নিজের ঢাক নিজে পেটান, নিজেই গান নিজের গুণগান

যতই নিজের ঢাক নিজে পেটান মোদিজি, তাঁর জমানায় ভারত ভাল নেই। তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

যতদিন এই সরকার থাকবে, ততদিন সরকারি অর্থে আত্মপ্রচারের পথ থেকে নরেন্দ্র মোদিকে কেউ সরাতে পারবে— এমন আশা কম।
কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতে পারে, সরকার চালাতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অন্যতম বড় অবদান কী? কোনও সংশয় ছাড়াই এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে, নিজের নাম-মাহাত্ম্য প্রচার, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তায় হাত খুলে সরকারি অর্থ খরচ করতে তিনি কখনও কার্পণ্য করেন না!
কারণটা খুব পরিষ্কার।
২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুধু বিজ্ঞাপন বাবদই মোদি সরকার খরচ করেছে, ৬ হাজার ৪৯১.৫৬ কোটি টাকা। মানে বছরে প্রায় ৭৫০ কোটি, দিনে ২.৪ কোটি, ঘণ্টার হিসেবে ৮.৫৪ লক্ষ টাকা! এই বিপুল বিজ্ঞাপনী ব্যয়ে একমাত্র ‘কমন’ বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রীর ছবি।

আরও পড়ুন-চিকিৎসা খরচের বিল পাশ আরও সহজ, কাটল জিএসটি-র গেরো

করোনার টিকা নেওয়ার জন্য সরকার যে শংসাপত্র দিয়েছে, তাতে ছিল মোদির ছবি। রেশনে পণ্য-সামগ্রী কিনলে ব্যাগে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর বিজ্ঞাপনে সেই একই চিত্র। একইভাবে স্বচ্ছ ভারত অভিযান, আয়ুষ্মান ভারত যোজনা— প্রতিটি প্রকল্পের পরিণতি যাই হোক, তাতে মোদির ছবি থাকবেই থাকবে।
আম জনতার দেওয়া করের টাকায় এমন ‘প্রচার’-এ নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
বিজ্ঞাপনের মতোই এলাহি ব্যবস্থা তাঁর নিরাপত্তায়। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর এসপিজি নিরাপত্তায় প্রতিদিনের খরচ ১.৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘণ্টায় ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার। মিনিটে ১১ হাজার টাকার বেশি। গত পাঁচ বছরে এই খরচ আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। আশ্চর্যের যে, রাজকীয় এমন প্রচারপর্ব চলতে থাকলেও ‘ভারতেশ্বর’ নিজেকে একদা ‘ফকির’ বলে দাবি করেছিলেন! ‘কেমন ফকির’ তা আম আদমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
নাম-মাহাত্ম্য প্রচারের মতোই তাঁর সাধের প্রকল্পের জন্যও যে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকার অভাব হয় না, সদ্য অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যোগ দিবস অনুষ্ঠানই তার প্রমাণ।

আরও পড়ুন-আগে তো তোমরা সমতায় ফেরো, সাত দিন বিশ্রাম, তবু বুমরা বাইরে : শাস্ত্রী

শরীর সুস্থ রাখতে যোগের কোনও বিকল্প নেই, বলেন ডাক্তারবাবুরা। ২০১৫ সাল থেকে যোগ দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ধুমধাম করে যোগ দিবস পালনের জন্য বড় রকমের মূল্য চোকাতে হচ্ছে কোষাগারকে। কারণ ২১ জুন যোগ দিবসের দিন ‘মোদির’ প্রচারে গোটা দেশে অনুষ্ঠান করেছে কেন্দ্র। আর এই একদিনের অনুষ্ঠানের খরচ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৪-এ যোগ দিবসের অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছে ৪৩ কোটির বেশি টাকা। এবার তা তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। মোদি সরকারের শরিক চন্দ্রবাবু নাইডুর অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার একাই খরচ করেছে ৩০০ কোটি টাকা। শোনা যাচ্ছে, ২০২২-এ যোগ দিবস পালন করতে মোদি ছিলেন মাইসুরু প্যালেসে। সেবার শুধু তাঁর যাত্রাপথের রাস্তাঘাট সংস্কার করতে কর্ণাটকের বিজেপি সরকার খরচ করেছিল ৫৬ কোটি টাকা। যোগ দিবসের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান, রোজগার মেলার মতো অনুষ্ঠানে মোদি-ঢাক পেটাতে কত টাকা খরচ করে সরকার, সেই তথ্য এখনও সামনে আসেনি। কিন্তু জানা গিয়েছে, ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ অনুষ্ঠানের জন্য ছ’ বছরে ৭৯ কোটি টাকা খরচের কথা। জনগণের করের টাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার চললেও বাংলার গরিব মানুষের প্রাপ্য টাকা আটকে রাখতে মোদি সরকারের জুড়ি মেলা ভার। বঞ্চনা চলতেই থাকে। মোদি ব্যস্ত থাকেন ‘আত্মপ্রচারে’!
অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সমস্যা সমাধানে অর্থের অভাবে মোদি সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়ে না! মানবোন্নয়ন, ক্ষুধা সূচকে আন্তর্জাতিক নিরিখে নীচের সারিতে পড়ে থাকে ভারত। মাথাপিছু আয়ে বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয় ১৪৩। এই বাংলাকেও ভাতে মারার অভিপ্রায় নিয়ে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে মোদি সরকার। পরিবর্তে চলছে শুধু আত্মপ্রচার! প্রায় প্রতিদিন বিবিধ খাতের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা ‘অপচয়’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ‘মোদির ভারত’ প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। কিন্তু এত কিছু করেও দেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির ৩০০ থেকে ২৪০টি আসনে নেমে আসা মোদির ভাবমূর্তিতে বড়রকমের ফাটলের ইঙ্গিত দিয়েছে। ঘটনা হল, শরিকদের কাঁধে ভর দিয়ে এখন সরকার চালাতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে।
দ্বিতীয় টার্মে মোদি সরকারের দুর্নাম হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। সুশাসনের নামে চমকের রাজনীতিতে ভরসা রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরিণামে দেশবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছিল। বারোটা বেজেছিল উন্নয়ন এবং অর্থনীতির। এমনকী বিদেশনীতিও বিবিধ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-লজ্জা! লাগামছাড়া ধর্ষণ বিজেপি-রাজ্যেই

অত্যন্ত অপ্রিয় এক সরকারকে সামনে রেখে পদ্মপার্টির তরফে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’, অর্থাৎ ‘মোদি ম্যাজিক’-এই জিতে ফিরবে বিজেপি, এই স্লোগান। হিন্দুভোট এককাট্টা করার কৌশলে দিকে দিকে চলল ঘৃণার ভাষণ। পাখির চোখ করা হল মুসলিম জনতা, কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে তারাই সংখ্যাগুরু, দেশের শতাধিক কেন্দ্রে তারা নির্ণায়ক শক্তি। তার মধ্যে কাশ্মীর, বাংলা, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শুধু নির্বাচনী প্রচার মঞ্চ নয়, একাধিক ধর্মসভা থেকেও লাগাতার ঘৃণার ভাষণ চলে। চব্বিশের এপ্রিলে রাজস্থানে এক নির্বাচনী ভাষণ থেকে মোদি হঠাৎই বলে বসেন, ‘কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মা-বোনেদের গয়নাগাঁটি অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, ছাড় পাবে না মঙ্গলসূত্রটাও!’ স্বভাবতই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগ ওঠে, ‘ভোটে জিততে প্ল্যানমাফিক মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন মোদি।’ তাতে অবশ্য তাঁকে থামানো যায়নি। পরবর্তী একাধিক সভাতেও তাঁকে অবিকল ভূমিকায় পাওয়া গিয়েছিল। বস্তুত তাঁদের পরিকল্পনা কতটা সফল হয়েছিল তার প্রমাণ মিলেছিল প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে মোদির হ্যাটট্রিক থেকে।
জিতেও সংযত নয় তাঁর জমানা। গত একবছরে মুসলিম নাগরিকদের উপর সর্বাধিক অত্যাচার চলেছে যোগীরাজ্যে। এই প্রশ্নে ২ ও ৩ নম্বরে রয়েছে যথাক্রমে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ। দুটিই বিজেপি-শাসিত। ‘হেট ক্রাইম রিপোর্ট : ম্যাপিং ফার্স্ট ইয়ার অব মোদি’জ থার্ড গভর্নমেন্ট’ নামের একটি রিপোর্ট বলছে, মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত একবছরে এমন ঘটনা ঘটেছে ৯৪৭টি। তার মধ্যে ৩৪৫টি রয়েছে বিদ্বেষমূলক ভাষণ সংক্রান্ত। বাকি ক্ষেত্রগুলিতে সরাসরি অত্যাচারের শিকার সংখ্যালঘু মানুষজন। প্রাণ গিয়েছে ২৫ জনের— প্রত্যেকেই মুসলিম।
সব মিলিয়ে যতই নিজের ঢাক নিজে পেটান মোদিজি, তাঁর জমানায় ভারত ভাল নেই।

Latest article