শ্বেতি সংক্রামক নয়

যে-কোনও ত্বকের রোগ আমাদের শরীরে, মনে প্রভাব ফেলে কারণ নিজেকে কুৎসিত দেখতে কেউ চান না। যেমন শ্বেতি বা ভিটিলিগো। এই চর্মরোগটি সম্পর্কে অনেক ভয় এবং ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সাধারণের মনে। সেই ভ্রান্তি কাটিয়ে, রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২৫ জুন বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ভিটিলিগো ডে’ বা ‘বিশ্ব শ্বেতি দিবস’। শ্বেতি কী? কেন হয়? চিকিৎসাই বা কী? এই নিয়ে লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

শ্বেতি সম্পর্কিত ভুল ধারণা
শ্বেতি ছোঁয়াচে
একেবারেই না। শ্বেতি শুনলেই মনে একটা ভয় কাজ করে সবার। শ্বেতি হয়েছে যাঁর তাঁর ধারপাশ ঘেঁষেন না কেউ। তাঁর খাওয়ার বাসনকোসন থেকে বা পরনের জামাকাপড়— সবটাই অচ্ছুত মনে করেন সবাই। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে শ্বেতি ছোঁয়াচে নয়। এটা একধরনের অসংক্রামক চর্মরোগ, যা শরীরের ত্বকের মেলানোসাইট কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে হয়।
শ্বেতি মারণরোগ
শ্বেতি মারণরোগ নয়। শ্বেতি হলে তা ছড়িয়ে পড়ে ঠিকই কিন্তু ঠিক সময় চিকিৎসা করলে সেরে যায়।
পরিচ্ছন্নতার অভাবে শ্বেতি হয়
শ্বেতির সঙ্গে পরিচ্ছন্ন থাকা বা না-থাকার কোনও সম্পর্ক নেই। এটি একটি ‘অটোইমিউন ডিজ়অর্ডার’। কাজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও আপনার শ্বেতি হতেই পারে।
গায়ের রং গাঢ় হলে শ্বেতি হয়
যাঁদের চামড়ার রং বেশি গাঢ়, তাঁদেরই শ্বেতি হয়— এমন ধারণাও ভুল। গায়ের রং খুব ফর্সা হলেও কিন্তু শ্বেতি হতে পারে। গায়ের রঙের সঙ্গে এই রোগের কোনও সম্পর্ক নেই।
ইউভি রশ্মির প্রভাবে শ্বেতি হয়
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে শ্বেতি হয় না। ইউভি রশ্মি ত্বকের ক্ষতি করতে পারে, তবে শ্বেতি কখনও নয়। শ্বেতি হবার অন্য অনেক কারণ রয়েছে।
ত্বকে সাদা দাগ মানেই শ্বেতি নয়
স্কিনে সাদা দাগ মানেই শ্বেতি— এমনটা নয়। অনেকের সূর্যের আলোর কারণে ত্বকে সাদা দাগ পড়ে। আবার লিভারের সমস্যাতেও সাদা দাগ হয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া জরুরি।
শ্বেতির কোনও চিকিৎসা নেই
শ্বেতির অত্যাধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধ ও অস্ত্রোপচার— দু’ভাবেই এ-রোগের চিকিৎসা হতে পারে। আর তাতে শ্বেতি সেরে যায়।

আরও পড়ুন-ভারী বৃষ্টির পুর্বাভাসে সতর্কতায় জল ছাড়ল মুকুটমণিপুর জলাধার

ভিটিলিগো বা শ্বেতি কী
ভিটিলিগো বা শ্বেতি আসলে এক ধরনের চর্মরোগ। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম কেমিক্যাল লিউকোডার্মা। ত্বকের মেলানোসাইট কোষে থাকা মেলানিন আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক রঙের ভারসাম্য রক্ষা করে। মেলানিন মানবদেহে রঙ তৈরি করে। কোনও কারণে এই মেলানিনের ভারসাম্য নষ্ট হলে শ্বেতি হয়। তখন ত্বকের এক বা একাধিক অংশে ছোট সাদা দাগ দেখা যায়। এটা শুধু মুখেই নয়, শরীরের যেকোনও অংশে এমনকী চুলেও দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে ছোট সাদা দাগ থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বড় সাদা দাগে পরিণত হয়।
কেন হয় ভিটিলিগো বা শ্বেতি
সাধারণত কোনও অটোইমিউন রোগ থেকে হতে পারে শ্বেতি।
পারিবারিক কোনও ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ বংশগতও হয় এই চর্মরোগ।
প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থেকেও হতে পারে।
কেমিকেলযুক্ত প্রসাধনীর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে, আলতা, সিঁদুরে থাকা রাসায়নিকের প্রভাবে অথবা সস্তার প্লাস্টিকের চটি দীর্ঘ দিন পরলে অনেকের ত্বকে সাদা দাগ হতে দেখা যায়।
অনেক দিন ধরে জোরে বেল্ট বেঁধে পোশাক পরলেও কোমরে এক ধরনের সাদা দাগ হয়।
শ্বেতি বা ভিটিলিগোর ধরন
শ্বেতি বা ভিটিলিগোর সাধারণত দুটো ধরন হয় সেগমেন্টাল এবং নন-সেগমেন্টাল। সেগমেন্টাল ভিটিলিগো বা শ্বেতির ক্ষেত্রে সাদা দাগ শরীরের একটি নির্দিষ্ট অংশে অথবা শরীরের একপাশে সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন— একটি হাত বা পায়ে হতে পারে।
নন সেগমেন্টাল শ্বেতি শরীরের বিভিন্ন অংশে ধীরে ধীরে বা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যেমন হাত, পা, মুখ, যৌনাঙ্গ, ইত্যাদি স্থানে বেশি হয়।
অ্যাক্রাফেশিয়াল ভিটিলিগোর ক্ষেত্রে শুধু মুখ এবং হাতে, পা ও আঙুলে সাদা দাগ হয়।
মিক্সড ভিটিলিগো হলে রোগীর শরীরে সেগমেন্টাল এবং নন-সেগমেন্টাল দু-ধরনের শ্বেতিই দেখতে পাওয়া যায়।
জেনারেল ভিটিলিগো বা সাধারণ শ্বেতি শরীরের যে কোনও অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে ধীরে ধীরে।

আরও পড়ুন-টানা বৃষ্টিতে জলের তলায় সবজির খেত, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার বার্তা প্রধানের

চিকিৎসা
শ্বেতির থেকে মুক্তি চাইলে দেরি না করে দ্রুত ত্বক-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ছোট ছোট সাদা দাগ বা ছোট আকৃতির শ্বেতি অল্প পরিসরে হলে স্টেরয়েড যুক্ত মলমেই সেরে যায়। না সারলে তখন বিভিন্ন ওষুধ রয়েছে যা খুব কার্যকর। তবে যদি শ্বেতি বেশি ছড়িয়ে থাকে সারতে অনেকটা সময় নেয়। ওষুধ বা মলমে কাজ না হলে তখন অস্ত্রোপচারই একমাত্র পথ। এক্ষেত্রে চিকিৎসক শ্বেতি-রোগীকে একবছর ধরে ফলো-আপে রাখেন। যদি দেখা যায় তাঁর শ্বেতি একবছর ধরে একই জায়গায় আছে, ছড়িয়ে পড়েনি তাহলে পাঞ্চ গ্রাফটিং করা হয়। এটাকে মেলানোসাইট ট্রান্সপ্লান্টেশনও বলা হয়। ত্বকের স্বাভাবিক অংশ থেকে মেলানোসাইট নিয়ে সাদা অংশে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, ক্রমশ ত্বক পুরনো রূপ ফিরে পায়।
এ ছাড়া আল্ট্রাভায়োলেট লাইট বা লেজার পদ্ধতিতে স্বাভাবিক রং ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।
শ্বেতির চিকিৎসায় অতি-বেগুনি রশ্মি দিয়ে ফোটোথেরাপি ব্যবহার করা হয় অনেক সময়। এই অতি-বেগুনি রশ্মি খুব জোরালো। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ন্যারো ব্যান্ড অতি-বেগুনি রশ্মি। এর কোনও ক্ষতিকর দিক নেই।
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘মাইক্রো পিগমেন্টেশন’, ‘স্কিন গ্রাফটিং’ (চামড়া কেটে বসানো) বা ‘ব্লিস্টার গ্রাফটিং-এর মতো পদ্ধতির সাহায্যে সাদা ত্বককে আবার স্বাভাবিক করে তোলা যায়।

Latest article