বাড়িতে না জানিয়ে পুরীতে রথযাত্রা দেখতে গিয়েছিল প্রেম রাজবংশী। বয়স বছর কুড়ি হবে। পেশায় রাজমিস্ত্রি। গত ২৬ জুন সে হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে ২৮ জুন পাইকর থানায় নিখোঁজের অভিযোগে দায়ের করেন। যেহেতু সে কিছুদিন ধরে পুরীর রথযাত্রা দেখতে যাওয়ার জন্য বলছিল, তাই বিষয়টি জানিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের শরণাপন্ন হন বাবা হাবল রাজবংশী। সেই মতো মঞ্চের পক্ষ থেকে ওড়িশায় খোঁজখবর শুরু হয়। রিপন বলেন, পুরীর এসপির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি সমস্ত তথ্য নিলেও ওই যুবকের খোঁজ দিতে ব্যর্থ হন।
তারপর সোর্স মারফত জানতে পারা যায়, ছেলেটিকে মোবাইল চুরির কেসে গ্রেফতার করে বাঙ্গর ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সেই জেলে পৌঁছে ছেলের সঙ্গে দেখা করেন বাবা হাবল রাজবংশী।
ছেলেটি বাবাকে জানায়, সে একটি দোকান থেকে জল কিনে খাচ্ছিল। কিছুটা দূরে চুরি-সংক্রান্ত কোনও একটি গণ্ডগোল চলছিল। হঠাৎ পুলিস এসে ধরপাকড় শুরু করে। তখন সেখানকার পুলিস আমার ছেলেটিকে ওড়িয়া ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ছেলে বাংলা ভাষায় কথা বলায় তাকে চোর অপবাদ দিয়ে ধরে নিয়ে থানায় এসে একটি কাগজে সই করিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। ওড়িশার জেলে বন্দি প্রেম রাজবংশী।
সম্প্রতি নলহাটি ২ ব্লকের সুকরাবাদ গ্রামের ১৭ জন ও পাইকরের দুই পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে ওড়িশার রেমুনা থানায় আটকে রাখা হয়েছে। অভিযোগ, বিজেপি-শাসিত একাধিক রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকত্বের নথিপত্র হিসাবে আধারকার্ড, ভোটারকার্ড দেখিয়েও ছাড় পাওয়া যাচ্ছে না।
বাইরের রাজ্যের বহু মানুষ এখানে করেকম্মে খাচ্ছে। তাঁদের আমরা জামাই আদরে রাখছি। তাহলে এখানকার শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে কেন অত্যাচারিত হতে হবে? সেই প্রশ্ন উঠছে।
বাংলায় কথা বললেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাংলাদেশে জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিএসএফ ও দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার বাসিন্দা মেহবুব শেখকে (৩৬) ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে বিএসএফের উত্তরবঙ্গের শাখা। ওই ব্যক্তি মহারাষ্ট্রের ঠাণেতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত ১১ জুন তাকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্যদের সভাপতি সামিরুল ইসলাম ওই শ্রমিকের দুর্দশার বিষয়টি জানার পর মহারাষ্ট্র পুলিশের যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাঠান। তার মধ্যে মেহবুবের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত বিবরণ ও পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট রয়েছে। তবে মহারাষ্ট্র পুলিশ ওই সব নথিপত্রকে গুরুত্ব দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষেও মহারাষ্ট্র পুলিশকে মেহবুবের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল ঠাণেতে। তাতেও কাজ হয়নি।
বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। আধার কার্ড, প্যান কার্ড-সহ সব পরিচয়পত্র থাকার পরেও শুধুমাত্র ভাষার কারণে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লজ্জা করে না আপনাদের? বাংলা ভাষার প্রতি এই অবমাননা ভারতীয় সংবিধান ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের বিরুদ্ধে। গর্জে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসলে, মোদি সরকার মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও আসামসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বড় আকারে অভিযান পরিচালনা করেছে। এরই মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে— তাদের ‘বাংলাদেশি’ অপবাদ দিয়ে ভুলভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। ভাষার ভিত্তিতে পরিচয় নির্ধারণ করা যেমন অসাংবিধানিক, তেমনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্যও এটি বিপজ্জনক এক বার্তা। কিন্তু মোদি সরকার সেসব নিয়ে ভাবিত নয় মোটেই। কারণ তাঁরা বাংলা বিদ্বেষী, বাঙালি বিদ্বেষী।
‘সামাল’ নয়, কথাটা ‘সামান’!
আরও পড়ুন: ইসকনের জগন্নাথদেবের মাসির বাড়িতে দিন কাটছে মহানন্দে
প্রতি দিন সন্ধ্যার পরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের বস্তিতে কান পাতলে শোনা যায় এমন নানা শব্দের ব্যবহার। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, কী হচ্ছে। তবে ভিতরে গেলেই দেখা যাবে, বস্তির কোনও এক ফাঁকা জায়গায় গোল করে বসে আছেন কয়েক জন। আর তাঁদের হিন্দি শেখাচ্ছেন এক জন। শ্রমিক ছাত্রেরা বারবার ভুল উচ্চারণ করছেন, আর তা শুধরে দিচ্ছেন শিক্ষক!
ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্র, ওড়িশা-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি সন্দেহে মুর্শিদাবাদের পরিচয়ধারী শ্রমিকদের হেনস্থার ১০০টিরও বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি বলেই দাবি শ্রমিকদের। অনেকে ভিন্রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আতঙ্কে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী শ্রমিকেরা এখন হিন্দি শিখতে মরিয়া।
আর সেই সঙ্গে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে বাংলা ভাষার ভূগোল।
বাঙালি কি চুপচাপ তা মেনে নেবে!