বিভাজনের রাজনীতি বাংলায় খাটছে না

বিগত বামফ্রন্ট সরকার উত্তরবঙ্গকে ছাগলের তৃতীয় সন্তানের চোখেই দেখত, যার ফলে ধীরে ধীরে সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। সেসব অতীত এখন। লিখছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

উত্তরবঙ্গ নামটা শুনলেই যেন মন-প্রাণ শীতল হয়ে যায়। একদিকে ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ চা-বাগান তো অন্যদিকে সীমাহীন জঙ্গলের রহস্যময় উপস্থিতি, একদিকে খরাস্রোতা নদীর প্রবাহ তো অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তার, সবটাই যেন প্রকৃতি তার নিজ হাতে সাজিয়েছে। উত্তরবঙ্গের নামটা শুনলে সর্বপ্রথম যে নামটা মনে আসে সেটা হল দার্জিলিং।
সলিল, দিগন্ত বিস্তৃত মনোরম দৃশ্যের শোভা যেন বাংলা শুধু নয়, সমগ্র পৃথিবীর পর্যটককুলকে হাতছানি দেয় তার শোভা উপভোগ করার জন্য। অথচ একটা সময় এই দার্জিলিংয়ের পরিস্থিতি এতটাই অবনমিত হয়েছিল যে পর্যটক তো দূর অস্ত, সাধারণ স্থানীয় মানুষজনের কাছেও তা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক দল এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা ছিল। তবে প্রেক্ষাপট-টা সাজানো হয়তো এতটাও সহজ ছিল না, কারণ প্রতিপক্ষ ছিলেন মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ৩৪ বছরে জগদ্দল পাথরকে নিজের দৃঢ় সংকল্পে গদিচ্যুত করেছিলেন। আসলে দীর্ঘদিন ধরে যদি কোনও অঞ্চল উপেক্ষিত থাকে তবে সেখানকার স্থানীয় মানুষজনকে বিপথে চালনা করা খুব সহজ হয়ে ওঠে। যার ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিল কিছু রাজনৈতিক দল।

আরও পড়ুন-লিডসে রাহুল-পন্থ যুগলবন্দি, শেষবেলায় লড়াইয়ে ফিরল ইংল্যান্ডও

বিগত বামফ্রন্ট সরকার উত্তরবঙ্গকে ছাগলের তৃতীয় সন্তানের চোখেই দেখত, যার ফলে ধীরে ধীরে সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। একদিকে গোর্খাল্যান্ড তো অন্যদিকে কামতাপুর রাজ্যের দাবি, যার ফলে রাজনৈতিক হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল ডুয়ার্স থেকে পাহাড়জুড়ে এবং ক্ষমতার বিভাজনে পাহাড় হয়ে উঠেছিল অশান্ত। বন্‌ধের মতো পরিস্থিতিতে পাহাড়ের পর্যটন ব্যবসাও প্রায় লাটে উঠে গেছিল। তবে কথায় আছে সময়ের জাঁতাকলে অনেক সমস্যার সমাধান আপনা-আপনি হয়ে যায় আবার কিছু সমস্যার সমাধান ক্রমাগত আলোচনা ও গুরুত্বের উপর নির্ভর করে সমাধিত হয়। মাননীয়া সেই গুরুত্ব বুঝতে পেরে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করেছিলেন।
এত কিছু পুরনো কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গের হাল-হকিকত অনেকটা বাড়ির সাজানো বাগানের মতো। আসলে কোনও এলাকার উন্নয়ন অনেকটা নির্ভর করে সেখানকার মানুষের কর্মসংস্থান ও স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের উপর। আর এই স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন সমানভাবে বর্তায় নারী-পুরুষের সম উন্নয়নের ওপর। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে আগাগোড়াই অর্থনীতির মাপকাঠি নির্ভর করে সেখানকার চা-বাগান ও পর্যটনের ওপর। দীর্ঘদিন বেহাল চা-বাগানের পরিকাঠামো। এছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বেহাল দশায় উত্তরবঙ্গে সংখ্যাধিক্য জনসংখ্যার মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় বদলে দিয়েছে। পর্যটক বা অনান্য মানুষজনের সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফরে উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো নিজ চোখে চাক্ষুষ করেছেন। যেমন বলি পূর্বের অভিজ্ঞতায় সেখানকার মহিলাদের উপার্জনের প্রধান রাস্তা ছিল চা-বাগানের কাজ ও কিছুটা পর্যটন। পর্যটকদের আনাগোনার ওপর কর্মসংস্থান অনেকটা নির্ভর করত।

আরও পড়ুন-ইংল্যান্ডে প্রয়াত বাংলার দোশি

একটা সময় স্থানীয় ছেলেমেয়েরা হোটেলে কাজকর্ম করে অথবা পর্যটকদের গাড়ি চালিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। তবে বর্তমান সময়ে এই চালচিত্রটার অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি নানান প্রকল্পের উন্নয়নের জাদুকাঠিতে তাদের জীবনযাত্রার যে এতটা পরিবর্তন সম্ভব তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের নানান হোটেলে যে শিশুশ্রম দেখা যেত তা একেবারে হাপিস। দার্জিলিং শুধু নয়, উত্তরবঙ্গ জুড়ে চোখ রাখলে দেখা যায় একদল কচিকাঁচা স্কুলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে সরকারি সহায়তায়, এক কথায় ফ্রিতে পঠন-পাঠন ও তার সঙ্গে মিড-ডে-মিল যেন তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা, যারা সমাজের মেরুদণ্ড, তাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরিমুখী নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর্মসংস্থানের আশা অনেকটা উন্নত করেছে। চা-বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের শুধু মজুরি বৃদ্ধি হয়নি, বরং চা-শিল্পে উত্তরবঙ্গের ২৮৫টি নথিভুক্ত বাগানে আনুমানিক ২.৭১ লক্ষ শ্রমিককে ১৬ শতাংশ হারে ২৩১.৮৬ কোটি টাকা বোনাস প্রদান করা হয়েছে, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। শ্রম দফতরের অধীনে টি ডিরেক্টরেট আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় সদ্যস্থাপিত ২০টির মধ্যে ১৮টি ক্রেশ চালু করেছে। এর ফলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে প্রত্যেক ক্রেশে ১০ জন সদস্যের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ইতিমধ্যেই।
দার্জিলিং জেলার মুখ্য কিছু প্রকল্প যেমন, বিভিন্ন ব্লক-এ রাস্তা তৈরি, এলইডি স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা, কমিউনিটি হল নির্মাণ, নকশালবাড়ি হাটে পুরনো হাটশেডের উন্নতিকরণ, সেবক রোডে শিক্ষা ভবন নির্মাণ এবং শিলিগুড়িতে হাইড্রেন নির্মাণের ফলে উত্তরবঙ্গের মানচিত্র জুড়ে উন্নয়নের এক নতুন দিশা দেখা দিয়েছে। এমনকী কালিম্পং- ১ ব্লকের অধীনে কমিউনিটি হল নির্মাণ এবং জয় হিন্দ কমিউনিটি হল নির্মাণকাজগুলো পরিকাঠামো ও উন্নয়নের শামিল বলেই মনে করেন স্থানীয় মানুষজন।

আরও পড়ুন-রেকর্ড জয়, মার্জিন বেড়ে ৫০,০৪৯, ভোট বাড়ল তৃণমূলের, কালীগঞ্জে সবুজ ঝড়

২০২৩-২৪’এ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকের সংখ্যা ছিল ১.৯৮ কোটি, তা ২০২৪-২৫’এ বেড়ে হয়েছে ২.২১ কোটি এবং এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ফলে পাহাড়ের মহিলারা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। পাহাড়ি জনজাতিদের মধ্যে অল্প বয়সে বিবাহ এবং স্কুলছুটের সংখ্যা অনেকটাই বেশি ছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের ছোঁয়ায় যুবতী মেয়েরা যেন এক আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এখন পাহাড়জুড়ে যুবতীরা স্কুলমুখী হয়েছে। বিশেষ করে নানান সরকারি সহায়তায় মহিলারা নিজে উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে যেমন হস্তশিল্প হোক বা ছোটখাটো খাবারের দোকান— যা উত্তরবঙ্গ জুড়ে অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। একটা সময় মহিলারা নানান জিনিসপত্র টেনে নিয়ে সমতল থেকে পাহাড়ে উঠত। এখন সেই দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না কারণ উন্নত রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুন উত্তরবঙ্গে জুড়ে এক উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলছে, ফলত বিরোধীদের বিভাজনের রাজনীতি যেন আর হালে পানি পাচ্ছে না। রাজ্য সরকার যে শুধু উন্নত পরিকাঠামোর দিকে নজর দিয়েছে তা কিন্তু নয়, পাহাড়ি সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে আনার জন্য নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রাজ্যের পার্বত্য ও অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করার জন্য বিভিন্ন উপজাতি উন্নয়ন ও সংস্কৃতি পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে বিরোধীরা যে ভাগাভাগির রাজনীতিতে ভোটের অঙ্ক হিসাব করত তা উন্নয়নের ছোঁয়ায় যেন পুরোটাই বিরোধী মস্তিষ্ক থেকে বিলুপ্তির পথে।

Latest article