফলে তাঁর গল্প সহজেই চিত্রনাট্যের রূপ নিতে পারত। আর সেই কারণেই সিনেমা ও টেলিফিল্ম নির্মাতাদের কাছে হতে পেরেছিলেন চাহিদার লেখক। তিনি সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়। বহু কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা।


ইছামতীর পাড়ে
জন্ম ১৯৩৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, অবিভক্ত বাংলার ঢাকার বিক্রমপুরে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা গ্রাম। পদ্মার শাখা নদী ইছামতীর পাড়ে। সেটা ছিল এমন একটা চিরসবুজ গ্রাম, যেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বাস করত। সবাই সবার সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসত। গ্রামটিতে ছিল কয়েকশো টিনের চালের বাড়ি, কিছু পাকা দালান-কোঠা। চারশো পরিবারের প্রায় তিন হাজার মানুষ থাকতেন। ছিল পোস্ট অফিস, প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় আর মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়। চল্লিশের দশকেই সেই গ্রামে একটা বিশাল লাইব্রেরি ছিল, যেখানে ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি বই ও পত্র-পত্রিকা। সর্বসাধারণের পাঠের জন্য উন্মুক্ত। সবাই সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তেন। গ্রামটি দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল প্রফুল্ল রায়ের মনে। তিনি সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতেন। মনে তুলে রাখতেন।
বাল্যকালে কয়েকজন অসাধারণ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেশ চক্রবর্তী এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন আশু দত্ত। দু’জনেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও স্নেহপ্রবণ। শৈশবে এই শিক্ষকরাই গড়ে দিয়েছিলেন প্রফুল্ল রায়ের ভিত।

আরও পড়ুন-শিলিগুড়ির নাগরিকদের আর জল নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না, জানালেন মেয়র

ঘুরে বেড়াতেন প্রত্যন্ত এলাকায়
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন স্বাধীন ভারতে। দেশভাগ চাক্ষুষ করেছেন। সেই যন্ত্রণা তাঁকে কোনওদিনই ছাড়েনি। এপার বাংলায় এসে নতুন করে লড়াই শুরু করেন। বাউলের মতো ছিলেন। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতেন না। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। মানুষের সংগ্রামকে খুব কাছ থেকে দেখার খিদে প্রফুল্ল রায়কে তাড়া করে বেরিয়েছে আজীবন। সংগ্রামের সেই আঁচ অনুভব করতে থেকেছেন নাগাল্যান্ডের আদিবাসী গ্রামে। বিহারের অস্পৃশ্যদের হাহাকারে ফেলেছেন চোখের জল। আন্দামানের স্থানীয়দের দুর্দশা বিচলিত করে তুলেছিল।


লিখেছিলেন ছদ্মনামে
১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পূর্ব পার্বতী’। ১৯৮৯ সালে ‘অমৃত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘কেয়াপাতার নৌকো’। স্বনামে নয়, তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন ছদ্মনামে। প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ আকারে এবং নামে আলাদা হলেও, আসলে তিনটি উপন্যাস মিলেই একটি ট্রিলজি। বইগুলো পেয়েছিল পাঠক-সমাদর। পূর্ববঙ্গের ছবি তাঁর লেখায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠত। তিনি ভুলতে পারেননি ফেলে আসা গ্রাম, অতীত-জীবন।
বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় পত্রিকায় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস একটা সময় রীতিমতো সাড়া ফেলেছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের পাশাপাশি বিহারের জনজীবনও ধরা পড়েছে তাঁর নানা লেখায়। তাঁর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘বাঘ বন্দি খেলা’, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘একান্ত আপন’। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তৈরি হয়েছে ‘চরাচর’, ‘টার্গেট’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘ক্রান্তিকাল’, ‘পিতৃভূমি’ প্রভৃতি সিনেমা-সিরিয়াল-টেলিফিল্ম। টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘কেয়াপাতার নৌকো’ তৈরি হয়েছে তাঁরই লেখা গল্প থেকে। মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর লেখা বিশেষভাবে পছন্দ করতেন।
সহজ সরল জীবন
আশা-হতাশা, চাহিদা-বঞ্চনা, ভালবাসা-বিরহ প্রফুল্ল রায়ের সাহিত্যে শক্তিশালী ভাবে উঠে এসেছে। অথচ নিজে পার্থিব জগৎ নিয়ে ছিলেন অনেকটাই উদাসীন। জীবন ছিল সহজ সরল। কোনওদিন ডিম, মুরগি, মাংস মুখে তোলেননি। আমিষ বলতে কেবলই মাছ। বাড়িতে থাকলে লুঙ্গি-ফতুয়া পরতেন। শীতকালে গায়ে দিতেন ভারী চাদর। বাড়ির বাইরে বেরোলে পরতেন সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি-চপ্পল। কোথাও আড়ম্বর, বাহুল্য, লোকদেখানো ব্যাপার ছিল না। সারাদিন কাটাতেন বইয়ের বিশাল সাম্রাজ্যে। পড়তেন, লিখতেন। স্ত্রী-বিয়োগের পর ভীষণরকম একা হয়ে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-কিয়ান ফিরছেন মোহনবাগানে

যোগ্য উত্তরসূরি
জীবনে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ‘আকাশের নীচে মানুষ’ গ্রন্থের জন্য পান ‘বঙ্কিম পুরস্কার’। একই বইয়ের জন্য পেয়েছেন ‘রামকুমার ভুয়ালকা পুরস্কার’ পান। ২০০৩ সালে ‘ক্রান্তিকাল’-এর জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এছাড়াও আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড-এর ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কারও পেয়েছেন। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ডায়াবেটিস ও স্নায়ুর সমস্যা ছিল। প্রায় তিনমাস ভর্তি ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিংহোমে। সেখানেই ১৯ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রফুল্ল রায়। বয়স হয়েছিল প্রায় ৯১ বছর। তিনি ছিলেন মূলত সাহিত্যের জনপ্রিয়ধারার লেখক। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, বিমল কর প্রমুখের যোগ্য উত্তরসূরি। তাঁর নানা বিষয়ের গল্প-উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। থেকে যাবে পাঠকের মনে। অনন্তকাল।

Latest article