নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন আশাপূর্ণা

বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। যাওয়া হয়নি স্কুলে। পড়াশোনা বাড়িতেই। পর্যবেক্ষণ করতেন নারীদের। একটা সময় হাতে তুলে নেন কলম।

Must read

বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। যাওয়া হয়নি স্কুলে। পড়াশোনা বাড়িতেই। পর্যবেক্ষণ করতেন নারীদের। একটা সময় হাতে তুলে নেন কলম। লেখেন গল্প-উপন্যাস। তিনি আশাপূর্ণা দেবী। নারীবাদী সাহিত্যিক। সোচ্চারে নয়, তাঁর নারীবাদ সঞ্চারিত হয়েছে নীরবে। প্রয়াণদিবসে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী
তাঁর জন্ম মুহূর্তে হাহাকার রব উঠেছিল। ঠাকুরমা বলেছিলেন— এ কী হল! এতগুলো মেয়ের পর আবার মেয়ে! ছোটবেলায় হয়েছিলেন বৈষম্যের শিকার। অযত্ন, অবহেলার শিকার। জ্ঞান হওয়ার পর বিষয়টা ভালভাবে উপলব্ধি করেন। একটা সময় পর্যন্ত থাকতেন চুপচাপ, শান্ত। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন তুমুল দস্যি। পাল্লা দিতেন ছেলেদের সঙ্গে। খেলতেন ক্যারম, ওড়াতেন ঘুড়ি। তাঁর সঙ্গে পেরে উঠত না কেউই। নির্জন দুপুরে বসতেন পুতুল নিয়ে। আপনমনে খেলতেন। গভীর আগ্রহ ছিল পড়াশোনার প্রতি। জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। আর পাঁচজনের মতো যেতে চাইতেন স্কুলে। বাদ সাধেন সেই ঠাকুরমাই— মেয়েমানুষ হয়ে স্কুলে যাবে কী? মুখ বুজে মেনে নিতে হয় ঠাকুরমার কড়া নির্দেশ। যাওয়া হয়নি স্কুলে। মনে ছিল চাপা কষ্ট। মুখফুটে কিছু বলতে পারতেন না। কারণ পুরুষ শাসিত সমাজ। রক্ষণশীল পরিবার। মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই। তারা যে ‘অবলা’! সেইসময় মুখে প্রকাশ না করলেও, মনের মধ্যে অনর্গল কথার জন্ম হয়েছে। কথার পিঠে কথা বুনে একসময় তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী।

আরও পড়ুন-বৃষ্টি উপেক্ষা করে একুশে ধর্মতলা চলোর সমর্থনে সায়নীর জনসভায় জনজোয়ার

মা বুঝতেন তাঁকে। মায়ের ইচ্ছায় বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু। তখন তিনি সাড়ে পাঁচ বছরের। বিভিন্ন সাহিত্য পরিষদ এবং লাইব্রেরির সদস্যা ছিলেন মা। বাড়িতে ছিল নানা ধরনের বইয়ের পাহাড়। বাবাও ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী। মেয়ের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালার চেষ্টা করতেন। বাড়িতে আসত ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘সবুজপত্র’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘বসুমতী’, ‘বালক’, ‘শিশুসাথী’, ‘সন্দেশ’ প্রভৃতি পত্রিকা। পাশাপাশি আসত দৈনিক পত্রিকাও। কম বয়সেই আশাপূর্ণা হয়ে ওঠেন বই-পোকা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলতেন। এসবই তাঁকে পরিপূর্ণ সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ। মানুষের, বিশেষত নারীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। একাত্ম হয়ে যেতেন তাঁদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। একটা সময় নিজেকে প্রকাশ করার কথা ভাবেন। হাতে তুলে নেন কলম।
গল্প উপন্যাসের জন্যেই মূলত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে আশাপূর্ণার লেখালেখিতে হাতেখড়ি কবিতার মাধ্যমে। ১৯২২ সালে ‘বাইরের ডাক’ নামে একটি কবিতা ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখনই গল্প লেখায় হাত পাকানো শুরু। সেইবছরই তাঁর ‘পাশাপাশি’ নামের গল্প একটি পত্রিকায় ছেপে বেরোয়। তবে সেসবই ছিল সূচনা পর্বের রচনা।
মাঝে কিছুদিনের বিরতি। নিজের জ্ঞানভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করার পর আবার শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। প্রকাশিত হয় ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ গল্পটি। এরপর বাকি জীবনে সমান তালে লিখে গেছেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় বড়দের জন্য ছোটগল্পের সংকলন ‘জল আর আগুন’, তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘প্রেম ও প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সদলবলে পাঁশকুড়ার নদীবাঁধ পরিদর্শনে এসে সেচমন্ত্রীর ক্ষোভ

ঘোরতর সংসারী ছিলেন। স্বামী, তিন সন্তান। পালন করেছেন সমস্ত দায়দায়িত্ব। পাশাপাশি সময় বের করে মনপ্রাণ ঢেলে লিখে গেছেন। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ এবং ‘বকুলকথা’— তাঁর এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নারীদের মনের অন্দরমহলে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি লিখতেন নারীদের মনের কথা, নারীদের মনের মতো করে। সমাজ যাঁদের ‘অবলা’ মনে করে, তিনি তাঁদের করে তুলেছিলেন কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র। দিয়েছিলেন সম্মান। দেখেছিলেন নারীমুক্তির স্বপ্ন।


জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ। অল্প বয়সেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন এবং একটি উত্তরের আবদারও করেছিলেন। কবিগুরু উত্তরে লিখেছিলেন, ‘‘আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।’’
তাঁর উপন্যাস এবং গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে বহু সিনেমা। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, রবীন্দ্র-সহ বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা।
নারীবাদী সাহিত্যিক ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। তবে সোচ্চারে নারীবাদের প্রচার করেননি। তাঁর নারীবাদ সঞ্চারিত হয়েছে নীরবে। ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের প্রতিটি রোমকূপে। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে নারীরা খুঁজে পেতেন নিজেদের। আজও পান। তাই তো বর্তমান সময়েও তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস এত জনপ্রিয়। চর্চিত, পঠিত।

Latest article