এই বছর ‘রামানুজন অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন গণিতজ্ঞ নীনা গুপ্ত। চতুর্থ ভারতীয় এবং বাংলার দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে। পড়ান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে। গণিত তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, ভালবাসা। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। গণিত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? জেনে নিলেন অংশুমান চক্রবর্তী
আরও পড়ুন-দুর্গোৎসব আজ বিশ্বজনীন
ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে?
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই বাংলায়। তবে আমরা আসলে রাজস্থানের মানুষ। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। মা গৃহবধূ। আমি ছাড়াও আমার দুই ভাই আছে। একজন বড়, আর একজন ছোট। আমার পরিবার খুবই কনজারভেটিভ। কন্যাসন্তান হিসেবে আমি ছোটবেলায় বড়দের খুব আদর পেয়েছি। তবে আমি স্বাধীনভাবে বাড়ির বাইরে পা রাখার সুযোগ পাইনি। খেলাধুলা করার সুযোগ পাইনি। বাড়ির বড়দের মনে হত, কেউ যদি আমাকে ধরে নিয়ে চলে যায়। ভয়ে ভয়ে থাকতেন তাঁরা। চোখের সামনে দেখতে পেতাম আমার ভাইরা খেলতে যাচ্ছে। আমাকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। কষ্ট হত খুব। একদিন আমার কলেজ থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল, বাবা আমার খোঁজে সোজা কলেজে চলে এসেছিলেন। মা-ও আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। তবে এটা ঠিক, আমি কোনও পুরুষের হাত ধরে চলে যাব, এটা তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। এই ধরনের ঘটনায় আমারও বিশ্বাস ছিল না। এখনও নেই। তবু বাড়ির বড়রা আমাকে আগলে রাখতেন।
স্কুলের ফাইনালে কীরকম রেজাল্ট হয়েছিল?
আরও পড়ুন-Firhad Hakim: “টক টু মেয়র” এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, এবার লক্ষ্য আরও স্বচ্ছ প্রশাসন
পড়তাম ডানলপ খালসা স্কুলে। সিবিএসসি বোর্ড। আমি ছিলাম টপার। ফাইনালে পেয়েছিলাম প্রায় ৮৫ পারসেন্ট নম্বর। ল্যাঙ্গুয়েজে পেয়েছিলাম ৬০ পারসেন্ট। সেটা ২০০৩ সাল।
তারপর গণিত নিয়ে পড়াশোনা শুরু?
হ্যাঁ। আমি ভর্তি হই বেথুন কলেজে। আমাকে একজন দিদি বেথুনের কথা বলেছিলেন। তিনি বেথুনে ম্যাথস অনার্স পড়তেন। খোঁজ নিয়েছিলেন আমার বাবাও। জেনেছিলেন, মেয়েদের জন্য বেথুন খুব ভাল কলেজ। বেথুনে অ্যাডমিশনের জন্য উনি খুব দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, চিন্তা কোরো না বাবা। বেথুনে আমার হয়ে যাবে। শেষমেশ হয়েও গিয়েছিল। পরে আইএসআই থেকে এম ম্যাথস করি। আইএসআই ছিল আমার বাড়ির খুব কাছেই। আইএসআই অর্থাৎ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে ম্যাথস পড়ানো হয় আগে আমি জানতাম না। ভাবতাম স্ট্যাটিসটিকস নিয়েই বোধহয় কাজ হয়। এটা যে একটা এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট, সেটা আমার জানা ছিল না।
আরও পড়ুন-নানা রূপে চির ভাস্বর
গ্র্যাজুয়েশনে কীরকম রেজাল্ট হয়েছিল?
আমি টপার হয়েছিলাম। পার্ট ওয়ানে আমার মার্কস ছিল ৯১ পারসেন্ট। এত ভাল রেজাল্ট হবে, আমি নিজেও আশা করিনি। তবে আমার একটা আফসোস, আমি গণিতে কখনও ১০০ পাইনি। ৯০-এর বেশি পেয়েছি।
পার্ট টু’র রেজাল্ট?
পার্ট টু-তে নম্বর কমে গিয়েছিল। ৮৪ পারসেন্ট-এর মতো।
তারপর কী করলেন?
আইএসআই থেকেই পিএইচডি করেছি। এম ম্যাথস করার পর পিএইচডি। তারপর চাকরি। আইএসআই-তে বর্তমানে আমি অধ্যাপনা করছি৷
আরও পড়ুন-বিজেপির ধরনামঞ্চে গোবরজল
রামানুজন অ্যাওয়ার্ডটা নিয়ে কিছু বলুন––
আমার পরম সৌভাগ্য, আমি যে অ্যাওয়ার্ডটা পেয়েছি সেটা শ্রীনিবাস রামানুজনের নামে। রামানুজন সম্পর্কে সবাই জানেন। তিনি ছিলেন একজন মহান গণিতজ্ঞ। কঠোর পরিশ্রম করে তিনি জীবনে সাফল্য পেয়েছিলেন। রামানুজনকে বুঝতে, জানতে অনেকটা সময় লেগেছে আমাদের। তিনি ছিলেন সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। তাঁর নামাঙ্কিত অ্যাওয়ার্ড পেয়ে আমি সম্মানিত। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অঙ্ক নিয়ে আমার কাজ স্বীকৃতি পেল, এটা ভেবে ভাল লাগছে। ‘রামানুজন অ্যাওয়ার্ড’ একটা আন্তর্জাতিক মানের অ্যাওয়ার্ড। দেওয়া হচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে। বছরে একবার উন্নয়নশীল দেশের নতুন গণিতজ্ঞদের দেওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স, ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক এবং ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিক্যাল ইউনিয়ন অ্যাওয়ার্ডটা দেয়। গতবছর এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ব্রাজিলের একজন গণিতজ্ঞ। ২০২১ সালে পেলাম আমি। আজ পর্যন্ত চারজন ভারতীয় এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। দু’জন পুরুষ, দু’জন নারী। বাঙলার মানুষ হিসেবে দ্বিতীয়। অ্যাওয়ার্ডটা দেওয়া হবে ইতালিতে। জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে। আমাকে সেখানে গিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে এবং অ্যাওয়ার্ডটা নিতে হবে। প্রসঙ্গত জানাই, এর আগে ৩৫ বছর বয়সে আমি সর্বকনিষ্ঠ গণিতজ্ঞ হিসেবে পেয়েছি শান্তিস্বরূপ ভাটনগর অ্যাওয়ার্ড।
আরও পড়ুন-Primary Education: প্রাথমিক শিক্ষায় ‘ভারত সেরা’ পশ্চিমবঙ্গ, মমতা সরকারকে স্বীকৃতি মোদি সরকারের
বিশিষ্ট মানুষের শুভেচ্ছা পেয়েছেন?
বহু বিশিষ্ট মানুষ আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। স্কুল-কলেজের বন্ধুরা শুভেচ্ছা জানিয়েছে। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন টিচাররাও। আমার পরিবারের সদস্যরাও খুব খুশি। কোথায় আমাকে নিয়ে কী খবর বেরোচ্ছে, ওরা এখন সব খুঁটিয়ে দেখছে।
ছোটবেলার স্বপ্ন কী ছিল?
আমার সমস্ত স্বপ্ন গণিতকে ঘিরে৷ ছোটবেলা থেকে। তখন থেকেই আমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করার স্বপ্ন দেখতাম৷ গণিত নিয়ে এমন কিছু করতে চাই, যাতে দেশ আমার জন্য গর্ব অনুভব করতে পারে। আসলে আর্মিতে কাজ না করেও দেশকে গর্বিত করা যায়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ক্রিকেট খেলে দেশকে গর্বিত করেছেন। এইভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে ভাল কাজ করে দেশকে গর্বিত করা যায়। সেইভাবে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। সাহায্য পেয়েছি বহু মানুষের। বেথুনের টিচারদের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ভাল টিচার পেয়েছি আইএসআই-তেও। কতকিছু শিখেছি তাঁদের কাছে। আমার স্কুল, কলেজের টিচাররা এত যত্ন করে পড়াতেন যে আমাকে কোনওদিন প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নিতে হয়নি। আমার সাফল্যের পিছনে আমার পরিবারের ভূমিকাও আছে। উচ্চশিক্ষার জন্য আমার বাবা আমাকে সবথেকে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। আমাকে আগলে রেখেছেন। জীবনে আজ পর্যন্ত যা পেয়েছি, যথেষ্ট পেয়েছি।
আরও পড়ুন-বিজেপির ধরনামঞ্চে গোবরজল
লাভ না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। ২০১৫ সালে। আমার একটি কন্যাসন্তান আছে। আসলে এখনকার প্রেম-ভালবাসা দেখে একটা কথাই আমার মনে হয়, সম্পর্কে বিশ্বাসের জায়গাটা হারিয়ে গেছে। চরম অবিশ্বাসের কারণে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। কেউ কাউকে ভরসা করতে পারছে না। এইভাবে ভালবাসা হয় না। নিজেকে অন্যের প্রতি উৎসর্গ করার ইচ্ছেটাই আজকাল আর দেখা যায় না। জানেন তো, আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বন্ডিং দারুণ। ওঁর কখন কী প্রয়োজন আমি সেটা বুঝতে পারি। আমার স্বামীও বুঝতে পারেন আমি কখন কী চাই। আমার তেষ্টা পেলে স্বামী আমার হাতে জলের গ্লাস তুলে দেন। বলেন, তুমি সকাল থেকে জল খাওনি। আমার কাছে ভালবাসা এটাই। কম বয়সে যে সম্পর্কগুলো তৈরি হয়, সেগুলো আবেগের বশে তৈরি হয়। প্রকৃত ভালবাসা দিয়ে নয়। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
আরও পড়ুন-ড্রোনের মাধ্যমেই হবে সাগরের পুণ্যস্নান
গণিত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
গণিত নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে। আমি চাই অঙ্কের বেশকিছু সমস্যার সমাধান করতে। পাশে থাকতে চাই ছাত্র-ছাত্রীদের। তাদের নিয়ে এগোতে চাই। আমার গাইড অমর্ত্যকুমার দত্ত সবসময় আমাকে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। উৎসাহিত করেন। বলেন, নিজের কাজ ঠিকঠাকভাবে করে যেতে হবে। আমি তাঁর কথা
অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি। আর একটা কথা, আমি টিভি দেখি না, সিনেমা দেখি না। গণিত আমার
ধ্যান, জ্ঞান, ভালবাসা। আমার কাছে বিনোদনের
একমাত্র মাধ্যম গণিত।