দেশ জুড়ে যাদের দুর্বৃত্তরাজ কায়েম হয়েছে, তাদের হাত থেকে দেশ দ্রুত ও স্থায়ী মুক্তি চায়। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য এটাই যে, আমরা চিকিৎসাশাস্ত্র এবং চিকিৎসকের মতো একটি গুরুতর দায়িত্ব-কর্তব্য-পালনে যার-পর-নাই অবহেলা করে চলেছি এবং ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি পদে পদে।
এই দেশ ভয়াবহতম ‘ব্যাপম’ কেলেঙ্কারি (১৯৯০-২০১৩) দেখেছে। আমরা জানি, ওই দুর্নীতির পথ ধরে অসংখ্য অযোগ্য ছেলেমেয়ে ডাক্তারি কোর্সে ঢুকে পড়েছিল এবং বঞ্চিত করা হয়েছিল বহু প্রকৃত মেধাবী ছেলেমেয়েকে। তার ফলে বছরের পর বছর ধরে এমন কিছু ‘ডাক্তার’ তৈরি হয়েছে, যারা রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য কোনওভাবেই উপযুক্ত নয়। অন্যদিকে, চূড়ান্ত বেইমানি হয়েছে মেধার সঙ্গে। বহু প্রকৃত চিকিৎসক পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছে দেশ। এই অনাচারের কারণে চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতের সুনাম, ঐতিহ্য যে অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো ওই পাপের বোঝা দেশ আজও বয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন-আরও দুটো বছর লাল-হলুদে বিষ্ণু, আজ সামনে বিএসএস
মাঝেমধ্যেই সামনে আসে এনআরআই কোটায় মেডিক্যাল অ্যাডমিশনের অভিযোগ। ডাক্তারি কোর্সে ভর্তির সর্বভারতীয় অভিন্ন প্রবেশিকা নিট-ইউজির মান নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। অভিযোগ, স্রেফ টাকার থলির জোরে কিছু অযোগ্য ছেলেমেয়ে বহু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিট (এমবিবিএস পঠনপাঠনের) নিশ্চিন্ত করে ফেলছে। এই সিস্টেমও চিকিৎসা ক্ষেত্রের মান নামিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বইকি। এসব তো রোখা যায়নি এবং যাচ্ছে না। এসব নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজ বেশ দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তারই মধ্যে সামনে এল আর এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড— অত্যন্ত দুর্বল পরিকাঠামোর কিছু প্রতিষ্ঠানকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের অনুমোদন (এনএমসি) পাইয়ে দেওয়ার এক চক্র দেশ জুড়েই সক্রিয়! প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো থেকে শিক্ষক-সহ জরুরি অনেক কিছুই নেই বহু মেডিক্যাল কলেজের, তবু এনএমসির অনুমোদন জুটে যাচ্ছে তাদের। আমরা জানি, এনএমসি’ই হল দেশের অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষার রক্ষাকর্তা।
একাধিক রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির গুচ্ছ গুচ্ছ খুঁত ধরে বিপুল টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়। আর সেই এনএমসি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অফিসারদের একাংশের বিরুদ্ধেই মারাত্মক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে সিবিআই। মোট ৩৬ জন রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে তারা।
এটাই ‘দেশের সর্ববৃহৎ মেডিক্যাল কেলেঙ্কারি’। সিবিআইয়ের অভিযোগ, বিভিন্ন প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ সংক্রান্ত গোপন ফাইল এবং তথ্যের ছবি সরকারি কম্পিউটার থেকে চুরি করত স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অফিসার ও কর্মীদের একটি চক্র। তারপর ওইসব কলেজের কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হত পরিদর্শন সংক্রান্ত জরুরি তথ্যাদি। বিনিময়ে মোটা টাকা ঘুষ নিত তারা। সেটাও হাওলার মাধ্যমে। ফলে পরিদর্শনের আগেই জোগাড় হয়ে যেত ভুয়ো শিক্ষক এবং নকল রোগী। চলত বায়োমেট্রিক হাজিরায় কারসাজি এবং পরিদর্শকদের সঙ্গে ‘সেটিং’। ঘুষের বিনিময়ে রেডি হত ‘পজিটিভ’ ইনসপেকশন রিপোর্ট এবং এমবিবিএস আসন বৃদ্ধির অনুমোদন। এই চক্রের কয়েকজন হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। তাদের গ্রেফতার করেছে সিবিআই। দুষ্টচক্রের জাল বিস্তৃত একাধিক রাজ্যে। তদন্তে নেমে এখনও পর্যন্ত ছত্তিশগড়, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির মোট ৪০ জায়গায় হানা দিয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তার মধ্যে বিজেপি-শাসিত রাজ্য রয়েছে পাঁচটি। তদন্তে নামা এবং কিছু অভিযুক্তকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে সিবিআই।
কিন্তু সিবিআইয়ের অতীত রেকর্ড বলছে, তদন্তের জাল গোটানো এবং অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণ-সহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে গাল ভরা নামের সিবিআই বারবার চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এবার কি তারা তাদের একদা সুনামের প্রতি সুবিচার করতে পারবে? আমরা সন্দিহান।
দেশ জুড়ে বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের পরিদর্শন, লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম চলত। পরিদর্শনের আগেই ঘুষের বিনিময়ে গোপন নথি পাচার করা হত। গোটা কাণ্ডের নেপথ্যে ছিল এক বিশাল র্যাকেট। ঘটনায় প্রাক্তন ইউজিসি কর্তা ডিপি সিং সহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে সিবিআই। তদন্ত চলছে।
আরও পড়ুন-বাংলা বিরোধী বিজেপি, চলছে ভয়ঙ্কর তিন চক্রান্ত, প্রতিবাদে মুখর তৃণমূল
এর আগে নিটে জালিয়াতি নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। এবার সামনে এল মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতির ছবি। মূলত বেসরকারি কলেজগুলির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অংশ হওয়ার অভিযোগ উঠছে। জানা গিয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রকের আধিকারিকরা গোপন তথ্য ফাঁস থেকে ঘুষ নেওয়ার মতো একাধিক কাজে মদত দিতেন। টাকার বিনিময় আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হত কোথায়, কখন পরিদর্শনে হবে। সেইমতো ব্যবস্থা করে রাখত কলেজ কর্তৃপক্ষ। কোনওভাবেই এমন কিছু সামনে আনা হত না, যা সমস্যার কারণ হতে পারে। ভুয়ো শিক্ষক থেকে ভুয়ো রোগী— সবকিছুর ব্যবস্থা থাকত। হাজিরার জন্য বায়োমেট্রিক সিস্টেমে পর্যন্ত পরিবর্তন করা হত। সবকিছু এমনভাবেই সাজানো হত যে দেখে ভুল বোঝার কোনও উপায় নেই। সরকারের সুনজরে থাকতেই এই বিশেষ নাটক সাজানো হত। তাতে প্রয়োজনীয় অনুদান পেতেও বিশেষ সুবিধা হত। ঘটনায় প্রাক্তন ইউজিসির চেয়ারম্যান ডি পি সিং-সহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তালিকায় রয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের আধিকারিক এবং বেসরকারি কলেজের প্রতিনিধিরা। উত্তর থেকে দক্ষিণ-দেশ জুড়ে এই র্যাকেটের দৌরাত্ম্য ছিল বলেই অভিযোগ। মোটা টাকার লেনদেন চলত মেডিক্যাল কলেজগুলিকে অবৈধভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য। সামনে এসেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের একাধিক আধিকারিকের নাম। যার মধ্যে অন্যতম গুরুগ্রামের বীরেন্দ্র কুমার। মেডিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড রেটিং বোর্ডের সদস্য জিতু লাল মিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বীরেন্দ্র। জানা গিয়েছে, হাওলার মাধ্যমে মিনাকে ঘুষ পাঠাতেন অভিযুক্ত। ঘুষ বাবদ পাওয়া ৭৫ লক্ষ টাকা দিয়ে রাজস্থানে মন্দির পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতে যাবতীয় কারবার চালাতেন অন্ধ্রপ্রদেশের বি হরি প্রসাদ। সঙ্গে ছিলেন অঙ্কম রামবাবু ও কৃষ্ণ কিশোর।
দেশের চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাব্যবস্থায় এরকম কেলেঙ্কারি আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। ডাক্তারবাবুরা সাধারণ মানুষের চোখে ভগবান। ভগবান যদি শয়তানের কারখানায় তৈরি হন, তবে আমরা কেউই স্বস্তিতে থাকতে পারি না।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে অহরহ ঘটে চলা আমাদের কাউকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।