সৌরবান্ধবীরা

সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শান্ত, সাদামাঠা মহিলারা আজ স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। ডিজেলচালিত জ্বালানির কুপ্রভাব কমিয়ে সৌরশক্তিচালিত জ্বালানির ব্যবহার করে তাঁরা গড়ে তুলেছেন বিকল্প আয়ের উৎস। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ রুখতে গ্রহণ করেছেন অগ্রণী ভূমিকাও। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

‘সোলার সহেলি’ বা ‘সৌরবান্ধবী’দের মনে আছে? এটা তো একটা প্রকল্পের নাম ছিল। যেটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল কয়েকবছর আগে। অনাবশ্যক বিদ্যুতের খরচ কমাতে সৌর-আলোর ব্যবহার শুরু হয়েছিল মরুরাজ্য রাজস্থানে। সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলেছিল সৌর-আলো আর সেই সৌরবিদ্যুৎ প্রচার ও প্রসারের হাতিয়ার হয়েছিল নারীশক্তি। গ্রামের মহিলাদের হাত ধরেই রাজস্থানের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল সূর্যের আলো। সৌরশক্তি চালিত রান্নার উপকরণ থেকে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন মহিলারা। উদ্দেশ্য ছিল একদিকে সৌরশক্তির জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি অন্যদিকে মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন দিশা দেখানো। কিন্তু শুধু রাজস্থান নয়, সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই দেশের মহিলারা সময় সময় সমাজের নিরিখে গুরত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলারা সৌরশক্তির ব্যবহার এবং সহায়তার মাধ্যমে শুধু নিজের জীবিকা নির্বাহ করছেন এমন নয় অন্য মহিলাদেরও করে তুলছেন স্বাবলম্বী। তাঁরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছেন এক-একজন সৌরবান্ধবী।

আরও পড়ুন-অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স

মির্জাপুরের মিনু দেবী
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের শিখরের বাসিন্দা মিনু দেবী শিরোনামে তার কারণ ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিসের উর্জা মণ্ডল মডেল প্রকল্পের উদ্যোগ এবং সহায়তায় মিনু দেবী হয়েছেন একজন সফল উদ্যোগপতি। তিনি তাঁর ডিজেল চালিত আটা কলকে সৌরশক্তি চালিত আটার কলে বা ‘সোলার মিল’-এ রূপান্তরিত করেছেন। বছর ৩৬-এর নবীন উদ্যোগপতি মিনু দেবীর আদি বাসস্থান ছিল লখনউয়ে। কিন্তু লখনউ ছেড়ে মিনু দেবী এবং তাঁর পরিবার চলে আসেন মির্জাপুরের শিখরে এবং নতুন করে বসবাস শুরু করেন। এখানে আসার পর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে বেশ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন তিনি এবং তাঁর গোটা পরিবার। কারণ জীবিকা নির্বাহের তেমন পরিকাঠামো ছিল না এই গ্রামে, ছিল না কোনও শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা আর্থিক স্থিরতা, প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হত তাঁদের। ডিজেল চালিত আটাকলের আয় থেকে কিছুতেই সাচ্ছল্যের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু সৌরশক্তিচালিত আটাকল চালু করার পর থেকে মিনু দেবীর সেই কল পরিচালনের খরচ প্রায় ৭০% কমেছে এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০%। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়েছে ক্রমাগত ডিজেলের ধোঁয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকা পরিবেশ এবং বায়ুদূষণ। এর পরবর্তীতে মিনু দেবী তাঁর ব্যবসার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে উর্জা মণ্ডল প্রকল্পের সহায়তায় সৌরশক্তি সম্বলিত স্টিচিং বা সেলাইয়ের একটা ইউনিট শুরু করেন। তাঁর এই স্টিচিং ইউনিট খোলার উদ্দেশ্য ছিল এলাকার মহিলাদের এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করা যাতে প্রত্যন্ত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় মহিলাদের ঘরকন্নার বাইরে একটি স্থায়ী আয়ের উৎস তৈরি হয়। তাঁদের প্রশিক্ষত করে এমনভাবে কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে যাতে পরবর্তীতে তাঁরা নিজেরাও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। উর্জা মণ্ডলের অধীনে তিনি এবং তাঁর নির্বাচিত মহিলা দল মিলে শুরু করেন সবুজ উদ্যোগ অর্থাৎ অর্থনীতি উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ, জল ও বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখার অভিযান। ফলে তাঁদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার উদ্যোগে একইসঙ্গে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাওয়া প্রবেশ করল সেইসঙ্গে পরিবেশ বা আবহাওয়ার দূষণ রোধ হল, পরিবেশ হল সুরক্ষিত। কারণ এই পরিবেশেই যে তাঁদের সন্তানসন্ততিরা বেড়ে উঠবে। এখানে তারা কাটাবে আগামী।

আরও পড়ুন-কে বলল জগন্নাথ কেবল পুরীরই, কে বলল দিঘার প্রসাদ মহাপ্রসাদ নয়

গুনিয়ার বিরসুনি
এরপরেই বলতে হয় ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মহিলাদের কথা। ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলা হল সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানকার ৬৯% বাসিন্দা হল আদিবাসী সম্প্রদায়। গুমলার গুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা বিরসুনি ওরাওঁ পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আদিবাসী মহিলা। কয়েকমাস আগেও বিরসুনি এবং তাঁর গ্রামের বেশিরভাগ মহিলার মূল জীবিকা ছিল কৃষি। ঘরকন্না সামলে কৃষিকাজে স্বামীকে সাহায্য করতে লেগে পড়তেন। কিন্তু এখন সৌরশক্তিচালিত জ্বালানির সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ চালু করেছেন তাঁরা। গুমলা জেলায় প্রত্যন্ত গ্রামে বসেছে সৌর মিনি গ্রিড যা গোটা গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বিরসুনি এবং ন’জন মহিলা মিলে সেই গ্রিডের সাহায্যে ভোজ্যতেল উৎপাদনের সৌরচালিত প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। একটি স্ব-সহায়ক গোষ্ঠী তৈরি করেন। সেই গোষ্ঠীর অন্তর্গত মহিলারা মিলে একটি সরষে প্রক্রিয়াকরণ মেশিনের স্থাপন করেন যা সম্পূর্ণ সৌরশক্তিতে চলে। রোজ সকাল দশটা থেকে তিনটে পর্যন্ত সরষে পেষাই করে তেল তৈরি হয় সেখানে। যে-তেল বাজারে বেচা ছাড়াও তাঁরা নিজেরাও ব্যবহার করেন। সৌরশক্তির দাক্ষিণ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বিগত বছরগুলো থেকে গ্রামের মহিলারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে অতিরিক্ত আয়ের উৎসের সঙ্গে জুড়তে সক্ষম হয়েছেন।
গুনিয়ার কাছাকাছি আরও একটি গ্রামে নীলাবতী ওরাওঁ-সহ আরও কয়েকজন মহিলা মিলে সৌরশক্তি ব্যবহার করে দুটি আটাকল মেশিন চালাচ্ছেন। নীলাবতীর এই উদ্যোগে পাশে পেয়েছেন স্বামীকেও। ভুকনি দেবীও আজ গর্বের সঙ্গে সৌরশক্তির সহায়তায় একটি ঝলমলে সরষে প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছেন শুধু নিজের নয় এবং গোটা আদিবাসী জীবনে এনেছেন নবদিগন্ত।
গুমলার মাধুরী
গুমলা জেলার মাধুরী দেবীর গল্পটাও এরকমই। মাধুরী একদিন লক্ষ্য করছিলেন ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে তাঁদের সম্প্রদায়ের মানুষ দৈনন্দিন জীবন এবং তাঁদের ব্যবসা বা কর্মজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ডিজেলে চলা জেনারেটরের ব্যবহার ছাড়া সেই মুহূর্তে কোনও উপায় থাকছে না ফলে সেই প্রয়োজন পূরণটা ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এরপর যখন ডিজেলের দাম ঊর্ধ্বগামী হতে শুরু করল তখন সেই বিপুল ব্যয়ের পরিমাণ মেটাতে গিয়ে ব্যবসার লভ্যাংশেও হাত পড়ল। ব্যবসার কাজকর্ম চালানো দুষ্কর হয়ে উঠল। সমস্যার সমাধানে মাধুরী তখন সোলার সিস্টেমের প্রতি সচেতনতা গড়ে তুলতে অন্য মহিলাদের নিয়ে প্রচারে উদ্যোগী হন। পরবর্তীতে সৌরশক্তি পরিচালিত ইউনিট চালু করেন। যার ফলে সেখানকার মানুষের ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহে সৌরশক্তি নির্ভরতা শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ডিজেল জেনারেটর নির্ভরতা হ্রাস পেতে থাকে। বছরের পর বছর ধরে এই জেলার গ্রামীণ সাধারণ সাদামাঠা জীবনে মহিলাদের পরিচিত ছন্দ যেমন পরিবারের যত্ন নেওয়া, মাঠে কাজ করা, দিনগুলি একঘেয়ে রুটিনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই আকাশ-বাতাস হয়ে উঠেছে কোলাহল মুখর। স্ব-ইচ্ছায় এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এইসব ছোট্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটে গেছে নিঃশব্দ বিপ্লব।
আসলে গবেষণায় দেখা গেছে যখন কোনও স্বনির্ভর প্রকল্প বা ব্যবসা-ক্ষেত্রে মহিলারা নেতৃত্ব দেন তখন তার ফলাফল অনেক বেশি ভাল হয়। একাধারে আবহাওয়া এবং পরিবেশের সুরক্ষা এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি— এই দুই লক্ষ্যের সম্পূর্ণ শর্তই পূরিত হয়।
জ্বালানির ব্যবস্থাপনায় নারীদের নেতৃত্বের আসনে বসানোয় কেবল আঞ্চলিক গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এমনটা নয়, এর পাশাপাশি সৌরশক্তির ব্যবহার বেড়েছে এবং কমেছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা। যে জলবায়ুর এতদিন বায়ুদূষণের প্রভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছিল প্রতিনিয়ত সেই জলবায়ু স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। নারী-নেতৃত্বাধীন উর্জা মণ্ডল মডেল প্রকল্পের অন্তর্গত সৌর মিনি গ্রিডগুলো গ্রামীণ নানা বড়, ছোট শিল্প-উদ্যোগে বা ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে এবং নুতন নতুন জীবিকা তৈরি করছে। আজ পর্যন্ত, এই প্রকল্পের অধীনে ১১৭টি স্থাপন করা উদ্যোগ বা শিল্প গড়ে উঠেছে এর ফলে গোটা উত্তরপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডের বহু মানুষ উপকৃত হয়েছেন। আর এই সাফল্যের কান্ডারি হলেন সেখানকার কৃষক-গৃহবধূরা।

Latest article