অসুখ যখন স্নায়ুর

ব্রেন অ্যানিউরিজম, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া, এভি ম্যালফরমেশনের মতো জটিল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত বলিউডের ভাইজান সলমন খান। দীর্ঘদিন ধরেই এই রোগগুলোর সঙ্গে লড়াই করছেন তিনি। কী এই জটিল স্নায়ুর অসুখ? কতটা বিপজ্জনক? চিকিৎসাই বা কী? লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ষাট বছরের দোড়গোড়ায় বলিউডের ভাইজান। এখনও সলমন-ম্যাজিকে আচ্ছন্ন ভক্তকুল। কিন্তু সম্প্রতি একটা খবরে সল্লু ভাইয়ের ভক্তেরা বেশ চিন্তিত। বাইরে থেকে তাঁকে দেখতে দারুণ তন্দুরুস্ত লাগলেও ভিতরে ভিতরে জটিল রোগ বাধিয়েছেন সলমন। নিজেই জানিয়েছেন যে তিনি ব্রেন অ্যানিউরিজম, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া এবং এভি ম্যালফর্মেশনের মতো গুরুতর কিছু স্নায়বিক রোগে ভুগছেন। যা ফলে বেশ কিছু শারীরিক কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। কী এই তিন জটিল অসুখ জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন-বামনপোখরি জলাধার থেকে উদ্ধার গর্ভবতী হাতির দেহ

ব্রেন অ্যানিউরিজম
ব্রেন বা মস্তিষ্কের অ্যানিউরিজম এক নীরব ঘাতক। একে সেরিব্রাল অ্যানিউরিজমও বলে। এটি একধরনের স্নায়ু সংক্রান্ত জটিলতা। মস্তিষ্কের ভিতরে বা আশপাশে ধমনীর দুর্বল অংশে একটি স্ফীতি বা ফোলা। রক্তপ্রবাহর ক্রমাগত চাপ দুর্বল অংশকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। যার ফলে ফোসকার মতো ফোড়া তৈরি হয় এবং রক্ত ওর মধ্যে ঢুকতে শুরু করে ফলে ওই ফোসকা বেলুনের ফুলতে শুরু করে। একেই ব্রেন অ্যানিউরিজম বলা হয়। সেই ফোসকা ফুলতে গিয়ে যদি এটি ফেটে যায়, তাহলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যেতে পারে মুহূর্তে যা অনেকসময় তাৎক্ষণিক স্ট্রোক বা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। মস্তিষ্কের অ্যানিউরিজম দু’ধরনের জটিলতা আনে সাবরাকনয়েড হেমোরেজ এবং হেমারেজিক স্ট্রোক।
ব্রেন অ্যানিউরিজম খুব বিপজ্জনক একটি অসুখ। যে কারও মস্তিষ্কে থাকতে পারে কিন্তু কোনও লক্ষণ থাকে না। সেটা ফেটে গেলে এবং আভ্যন্তরীণ রক্তপাত শুরু হলে তখন রোগটি ধরা পড়ে। মস্তিষ্কের অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার পর প্রায় ২৫% মানুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। প্রায় ৫০% মানুষ জটিলতার কারণে ফেটে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই হাইরিস্ক জোনে চলে যেতে পারে।
কারণ
অ্যাথেরোস্ক্লোরোসিস যা ধমনীতে প্লাক জমা হওয়া বোঝায়, পারিবারিক ইতিহাস, ধূমপান, মানসিক চাপ, জন্ম থেকে দুর্বল ধমনীর দেওয়াল, কিডনির রোগ, মস্তিষ্কে আঘাত ইত্যাদি কারণে অ্যানিউরিজম হতে পারে। উত্তেজনা বা স্ট্রেস থেকে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে অ্যানিউরিজম ফেটে যেতে পারে।

আরও পড়ুন-নয়া রেকর্ড, জিএসটি আদায়ে জাতীয় গড়কেও টেক্কা বাংলার

উপসর্গ
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হঠাৎ করে তীব্র মাথাব্যথা শুরু হয়। বমি-বমি ভাব বা বমিও হতে পারে।
খিঁচুনি শুরু হয়, অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
দৃষ্টি ঝাপসা লাগে। ডবল ভিশন হয় কিছু ক্ষেত্রে।
ঘাড় শক্ত হয়ে যায়।
ঝুলে পড়া চোখের পাতা।
কথা বলা এবং মনোযোগের সমস্যা।
দুর্বলতা এবং অসাড়তা।
ভারসাম্য হারানো।
রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
চিকিৎসা
অ্যানিউরিজম নির্ণয় পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, কিছু নির্দিষ্ট অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, কিছু রক্ত পরীক্ষা করার পর চিকিৎসা করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ওষুধ বা মেডিকেশন, অস্ত্রোপ্রচার ইত্যাদি নানা পদ্ধতি রয়েছে এই রোগের চিকিৎসার।
প্রতিরোধ
অ্যানিউরিজম প্রতিরোধে জীবনযাত্রার পরিবর্তন জরুর। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কমযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যা রক্তনালিগুলিকে শক্তিশালী রাখতে এবং অ্যানিউরিজম গঠনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত ব্যায়ামও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রক্তচাপের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ধূমপান ত্যাগ করা। যাঁদের বংশে এটা রয়েছে তাঁদের আরও সতর্ক থাকতে হবে।

আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি বিজেপিরই প্রাক্তন বিধায়কের: হাজার কোটির দুর্নীতি, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ চিফ ইঞ্জিনিয়ারের

ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া
হঠাৎ করে যদি আমাদের মুখের এক দিকে, কানের পাশে বৈদ্যুতিক শকের মতো তীব্র ব্যথা হয় আবার একটু পরে চলেও যায় তাহলে আমরা সাধারণত তাকে ‘ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া’ বলি। এটি দীর্ঘস্থায়ী নার্ভের যন্ত্রণা। মুখের একদিকে, কানের পাশে ব্যথা হয় সেই ব্যথা দু-মিনিটের কম থাকে। ২০১৭ সালে, সলমন খান এই রোগটির কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন। এটি ‘সুইসাইড ডিজিজ’ নামেও পরিচিত, কারণ এই রোগের ব্যথা এতটাই তীব্র যে রোগী আত্মহত্যার কথাও ভাবেন।
কারণ
ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়ার প্রাথমিক কারণ মস্তিষ্কে উপস্থিত ট্রাইজেমিনাল নার্ভের সংকোচন। যে নার্ভ আমাদের মুখমণ্ডল, দাঁত, মুখের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যন্ত্রণা এবং সংবেদনশীলতার অনুভূতিকে বহন করে নিয়ে আসে।
স্নায়ুপথের পাশে থাকা কোনও টিউমারের কারণে সেই স্নায়ুর সংকোচন হতে পারে।
মানসিক আঘাত এবং কিছু অস্ত্রোপ্রচারের কারণে ট্রাইজেমিনাল স্নায়ুতে আঘাত লাগলে হতে পারে।
উপসর্গ
শেভ করার সময়, ব্রাশ করার সময় বা মুখ ধোওয়ার সময় বা মুখে হাত দিলে ব্যথা লাগতে পারে।
যন্ত্রণাটা কোনও ব্যক্তিকে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে প্রভাবিত করতে পারে।
ব্যথা বারবার হয়, কয়েকদিন এবং কয়েকমাস পর্যন্ত থাকতে পারে। এ এক অস্বস্তিজনক অনুভূতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাড়তে পারে।
চিকিৎসা
ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়ার চিকিৎসা কিছু ক্ষেত্রে মেডিকেশন এবং কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে করা হয়। স্নায়ু শান্ত করার, খিঁচুনি কমানোর, পেশি শিথিল করার, স্নায়ু ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়। ব্যথা কমাতে ইনজেকশনও দেওয়া হয় কখনও কখনও। সবটাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নির্ধারণ করেন।
এভি ম্যালফরমেশন
এভি ম্যালফরমেশনের বা আর্টেরিয়োভেনাস ম্যালফরমেশন। অর্থাৎ, ধমনীর বিকৃতি। সাধারণত মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডে দেখা দেয় এই রোগ। ধমনী এবং শিরার কার্যকলাপের বিরল ত্রুটি। সাধারণত, ধমনী টিস্যুতে রক্ত বহন করে নিয়ে যায়, শিরা সেটিকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এভি ম্যালফরমেশন রক্ত সরাসরি ধমনী থেকে শিরায় প্রবাহিত হয়। এর ফলে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালি ফুলে যায়। কখনও কখনও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে। যা মারাত্মক ক্ষতিকর বলা চলে।
উপসর্গ
খিঁচুনি, তীব্র মাথাব্যথা, তীব্র পিঠব্যথা, স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে।
দৃষ্টিজনিত সমস্যা যেমন চোখের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। দৃষ্টি আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এই রোগ সাধারণত জন্মগত হয়। এভিএম মস্তিষ্কে, মেরুদণ্ডে এবং ফুসফুসে হতে পারে। মেরুদণ্ডে এভিএম থাকলে ভাষা বলতে অসুবিধে হতে পারে। অসাড়তা, ঝিনঝিন করা হাঁটতে সমস্যা হতে পারে।
চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞেরা রোগের গুরুত্ব অনুযায়ী মেডিকেশন, অস্ত্রোপচার, বিশেষ ধরনের রেডিও-সার্জারি করে থাকেন।

Latest article