সম্প্রতি ‘কেশরী টু’ সিনেমা নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিতর্কের বিষয় নিয়ে আপনারা সবাই কমবেশি অবগত সে বিষয়ে পরে আসছি। প্রথমত বলে রাখি কেশরী ২ সিনেমাটি এপ্রিল মাসে আগেই রিলিজ হয়েছিল সিনেমা হলে। এটি একটি নাকি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি (জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে)। তবে সিনেমাটি কবে হলে এসেছিল এবং কবে হল থেকে চলে গেছে আমরা কেউ জানি না। এখন সিনেমাটি একটি ওটিটিতে আসায় কিছু কিছু মানুষ দেখে এবং একটি দৃশ্যে আমাদের বাঙালি বীর দেশপ্রেমিক ক্ষুদিরাম বসু এবং বারীন ঘোষের নাম পরিবর্তন নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়।
সিনেমাটা আমি দেখিনি দেখার ইচ্ছা নেই তবে যেই দৃশ্যটি নিয়ে বিতর্ক এই দৃশ্যটি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে চোখে পড়েছে। একটি কোর্টরুম দৃশ্য যেখানে নায়ক অক্ষয়কুমার উকিল হিসেবে কৃপাল সিং নামে কাউকে প্রশ্ন করছেন যে তিনি শিক্ষক হিসাবে মুজাফফরপুর বোমাকাণ্ডে অভিযুক্ত ‘ক্ষুদিরাম সিং’ এবং ‘বারীন্দার কুমার’কে বোম মারার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
এবার আমরা সবাই জানি ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose) এবং প্রফুল্ল চাকী মিলে কিংসফোর্ডের গাড়িতে বোমা মেরেছিলেন। এবং ক্ষুদিরাম বসুকে যে বোমা মারার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তার নাম কখনই পাঞ্জাবের কৃপাল সিং নয় হেমচন্দ্র কানুনগো। আর শুরুর দিকে ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) মেনটর ছিলেন সত্যেন বোস।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে জানতে গেলে আপনাকে আলিপুর বোমা মামলা জানতে হবে। মুরারিপুকুর এলাকা, যেখানে শৈশবকাল থেকে আজও অবধি আমি বাস করছি এখানের একটি ঠিকানা জুড়ে রয়েছে আলিপুর বোমা মামলা (১৯০৮-০৯) মতো ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সঙ্গে। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮, ক্ষুদিরাম বসুর নেতৃত্বে মুজাফফরপুর বোমা হামলার ঘটনার পরে ২ মে ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি তল্লাশি করে পুলিশ বোমার কারখানা আবিষ্কার করে। সেখান থেকে ১৪ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে মামলা শুরু হয় ২১ মে ১৯০৮ তারিখে। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়। আজও এই ঠিকানা বহন করে যাচ্ছে সেই ঐতিহাসিক সময়কে, আজ এ-স্থান আমাদের কাছে পরিচিত ‘বোমার মাঠ’ হিসাবে। এগুলো নিয়ে ইতিহাসে বিস্তারিত লেখা আছে। এছাড়াও খুব সম্প্রতি ব্রাত্য বসুর অসাধারণ ‘বোমা’ নাটকটি না দেখে থাকলে ইউটিউবে আছে চাইলেই দেখে নেওয়া যায়।
আরও পড়ুন-মধ্যপ্রাচ্যে সপ্তমে সংঘাত, ইজরায়েল-ইরানের যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ল ট্রাম্পের আমেরিকা
এবার আসি কৃপাল সিং প্রসঙ্গে, ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে যে দুটি জাতির সব চাইতে বেশি অবদান তাঁরা হলেন বাঙালি ও পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবের স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃপাল সিংকে খুঁজলে আপনি পাবেন ব্রিটিশের সৈন্যবাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে।
বাঙালি বীর বিপ্লবী রাসবিহারী বসু যখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই সময় তিনি ঘাদর পার্টির সাথে মিলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে যে-সমস্ত ভারতীয় ছিলেন তাদের মধ্যে বিদ্রোহের দানা বাঁধানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
এদের এই পরিকল্পনা ব্রিটিশদের কাছে যে ফাঁস করে দিয়েছিলেন তার অন্যতম নাম কৃপাল সিং। এবার একবার ভাবুন এই কৃপাল সিং এর কাছে নাকি ক্ষুদিরাম বসু বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন!
তাহলে প্রশ্ন হল বলিউডের এই ধরনের ইতিহাস-নির্ভর সিনেমায় বারবার কেন ইতিহাসকে বিকৃত করে দেখানো হচ্ছে।
এমন নির্মাণ কোনও বিচ্ছিন্ন নয় বরং ধারাবাহিকভাবেই গোয়েবলসীয় কায়দায় চলচ্চিত্রের মতো জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী মাধ্যমকে ব্যবহৃত করে আপন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হচ্ছে। ইতিহাসের নামে বিকৃতি বা ধর্মীয় সুড়সুড়ির উদ্দেশ্যে কাশ্মীর ফাইলস’, ‘দ্যা কেরালা স্টোরি’, ‘বেঙ্গল ফাইলস’- এর মতো ছবিতে কখনও সীমাহীন মিথ্যাচার, কখনও অর্ধসত্য অথবা সত্যের বিকৃতিকে প্রদর্শিত করা হয়েছে ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষকে ব্যবহার করে দেশের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। সাভারকার যে কিনা ‘ব্রিটিশের আজ্ঞাবহ দাস’ হওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বারংবার আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে গেছেন, যে কিনা আপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ২য় পর্যায় (১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে রত্নগিরি কারাগার থেকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তিপ্রাপ্তির পর) অতিবাহিত করেছেন দেশের স্বাধীনতায় নয়, ‘হিন্দুত্ব’-এর ব্যাখ্যা, প্রচারে এবং ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে আদর্শস্থানীয় করে প্রচার করাও হয়েছে চলচ্চিত্রকে মাধ্যম করে। ১৯৩৫ সালে একটা ছবি বার্লিনের চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহগুলিতে মুক্তিপ্রাপ্ত যে ছবি আজও সভ্য সমাজে নিন্দিত ও ধিক্কৃত ‘ট্রাম্ফ ওফ দ্য উইল’-এ যেমন কেবলই জার্মান নাৎসি পার্টি তথা অ্যাডলফ হিটলারের গুণকীর্তন তেমনই এমন চলচ্চিত্র নমুনা সেই ফ্যাসিস্ট মনোভাবেরই যোগ্য উত্তরাধিকার রূপে বহন করে চলেছে।
ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যের পাঠ্যপুস্তকে আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনার উল্লেখ খুব কম পাবেন। তাহলে যদি সিনেমার মাধ্যমে যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে যদি ক্ষুদিরাম বসুকে (Khudiram Bose) ক্ষুদিরাম সিং বলে দেখালে বা বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বারীন কুমার বলে দেখালে বাঙালি জাতির গর্বকে লুকিয়ে রেখে এই চাড্ডি জাতি যাদের কাছে জনক হল মুচলেকা দেওয়া সাভারকার তাদের বীরত্বকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা যায়। আর ত্রিপাল সিং-এর মতো বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহীদের দেশপ্রেমিক হিসেবেও দেখানো যায়। ইতিহাস কেবলমাত্র ছেঁড়া পাতার জীর্ণ অধ্যায় নয়; তার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকে একটি দেশ, সেই দেশের আত্মা, স্বরূপ, কতটা আত্মক্ষয় অথবা আত্মনির্মাণের ভিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার বর্তমান— এই সমস্তটাই। ইতিহাসের সত্যের এই শক্তিকেই তাই পঙ্গু করতে বিজেপি নেমেছে এমন বিকৃত সত্যের কাল্পনিক ইতিহাসনামা রচনায়।