কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলেই মালুম হয়েছিল ‘‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’’ স্লোগান ফ্লপ। রাজ্য বিজেপির নয়া সভাপতি প্রকাশ্য ভাষণে বলেন, ‘বিজেপি মুসলিম বিরোধী নয়’। —এই দুটি ঘটনার প্রকোপে প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি কি তবে বদলে গেল?
কড়া হিন্দুত্বের লাইন ছেড়ে আচমকা বহুত্ববাদের পক্ষে তাঁর সওয়ালে কোনও লাভ হবে না। কারণ আলকাতরার উপর যতই হোয়াইটওয়াশ করা হোক না কেন, সাদা হবে না। কথায় কথায় বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি খেতে অভ্যস্ত মুসলিমরা বিজেপিতে আস্থা রাখবে, সে আবার হয় নাকি?
ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে বাংলায় বিজেপি সাফল্য পেতে চাইছে। কেন? আসলে বামেরা তাদের পথ চিনিয়েছে। ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে না পারায় হতাশাগ্রস্ত বাম নেতাকর্মীরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। বামের ভোট রামে গেছিল। সেই থেকেই গেরুয়া গ্যাস বেলুনের ফোলা শুরু।
আরও পড়ুন-জোকা আইআইএমে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে চরম ধোঁয়াশা
একুশের পর রাজ্যের ১১টি উপনির্বাচনেই বিজেপি হেরেছে। এমনকী, লোকসভাতেও তাদের সদস্য সংখ্যা ১৮ থেকে কমে হয়েছে ১২। গেরুয়া শিবিরে নেমে আসে হতাশা। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে সেখানকার হিন্দুদের উপর হওয়া অত্যাচারের ঘটনাকে সামনে এনে পশ্চিম বাংলাতে মেরুকরণের জন্য উঠেপড়ে লাগে বঙ্গ বিজেপি। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ফের।
অথচ এর মধ্যে অবস্থা গেছে বদলে। উনিশ এবং একুশ সালে সম্ভবত অধিকাংশ বাম কর্মী-সমর্থক মনে করেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরানোর ক্ষমতা একমাত্র বিজেপিরই আছে। তাই তাঁরা ঢেলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা বুঝেছেন, অল আউটে গিয়েও তৃণমূল কংগ্রেসের জনমুখী প্রকল্পের প্রভাব জনমানস থেকে মোছার ক্ষমতা বিজেপির নেই। ভোটারদের একাংশের মধ্যে গেরুয়া শিবিরের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি আছে। বিশেষ করে রামে যাওয়া বাম ভোটারদের মধ্যে। তাই তাঁদের বিভ্রান্তি দেখেই প্রয়াত জ্যোতি বসুর প্রতি রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা আর কী! কিন্তু সমস্যা হল একুশের নির্বাচন থেকেই বাংলায় সিপিএম তথা বামেরা শূন্য। লোকসভা নির্বাচনেও সিপিএম খাতা খুলতে পারেনি। ফলে ছাব্বিশের নির্বাচন বঙ্গ সিপিএমের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন লড়াই। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির ব্যবধান সিপিএমের ভোটে ঘুচবে, এমনটা ভাবা অলীক কল্পনা।
এইজন্যই বাংলার মাঠে সক্রিয় সংঘ শিবির।
আরও পড়ুন-নির্বাচন কমিশন ও জরুরি অবস্থার ক্ষমতা নিয়ে স্পষ্টতার দাবি চন্দ্রচূড়ের
লোকসভা নির্বাচনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার না নাটি মানুষের সরকারের ট্রাম্প কার্ড হবে, সেটা তাঁরা আগেই বুঝেছিলেন। তাই গ্রামের দুঃস্থদের বুঝিয়েছিলেন, ১০০০ টাকায় আজকাল কিছুই হয় না। দরকার স্থায়ী কাজ। রামমন্দির স্থাপন যে একটা বিরাট ব্যাপার, সেটাও তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। এভাবেই জোড়া ফুলের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি হিন্দুদের রক্ষা করতে গেলে বিজেপিকেই যে দরকার, সেটাও তাঁরা বোঝান।
কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, বাম বিজেপির মিথ্যাচারের মুখোশ বরং আরও খুলে গেছে। সেজন্যই ভুয়ো ভোটারের ছক কষে বাজিমাতের চেষ্টায় বিজেপি। পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের নওজোয়ানদের সতর্ক পাহারাই এক্ষেত্রে কার্যকরী এন্টি ডোজ।
এব্যাপারে একটা সোজা কথা সোজাসুজি জানতে চাই।
এই যে প্রতি বছর ট্যাক্স নিয়ে চলেছেন আমাদের কাছে, ট্যাক্স নেওয়ার সময় সন্দেহ হয়নি যে, আমরা ভারতীয় নাগরিক কি না? আমাদের রাজ্যে ভোট চাইতে এসে মনে পড়ে না যে, আমরা নাগরিক কি না? তখন প্রশ্ন করতে দেখি না তো যে, আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ আছে তো? এই যে আধার কার্ডের সঙ্গে প্যান কার্ড লিঙ্ক করার জন্য ১ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন, সেটা তাহলে ঠিক আছে? নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করা এবং সবরকম আর্থিক লেনদেনে যাতে স্বচ্ছতা আসে, সেই কারণে আধার ও প্যানের লিঙ্ক করা। তাই তো? আবার আপনারাই এখন বলছেন আধার কার্ড নাকি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়? ওই যে আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ডের লিঙ্কও করানোর জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন? কেন? এখন তো বলছেন আধার কার্ড নাগরিকত্ব নয়? একটা কথা বলুন তো! ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ তো? প্যান কার্ড? পাসপোর্ট? রেশন কার্ড? এসব নাগরিকত্বের প্রমাণ? যদি হয়, তাহলে তাবৎ পরিষেবা পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সর্বত্র আধার কার্ড নম্বর দিতে হয় কেন? মোবাইল সিম কার্ড পাওয়া হোক কিংবা লোনের জন্য আবেদন। সরকারি নথি পেতে গেলেই হোক কিংবা জমি-বাড়ির রেজিস্ট্রেশন। কই ভোটার কার্ড কিংবা পাসপোর্টে তো কাজ চলে না? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আধার কার্ড বাধ্যতামূলক নয়। অথচ বাস্তবে তো বাধ্যতামূলক শুধু নয়, জোর জবরদস্তি করা হয় যে, আধার কার্ডই লাগবে সবরকম সরকারি ব্যবস্থায়।
তাই যদি হবে তবে এখন উল্টো কথা বললে চলবে কেন? মানুষ মানবেই বা কেন? ঘরে ঘরে এই কথাটা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। নাগরিকদের অধিকার নিয়ে জনগণের আতঙ্ক কাটাতে দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যেতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী ছাত্র যুব মা- বোনেদের।
বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় যাকে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বলা হচ্ছে, তখন বলা হচ্ছে, আধার কার্ড চলবে না। রেশন কার্ড চলবে না। তার মানে আধার কার্ড কি মূল্যহীন? আপনি বলবেন, ওটা তো নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। তাহলে ওটা কী? উত্তরবঙ্গে আধার কার্ড অ্যাপ্লাই করলে কম্বোডিয়া অথবা গ্রিনল্যান্ডের বাসিন্দারাও কি সেটা পেতে পারেন? যদি বলেন, আধার কার্ড তো ভারতীয় নাগরিকদের জন্য। অন্যরা পাবে কেন? ভারতীয়রাই পাবে। তাহলে কেউ কেউ ঘেউ ঘেউ করছে কেন আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়? যে কার্ড দেখিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের সব রকম পরিষেবা পেতে হয়, সেটা নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়!
আরও পড়ুন-জোকা আইআইএমে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে চরম ধোঁয়াশা
আমাদের থেকে গড়ে মাসে দেড় লক্ষ কোটি টাকা করে জিএসটি নিয়ে চলেছেন। জনতার থেকে ২২ লক্ষ কোটি টাকা সার্বিক ট্যাক্স পেয়েছেন বিগত বছরেই। আপনারা জানেন না আমরা সত্যিকারের নাগরিক কি না? করোনার সময় ব্যালকনিতে থালা বাজানোর নির্দেশ দেওয়ার সময় মনে পড়েনি নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র চাওয়ার কথা?
বিজেপি জবাব দাও।