দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অতীত প্রায় ৮০ বছর। তবে আজ গোয়েবেলসের আয়নায় চোখ রাখলে যার প্রতিবিম্ব সর্বাগ্রে ভেসে ওঠে, তিনি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হিটলার বলেছিলেন— ‘তুমি একটা বিশাল বড় মিথ্যে কথা বলো আর বারবার সেটা পুনরাবৃত্তি করতে থাকো, একটা সময় মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ হিটলার মারা গিয়েছেন বহু বছর। কিন্তু জার্মানি থেকে কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরে আমাদের ভারতবর্ষে তার আদর্শ নবরূপে জীবিত আছে আজও। ২০১৪ সাল থেকে ভারতবর্ষে রাজ করছে নব্য-ফ্যাসিবাদ। হিটলার-গোয়েবলসের ব্যাটন আজ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের হাতে। জনতার আদালতে নিজেদের ব্যক্তিগত অপদার্থতা ঢাকার প্রয়াস তাই চলছে মিথ্যার আড়ালে।
সদ্য আগত বর্ষার বৃষ্টিতে ঘাটাল আংশিক প্লাবিত হতে না হতেই বরাবরের মতোই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলির কাঠগড়ায় শাসক দল তৃণমূল। যুক্তিহীন নেতিবাচক সমালোচনার শাণিত বাক্যবাণ নিয়ে ধেয়ে আসছে তারা। ঠিক যেন ভাগাড়ের শকুন! কখন একটা লাশ পড়বে, ঠায় বসে সেই অপেক্ষায়। তারপর ছিঁড়েকুড়ে খাওয়ার পালা।
ঘাটালের বন্যা প্রাকস্বাধীন ভারতবর্ষের এক দুর্বিষহ সমস্যা। শিলাবতী ও কংসাবতী— দুই নদী তীরবর্তী মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির সার্থক রূপায়ণ হিসেবে ব্রিটিশরা কখনও-ই এই সমস্যার সমাধানের কথা ভাবেনি। তারপর ঘাটাল দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। স্বাধীন ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবঙ্গের মসনদে পালা করে বসেছে কংগ্রেস, সিপিআইএম, বিজেপির মতো সুদীর্ঘ ঐতিহাসসমন্বিত প্রবল পরাক্রমশালী সব রাজনৈতিক দল। বর্ষার ঘাটালের (Ghatal) বন্যা তাতে থামেনি ৬৪ বছরেও।
আরও পড়ুন-কমরেড ভুলে গেলেন! সিপিএম পার্টি অফিসেই ধর্ষণ করা হয় ছাত্রনেত্রীকে
২০১১ সালে প্রথমবারের জন্য ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বাধিক লড়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার ক্ষমতায় আসে মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক দল তৃণমূল। রাজ্য তখন ৩৪ বছরের বাম অপশাসনের পূতিগন্ধময় পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শুরু হয় সমস্যার মরুভূমিতে সমাধানের মরূদ্যান নির্মাণ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে এগোতে থাকে ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা। তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া নিজে দিল্লিতে দরবার করেন বারংবার। কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্পে নিজের কোষাগার থেকে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করে রাজ্য। কেন্দ্রীয় সরকার কোনওরকম সাহায্য করেনি তাতে। ঘাটালের বন্যা নিয়ে বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সুর চড়ানো শুভেন্দু অধিকারীও রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী থাকাকালীন উক্ত সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অসহযোগিতা প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছিলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের যন্তরমন্তরে মগজ ধোলাইয়ের পর যুক্তিবোধ তিনি হারিয়েছেন বেমালুম। ১৯৮২ সালে শিলাবতী নদীর ধারে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে রুপোর কোদাল দিয়ে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়। কিন্তু এ-যেন পর্বতের মূষিক-প্রসব! বছর গড়াতে না গড়াতেই বন্ধ হয় কাজ। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়ন নিয়ে সাংসদ দীপক অধিকারী সংসদে বারবার তদবির করার পরও বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে বিজেপি যখন রাজ্য সরকারকে দ্বিধাহীন ভাষায় কালিমালিপ্তকরণে মশগুল, তখনই ভণ্ড বিজেপির মুখোশ খুলে আত্মঘাতী গোল করে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সি আর পাতিল। দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের কাছে ঘাটাল বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর অকপট উক্তি— ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে কোনও টাকা দেব না। আমাদের কাছে টাকা নেই। চাইলে রাজ্য সরকার বাজার থেকে টাকা ধার করুক। বিশ্ব ব্যাংকের থেকে ধার করলে আমরা গ্যারান্টার থাকার অনুমোদন দেব। কিন্তু ঋণ শোধ করতে হবে রাজ্যকেই। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেবে না।’ অর্থাৎ বিরোধী দলনেতার স্বঘোষিত পিতা মোদিজির ক্যাবিনেট শরিক বেমালুম হাত মুছে ফেললেন ঘাটালের পরিত্রাণের প্রশ্নে। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলিকে সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চালু হয়েছে ডেল্টা প্রকল্প। বাস্তবায়নের জন্য ৭০% ঋণ গ্রহণ করা হবে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে। বাকি টাকার ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার নিজেই। যে পরিযায়ী রাজনৈতিক দল বাংলার লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের মাথার ছাদের একমাত্র অবলম্বন হাউসিং ফর অলের বরাদ্দ কিংবা গরিব মজুরের একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রাখতে পারে, তাদের কাছে তীর্থের কাকের মতো হাত পেতে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সহায়তা প্রত্যাশী হয়ে বসে থাকা আদতে অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই নয়। তৃণমূল কংগ্রেস তা বোঝে বিলক্ষণ। তাই তো দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই সদর্পে ঘোষণা করেছেন— ‘বাংলার ঘাটালের মাস্টারপ্ল্যান বাঙালির নিজের দমেই হবে এবং তা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগেই।’ বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে জ্যোতি বসু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে প্রশ্নে আপন করে নিয়েছেন ব্যর্থতাকে, সেখানেই সাফল্যের দিশা দেখাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সমস্ত ভৌগোলিক প্রতিকূলতাকে দর্পচূর্ণ করে ঘাটালকে প্লাবনমুক্ত করা আর পাড়ার নর্দমায় জমে থাকা পাঁক পরিষ্কার করা এক নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘদিনের ঔদাসীন্যে বিরক্ত রাজ্য সরকার ঘাটালবাসীর পরিত্রাণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেও মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ভূতের রাজার এমন কোনও আশ্চর্য বর নেই যে হাততালি দিলেই এক রাতে ঘাটালের সমস্যা দূরীভূত হয়ে যাবে। ঘাটালের (Ghatal) ভৌগোলিক অবস্থান অনেকটা গামলার মতো।
ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হওয়া শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর-সহ কয়েকটি নদীর ভূমিঢাল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ঘাটালের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই নদীগুলির দু’পাশের লোকালয় হিসেবে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৪৭ কিলোমিটার নদী ও নদীর বাঁধ সংস্কার, নারায়ণী ও কাঁকি খালে দু’টি স্লুইস গেট, পাম্প হাউস, ঘাটাল শহর সংলগ্ন শিলাবতী নদীর বাঁ দিকে দুই কিলোমিটার গার্ডওয়াল নির্মাণ-সহ বিভিন্ন কাজ যথোপযুক্তভাবে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন।
কিন্তু অসাধ্যসাধনের আরেক নাম মমতা। ইতিমধ্যেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মাধ্যমে নারী স্বাধীনতার এক দিগন্ত খুলে দিয়েছেন যিনি, কন্যাশ্রী দিয়ে সুনিশ্চিত করেছেন নারীশিক্ষার আশীর্বাদ, রূপশ্রীর সহায়তায় মুছিয়ে দিয়েছেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কপালের চিন্তার ভাঁজ; তাঁর অভিধানে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। উত্তরের পাহাড় কিংবা পশ্চিমের জঙ্গলের সমস্যাকে দমন করেছেন যে দশভুজা, ঘাটালের মাস্টার প্ল্যানও রূপায়িত হবে তাঁর হাত ধরেই। তারপর প্লাবনমুক্ত কোনও এক রোদ ঝলমলে উঠোনে আবারও গোলটেবিল বৈঠকে বসবে গেরুয়া কিংবা লাল পালকের শকুনেরা। নতুন কোনও লাশ খুঁজতে হবে যে…