সোজারথ উল্টোরথ

রথের দিন পথে নামেন ভগবান। পথের মানুষকে দেখেন। পথের মানুষ দেখে দেবতাকে। সম্পূর্ণ হয় একটি ধুলামন্দিরের রবিকথা। রথের শেষে রথের কাঠগুলো ভেঙে আগুনে দেওয়া হয়। জ্বালানি হয় দেবতার ভোগ রান্নার। এক জীবনচক্র শেষে মৃতদেহে হয় অগ্নিসংযোগ। পঞ্চভূতে মিশে যায় একটি শরীর। রথের সঙ্গে দেহের এক অনবদ্য অন্ত্যমিল। লিখলেন চৈতালী সিনহা

Must read

রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম
আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে হয় রথযাত্রা। এই রথের সঙ্গে প্রভু জগন্নাথদেব অঙ্গাঙ্গী জড়িত। বলরাম ও সুভদ্রার সঙ্গে জগন্নাথ রথে চড়ে যান মাসির বাড়ি। সাতদিন পর মাসির বাড়ি থেকে আবার নিজের মন্দিরে। পুরী-সহ যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে সেখানেই রথযাত্রা মহাসমারোহে পালিত হয়। আর মন্দির না থাকলেও এক-এক এলাকার রথ এমনিই সেজে একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত যায় আর উল্টোরথে ফিরে আসে। রথযাত্রার সঙ্গে জগন্নাথের নাম জড়িয়ে থাকলেও রথ শুধু ওড়িশার নয়, বাংলার মাটির উৎসব। রথ উপলক্ষে মেলা বসে, গ্রামবাংলায় রীতিমতো উৎসবের ছোঁয়া লাগে। রথ বাংলার মাটির টান, রথ বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায়, রথ জিলিপি আর পাপড় ভাজায়, রথ শরীর ছুঁয়ে জন্ম-জন্মান্তরের এক মহাযাত্রা।
রথের ইতিহাস
ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের দলিল যেখানে রাখা সেই সিন্ধু সভ্যতায় কাঠের চাকা যুক্ত গাড়ি, বলদে টানা গাড়ি এসব পাওয়া গেলেও রথের কোনও খোঁজ নেই। ভারতের ইতিহাসে রথ আসছে আর্যদের নিয়ে। রথ মূলত ঘোড়ায় টানা রয়্যাল বা আর্মি গাড়ি। রাজা ছাড়াও দেবতারা রথে চলেন, পুষ্পক রথে উড়েও বেড়ান। সিভিলিয়ানদের সঙ্গে রথের সম্পর্ক প্রায় নেই তবুও রথের রশিতে সভ্যতার রথ কিন্তু এগিয়ে চলে শ্রমজীবী জনতার টানে। কুবেরের পুষ্পক রথ রাবণ জয় করে এনেছিলেন আর সেই থেকেই রথের মর্ত্যবিজয় শুরু। সভ্যতার ইতিহাস শুরু থেকেই যুদ্ধের ইতিহাস আর তাই রথেরও যাত্রা শুরু। রাজা ঘোড়ায় টানা রথে চেপে যুদ্ধ করছেন, সারথি রথকে ঠিক ঠিক দিকে চালনা করেছেন, এটাই রথের আর্য আগমনের পরবর্তী চিত্র। এর সঙ্গে স্বপ্নের পোলাওয়ের আমাপা ঘিয়ের মতো, দেবতার পুষ্পক রথ তো মাটি ছেড়ে আকাশেও বিচরণ করে। সকালে সূর্যদেব তাঁর সাতরঙা সাত ঘোড়ায় চেপে আকাশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, সারথি অরুণকে নিয়ে। শুরু হয় এক কর্মময় জীবনের।

আরও পড়ুন-বিজেপির সম্পাদক ওড়িশায় ডাকাতি করতে গিয়ে সোনা-সহ পুলিশের জালে

নব নব পান্থশালে বিচিত্র নূতন দেহরথে
জন্মমৃত্যু চক্রে আবর্তিত মানুষ বারবার দেহ ধারণ করে। দেহের সাথে রথের উপমা বারবার মনে করায় জীবন পথে দেহরথের কথা। রথ কাঠ বা ধাতু যাতেই নির্মিত হোক সবসময় তা শরীরের মতোই নশ্বর। রথস্থিত দেবতার মতোই দেহস্থিত আত্মা অবিনশ্বর। রথ চালিত করে সারথি, শরীরকে চালিত করে বুদ্ধি। ইন্দ্রিয় যেন রথের ঘোড়া, দেহরথকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। লাগাম দিয়ে ঘোড়ার গতি বা দিক নিয়ন্ত্রণ করার মতো মন নিয়ন্ত্রণ করবে ইন্দ্রিয়ের যথেচ্ছাচার। কঠোপনিষদে আছে
‘আত্মানাং রথিনাং বিদ্ধি, শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি, মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।’
এই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা কত যুগ আগে দিয়েছেন শরীরের সঙ্গে রথের তুলনা। কালক্রমে মন রশি দিয়ে ইন্দ্রিয়কে আর মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে না, ভোগবাদ এখন সমাজের সবচেয়ে বড় দর্শন।
‘রথস্থ বামনংদৃষ্টাপুনর্জন্মনবিদ্যতে’। এই মন্ত্রের অর্থ হল, রথের উপর উপবিষ্ট দেবতাকে দর্শন করলে, আর পুনর্জন্মের ভাবনা থাকে না।
রথস্থ দেবতা হল দেহের মধ্যে থাকা আত্মা বা চেতনা। যাকে সদ চিৎ আনন্দ রূপে কল্পনা করা হয়। মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য সু কর্মের মাধ্যমে জন্মের পর জন্ম ধরে উত্তরণ। এই উত্তরণের পথে আস্তে আস্তে আত্মার সচ্চিদানন্দ স্বরূপ উন্মোচিত হবে। রথে, পথে, ধুলায়, মন্দিরে দেবতার খোঁজ করতে করতে তাকে পাওয়া যাবে অন্তরে। চেতনার আলোতে পান্না হবে সবুজ, চুনী হয়ে উঠবে লাল। উপলব্ধি হবে সেই আমি— সোহমের। এই বোধ আসলেই মানুষের মুক্তি। এটাই হল রথে উপবিষ্ট দেবতা দর্শন। উপনিষদ মতে মানুষের শরীরের মধ্যে উপবিষ্ট অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ পুরুষ হল মানুষের চেতনা বা আত্মা। সেই সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্ম দর্শন নিজের মধ্যে হলে অর্থাৎ রথস্থ বামন দর্শন করলে পুনর্জন্ম হয় না অর্থাৎ জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ হয়। অর্থাৎ সোহমের অনুভব মুক্তির পথ, রথের দড়ি ছোঁয়াটা ভিড় বাড়ানোর অজুহাত মাত্র।
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
রথযাত্রার দিন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা রথে চেপে পথে নামেন। গন্তব্য মাসির বাড়ি। মাসির বাড়ি বা গুন্ডিচা মন্দির। এখানেই প্রথম শুরু হয়েছিল দেববিগ্রহ নির্মাণের কাজ। দ্বাপর যুগে কৃষ্ণান্তে নশ্বর দেহ আগুনে পুড়ে গেলেও নাভি থাকে অবিকৃত, সমুদ্রে ভাসতে থাকে, যুগ পেরিয়ে আসে যুগান্তর। কলিতে সে রূপ নেয় কাষ্ঠখণ্ডের, এসে পৌঁছয় নীলাচলে। রাজা স্বপ্ন পান, বিশ্বকর্মা শিল্পী অনন্ত রানা রূপে পৌঁছন দেবমূর্তি নির্মাণে। শর্ত, মূর্তি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কোনওরকম ডাকা চলবে না। একুশ দিনের মাথায় ছেনি হাতুড়ির আওয়াজ বন্ধ দেখে রানির বলাতে, রাজা দরজা খুলে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি দেখেন। শিল্পী শর্তভঙ্গ হয়েছে বলে অন্তর্ধান হয়েছেন। অতএব অসমাপ্ত দেবতা মন্দিরে বসলেন। সেই গুণ্ডিচা মন্দির জগন্নাথের আঁতুড়ঘর বা জন্মস্থান, এটাই মাসির বাড়ি। মামা থাকলে জন্মস্থান মামার বাড়ি হয়, মামা না থাকলে সেটা মাসির বাড়ি বলা যেতেই পারে।
জগন্নাথের হাত নেই। রূপকে ঈশ্বর বলছেন, তোমার কর্মের তুমি ফল পাও, আমার কোনও হাত নেই। অর্থাৎ ঈশ্বর কিছু পাইয়ে দেওয়ার যন্ত্র নন। নিজের কর্মের জোরে নিজের অন্ন সংস্থান করতে হবে।
রথের দিন দেবতা পথে নেমেছেন আপামর ভক্তের সঙ্গে দেখা করতে। যাদের জন্য মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ থাকে, তাদের সঙ্গে দেখা করতে ভগবান নামেন পথে। মানুষের কৃত ভুল ধরানো ভগবানের কাজ।
নানা মুনির নানা মত, তিন দেবতার তিন রথ
জগন্নাথের রথের নাম নান্দীঘোষ, বলরামের তালধ্বজ আর সুভদ্রার দেবীদলন বা দর্পদলন। জগন্নাথদেবের রথটি আকারে বড়, রথের সারথি দারুক, রথের দড়ির নাম শঙ্খচূড। ষোলোটি চাকা এই রথের, এক-একটি চাকার পরিধি সাড়ে ছ’ফুট করে। প্রতিটি চাকারই একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কথিত আছে, জগন্নাথদেব প্রকট হওয়ার আগে ১৬টি উপাদান দিয়ে পৃথিবী নির্মাণ করেন। চন্দ্রের যে ১৬ কলার কথা আমরা শুনে থাকি, সেটা আসলে চাঁদ ১৬টি কলার পরিক্রমণের মধ্যে দিয়ে একটি কালচক্র সম্পূর্ণ করে। জগন্নাথদেবের রথের চাকাও সেই ১৬টি কলারই প্রতীক। রথে জগন্নাথদেবের পার্শ্বদেবতা হিসেবে নয়জন দেবতা থাকেন। তাঁরা হলেন গোপীকৃষ্ণ, গোবর্ধন, রাম, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, বরাহ, রুদ্র, নৃসিংহ এবং হনুমান। রথের উচ্চতা ৪৫ ফুট। রথের পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী। রথ টানছে চারটি সাদা ঘোড়া, নাম হল শঙ্খ, বলহাকা, শ্বেতা ও হরিদশ্ব।
রথযাত্রার সময় বলরামের রথের সারথি মাতলি, যিনি রথটি পরিচালনা করেন। রথের রক্ষক বিষ্ণুবাহন গরুড়। রথের দ্বারে থাকেন রুদ্র ও সাত্যকি। রথের দড়ি বাসুকি নাগ। চোদ্দোটি চাকার এই রথের উচ্চতা ৪৩ ফুট তিন ইঞ্চি। রথের পতাকার নাম উন্মনি। রথটি চালনা করে চারটি ঘোড়া যাদের নাম হল তিবরা, ঘোরা, দীর্ঘশর্মা এবং স্বর্ণনাভা।
সুভদ্রার রথের উচ্চতা ৪২ ফুট ৩ ইঞ্চি, চাকার সংখ্যা ১২টি। রথটি লাল ও কালো রঙের, ৪টি ঘোড়া দ্বারা টানা হয়, যার নাম রুচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিত। রথের সারথি অর্জুন, রথের রক্ষক দেবী জয়দুর্গা। রথের পতাকার নাম নাদম্বিকা।
রথের দিন ভগবান পথে নামেন। দেবতা পথের মানুষকে দেখেন কিংবা পথের মানুষ দেখে দেবতাকে। সম্পূর্ণ হয় একটি ধুলামন্দিরের রবিকথা।

আরও পড়ুন-মেসি বনাম পিএসজি, কাঁটা পুরনো কোচও

রথের রশি, রথের বাঁশি
পুরী জগন্নাথের আদি বাড়ি, তাই রথের মহিমা এখানে বেশি। সকালে তিন ভাইবোন নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রথে করে চলেন মাসির বাড়ি। কয়েক লক্ষ ভক্ত প্রত্যক্ষ করেন রথে থাকা পথে থাকা দেবতাকে। ভিড়ের চাপে সন্ধ্যা নেমে আসে, আজ আর পৌঁছনো হয় না মন্দিরে, দেবতা থাকেন বাইরে। পরের দিন মাসির বাড়ি পৌঁছে নানা খাওয়াদাওয়া আহ্লাদ, আমোদ। সাতদিন পর আবার উল্টো পথে দেবতার মন্দিরে প্রবেশ। জন্মস্থান থেকে কর্মস্থানে আবদ্ধ হওয়া। এদিকে, ভাইবোন নিয়ে বেড়াতে যাওয়ায় লক্ষ্মীদেবীর রাগ, রসগোল্লা দিয়ে মানভঞ্জন এবং অতঃপর জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ। দেবতার মানবায়ন এবং রসগোল্লার প্রাচীন ওড়িয়া ঐতিহ্যের দাবি, যদিও মামলায় জিতে গেছে বাংলা।
পুরী ছাড়াও বাংলার নানাস্থানে রথের বড় ধুম। মেলা পাপড় ভাজা, জিলিপি আর বাঁশি আজও গ্রামীণ রথের মেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। রথের রশিতে টান দেয় সবাই, কিন্তু রথ চলে শ্রমজীবীর টানে। দেহরথ শত ভোগের মধ্যে ললিত হলেও শ্রম তাকে চালিত করে।
নিভৃত প্রাণের দেবতা, রথে কি তুমি একা
রথের সাথে জগন্নাথের একমাত্র যোগ ভাবলে একটু অন্যায় হয়ে যাবে। দেবী অন্নপূর্ণা রথে চড়ে পথে নামেন একটি দিন। অন্নপূর্ণার রথযাত্রা মূলত অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে হুগলির তেলিনিপাড়া অঞ্চলে পালিত হয়। এই অঞ্চলে মা অন্নপূর্ণার রথযাত্রা একটি বিশেষ ঐতিহ্য, যা ২০০ বছর ধরে চলে আসছে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, যা বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিনে পড়ে, সেই দিন দেবী অন্নপূর্ণার রথযাত্রা পালিত হয়। এই রথযাত্রা মূলত হুগলির তেলিনিপাড়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মা অন্নপূর্ণার মন্দির রয়েছে। এই রথযাত্রার একটি বিশেষত্ব হল, প্রত্যেক বাড়ি থেকে পুজো নিতে নিতে দেবী রথে চেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান। আগে একটি রাজবাড়ি ছিল, যেখানে এই রথযাত্রা শেষ হত। বিকেলে মন্দিরস্থ অন্য দেবদেবী মাকে পালকি করে আনতে যান এবং রথ রেখে মা পালকি করে মন্দিরে ফিরে আসেন। কাশীধামেও অন্নপূর্ণার রথের প্রচলন আছে।
ফিরতি পথে উল্টোরথে
নবম দিনে রথের মুখ ঘোরে বিপরীত দিকে। মাসির বাড়ি বা নির্দিষ্ট যে জায়গা পর্যন্ত রথ গেছে সেখান থেকে মূল মন্দিরে ফিরে আসার পালা। জন্মস্থানে ক’দিন ঘুরে আবার কর্মের মধ্যে প্রবেশ। ভ্রমণে মানুষের কর্মোদ্যম বাড়ে, তাহলে দেবতার আর দোষ কী! জীবন চক্র ঘুরে চলে অনবরত জন্ম থেকে কর্ম আবার জন্ম: এক অনন্ত রথযাত্রা। সোজা রথে যাওয়া, উল্টোরথে ফেরা নয়, জন্ম মৃত্যুর এক চক্রাকার ভ্রমণ।
শেষের সেদিন
রথের শেষে রথের কাঠগুলো ভেঙে আগুনে দেওয়া হয়। জ্বালানি হয় দেবতার ভোগ রান্নার। এক জীবনচক্র শেষে মৃতদেহে হয় অগ্নিসংযোগ, পঞ্চভূতে মিশে যায় একটি শরীর। রথের সঙ্গে দেহের এক অনবদ্য অন্ত্যমিল।

Latest article