ভারতীয় সংবিধানের মূল আদর্শ ও মূল্যবোধ সংকটের মুখে। সম্প্রতি ভারতের মহামান্য উপরাষ্ট্রপতি সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন, ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি প্রস্তাবনায় থাকা উচিত নয়। ইদানীং একটি রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, ৪২তম সংবিধান সংশোধন জরুরি অবস্থার মধ্যে গৃহীত হয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময় সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলি ক্ষমতাহীন ছিল। কিন্তু সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর ধারা অনুসারে সংবিধান সংশোধন হয়েছিল। তাই সংবিধান সংশোধনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে এতদিন পর এই সমস্ত প্রশ্ন তোলা অবান্তর। উল্লিখিত সংশোধনের তিন বছর আগে ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ ঘোষণা করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সংসদীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, ভ্রাতৃত্ববোধ প্রভৃতিকেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘোষণা করা হয়েছিল। গত বছর সুপ্রিম কোর্টে তিনটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল—বক্তব্য একই, সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটি তুলে দেওয়ার আবেদন। ২০২৪-এর ২৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট তিনটি পিটিশনই খারিজ করে দেয়। মহামান্য শীর্ষকোর্ট বলে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর ধারা অনুসারে, সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করতে পারে না।
সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার সময় থেকেই আমাদের সংবিধানের অন্যতম আদর্শগত ভিত্তি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানে স্বীকৃত ছয়টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যক্তির যে কোনও ধর্মে বিশ্বাস করার, ধর্মাচরণ করার ও নিজস্ব ধর্মমত প্রচার করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না, যেমন পাকিস্তানের রয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কিন্তু ভারতবর্ষের কোনও রাষ্ট্রধর্ম নেই। কোনও ধর্মের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয় না এবং কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দেখানো হয় না। এসব সত্ত্বেও ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটি যুক্ত করার পেছনে ভাবনা ছিল, এই আদর্শটিকে আরও বিশেষভাবে জোর দেওয়া, রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষায় এই আদর্শটির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে জনমানসে সচেতনতা সৃষ্টি করা। ঠিক তিন বছর আগে (১৯৭৩) সুপ্রিম কোর্ট বলেই দিয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্গত। এই আইনি ব্যাখ্যাকে জনমানসে প্রতিফলিত করাই সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-উন্নয়নের নামে শুধুই প্রহসন মধ্যপ্রদেশে বিজেপির গ্রাম পঞ্চায়েতে
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্যে রাজতন্ত্র ও চার্চের মধ্যে কয়েকশত বছর ক্ষমতার লড়াই চলেছিল। রাজতন্ত্রের যুক্তি ছিল, রাজা রাষ্ট্র-সম্পর্কিত বিষয়ে শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী। চার্চ আধ্যাত্মিক ব্যাপারে (Spiritual) নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। অপরদিকে চার্চের বক্তব্য হল, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে চার্চ আধ্যাত্মিক ব্যাপারে এবং জাগতিক (Temporal) ব্যাপারে উভয় বিষয়েই শীর্ষে থাকবে। রাজা চার্চের অধীনে কাজ করবেন। রাজতন্ত্র ও চার্চের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। চিন্তাবিদরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ইতালির চিন্তাবিদ রাষ্ট্রদার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি (Machiavelli) প্রথম স্পষ্টভাবে বললেন, রিলিডিয়েন ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়টি আলাদা। রাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়টি রাজার নিয়ন্ত্রণাধীন। আধ্যাত্মিক (Spiritual বা Religious) বিষয়টি চার্চের হাতে থাকবে। তখন থেকেই ইউরোপের রাষ্ট্রচিন্তায় ‘Secularism’ ধারণাটির উদ্ভব হল। ভারতবর্ষে এই পরিস্থিতির কখনও সৃষ্টি হয়নি। বরং ধর্মগুরুরা বা সন্ন্যাসীরা কোনওদিন রাষ্ট্রসংক্রান্ত বা রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। তাঁরা সকলের প্রণম্য ছিলেন। ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ, সমস্ত ধর্মমতে বিশ্বাসী মানুষদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা। কেউ নাস্তিক হতে পারেন, আবার যে কোনও ধর্মমতে বিশ্বাসী হতে পারেন। রাষ্ট্র মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবে না। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সবচেয়ে ভালভাবে ও সংক্ষেপে ব্যক্ত হয়েছে চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের প্রদত্ত ভাষণে। বিবেকানন্দ বলছেন: ‘‘যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।’’ এটাই হল প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা।
আরও পড়ুন-ভারতীয় স্বামীকে গুপ্তচরবৃত্তিতে নামার জন্য চাপ দিতেন রুশ স্ত্রী
দুঃখের কথা, পারস্পরিক সহনশীলতা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবেশ কয়েক বছর ধরে নষ্ট হতে চলেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, অপপ্রচার চলছে। ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিতে অকারণে বা তুচ্ছ কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। বুলডোজার দিয়ে তাঁদের ঘর-বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও মানা হচ্ছে না। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধন শিথিল হচ্ছে। শ্রদ্ধেয় উপরাষ্ট্রপতির মতো একজন বিচক্ষণ, বিদগ্ধ ও আইন বিশারদ যদি এই ধরনের মন্তব্য করেন, তাহলে জনমানসে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে এবং ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিষাক্ত হতে পারে, যেটা আদৌ কাম্য নয়।