গৃহপ্রবেশ

শুভ সূচনা হল পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ছবি ‘গৃহপ্রবেশ’-এর। ঋতুপর্ণ ঘোষকে উৎসর্গ করে ছবির গল্প বুনেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই ছবির আয় কোটির ঘরে। মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জিতু কামাল, সোহিনী সেনগুপ্ত প্রমুখ। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

মুক্তির পর থেকেই দর্শকদের মনে ভরাট জায়গা করে নিয়েছে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত পরিচালিত ছবি ‘গৃহপ্রবেশ’। সদ্য টিম ‘গৃহপ্রবেশ’-এর (Grihapravesh) তরফ থেকে জানা গেছে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জিতু কামাল, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সোহিনী সেনগুপ্ত অভিনীত এই ছবি নাকি দ্বিতীয় সপ্তাহ যেতে না যেতেই কোটির ঘরে পা রেখে ফেলেছে। কোটির ক্লাবে বাংলা ছবি!
এত অল্প দিনে দর্শকদের কেন এত পছন্দের ছবি হয়ে উঠল ‘গৃহপ্রবেশ’ (Grihapravesh)। আসলে এ এক অন্য প্রেমের গল্প হয়তো সেই কারণে। প্রেম, অপ্রেম, কষ্ট, অপ্রাপ্তির গল্প তো অনেক হয় কিন্তু এই ছবি সমপ্রেমের পরিচয়হীনতার, আবার প্রেমের জন্য অন্তহীন অপেক্ষার, এই ছবি হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের আসলে এই ছবি ফিরে আসার আকুলতার এক মর্মস্পর্শী চিত্র। সমলিঙ্গের প্রেম যে স্বাভাবিক, অপরাধ নয় কিন্তু সেটা গোপনে রেখে কোনও নিরাপরাধকে সেই বৃত্তে টেনে আনা যে অপরাধ সেটাও এই ছবির মূল উপজীব্য। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষকে তাঁর এই ছবি উৎসর্গ করেছেন। ২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিল ঋতুপর্ণের ‘তিতলি’। ইন্দ্রদীপের গল্পের নায়িকার নামও তিতলি। এই তিতলি পরিণত। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারে বিয়ে হয়েছে তাঁর। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী নিয়ে ভরভরন্ত সংসার। কিন্তু সেই সংসারে তিতলি একা। তাঁর সেই অন্তহীন একাকীত্বের কারণ স্বামী শাওন। যে বিয়ের পরদিন সেই যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আর ফেরেনি। কিন্তু কেন? শাওন সমকামী। যেটা তার পরিবার, বাবা-মা এবং নববিবাহিতা স্ত্রী কেউই জানে না। তিতলি অজান্তেই সেই ভয়ানক আগুনের বৃত্তে পা দিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে তীব্র দহন জ্বালায় পুড়ছে তার হৃদয়। বনেদি বাড়ির আটপৌরে জীবনে শুধুই রয়েছে মুখচোরা নিঃশব্দতা। অনেক না পাওয়ার মাঝে অবিরাম কাজ করে চলা পুত্রবধূ তিতলির প্রতি শাওনের মা-বাবা সহানুভূতিশীল। তিতলিও বৃদ্ধ শ্বশুর, অসুস্থ শাশুড়ির সেবাযত্নে কোনও ত্রুটি করে না। তারা তিতলির কষ্ট বুঝলেও তাদের ছেলের সংসার ত্যাগের কারণ জানে না। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির বিশারদ তিতলির শ্বশুর ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’ মেনে নিতে পারেন না। তাঁর মতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কিছুই ভাল হতে পারে না। অথচ তাঁর ঘরেই নিজের ছেলেই যে সমকামী সেই খবর তিনি রাখেন না। শাওনের হয়তো সেই কারণেই পছন্দ ছিল ঋতুপর্ণের ছবি। এমতাবস্থায় সেই বাড়ির হোমস্টেতে থাকতে আসে ডাক্তার মেঘদূত। মেঘদূত সত্যি এল মেঘেদের দূত হয়ে আর সঙ্গে বয়ে আনল প্রেমের চিঠি। বাড়িতে আসা অস্থায়ী অতিথি তিতলির মনের কোণে স্থায়ী হতে থাকে। কিন্তু কে এই মেঘদূত। কী বা তাঁর পরিচয়। তাঁর এ বাড়িতে আসা কি সত্যি কোনও কাকতালীয়? মেঘদূতের চোখেও যে লুকিয়ে আছে গভীর বিষাদ। ছবি জুড়ে ধূসর কালো মেঘ, সেই মেঘ সরবে ধীরে ধীরে। শেষটায় রয়েছে চমক। কী হবে সেটা জানতে হলে সিনেমা হল-এ যেতে হবে।

‘গৃহপ্রবেশ’-এ (Grihapravesh) তিতলি চরিত্রে শুরু থেকে শেষ শুভশ্রীকেই দেখতে হয়। শুভশ্রীর অভিব্যক্তি, মানসিক সংঘাত, নির্বাক যন্ত্রণা, প্রেমের আকুলতা, শরীরী ভাষা, মনের চাহিদা— সব কিছুর প্রকাশ যেন ভীষণ পারফেক্ট। সঙ্গে জিতু কামালের শান্ত স্থির, সংযত অথচ গভীর নির্বাক বিষাদময়তা সেই অভিব্যক্তিও নিখুঁত। শ্বশুর কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শাশুড়ী সোহিনী সেনগুপ্ত এতটা নিপাট, নিটোল, এতটাই বলিষ্ঠ অভিনয় যে আলাদা করে বলতে হয় না। তাঁদের দায়িত্ববোধ, কোথাও অনুশোচনাবোধ, নীরব সহানুভূতি— সবটাই খুব নিখুঁত। শাওনের চরিত্রে সুপ্রভ ঠাকুরকে হয়তো আরও একটু বাঙময় করা যেত, তা হলে ভাল হত। কারণ সবকিছু তাকে ঘিরেই, তাও তাঁর চরিত্র অনুযায়ী ঠিকঠাক উতরে গেছেন। রুদ্রনীল সেনগুপ্ত, স্নেহা চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। চরিত্র নির্বাচনে ইন্দ্রদীপ খুব পাকামাথার সেটা ছবি দেখলে বোঝা যায়। এই ছবি শুভশ্রীর, এই ছবি জিতুর, এই ছবি সোহিনীর, কৌশিক গাঙ্গুলির— তাঁদের খুব মানিয়েছে। ক্যামেরায় প্রতীপ মুখোপাধ্যায় খুব ভাল। সম্পাদনায় সুজয় দত্তরায়। কাহিনি, চিত্রনাট্য এবং সঙ্গীতে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। তাঁকে আলাদা করে বলার কিছু নেই। কাম, সমকাম, প্রেম, সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা সর্বোপরি একটা বড় সমস্যা যা আমাদের মতো অনেকের জীবনেই ঘটে, ঘটতে পারে, ঘটছে— সেই জায়গাটাকে ছুঁয়ে গেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। এখানেই তাঁর সার্থকতা। সমীরণ দাস নিবেদিত এই ছবির প্রযোজনায় ক্যালাডিস্কোপ।

আরও পড়ুন: ‘লেত’ উৎসবে শুরু রথযাত্রা, লোকসংস্কৃতিতে মাতবে মহিষাদল

Latest article