শান্তিপূর্ণ ভোটের অধিকারের দাবিতে সরব হওয়া নাগরিকদের প্রতি পুলিশের বেদম প্রহার, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের নিক্ষেপ আর পুলিশ-সিপিএমের যৌথ সন্ত্রাস চলেছিল সেদিন। তারিখ ছিল ২১শে জুলাই, সালটা ছিল ১৯৯৩। বর্ষীয়ান পাঠককুল যাঁরা এই প্রতিবেদন পাঠ করছেন, তাঁরা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন, ১৯৭৭ সালের পরবর্তী সময় থেকে সিপিএম নামক দল বাংলায় ক্ষমতার মসনদে বসার পর বাংলার বুকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ধারণাকে অবলুপ্ত করে দিয়েছিল। বামেদের সেই ভোট লুঠের কারবারকে বিনষ্ট করতে ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন রাজপথে নেমেছিলেন, তাঁর স্লোগান ছিল ‘নো আইডি কার্ড, নো ভোট’। রাজপথের বুকে সেদিন চলেছিল রক্তের হোলি খেলা, নেমেছিল অন্ধকারের বাতাবরণ। তবে, সেই অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল নতুন স্বপ্নের আলো, সিপিএমকে বাংলা রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে উৎখাত করে দেওয়ার স্বপ্ন। আজ ২০২৫ সালের বুকে দাঁড়িয়ে আপামর গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
পাঠককুলের মনে হতে পারে ২১শে জুলাইয়ের সেই শপথের গুরুত্ব কি তাহলে ফিকে হয়ে গেছে? মনে রাখবেন যতদিন গণতন্ত্র হত্যাকারী সিপিএম-বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো থাকবে এবং তার উল্টোদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গণতন্ত্রপ্রেমী, সংগ্রামী নেতৃত্বরা থাকবেন ততদিন ২১শে জুলাইয়ের শপথ বইতেই থাকবে।
সিপিএমের সন্ত্রাস, সিপিএমের দম্ভ সিপিএমকে আজ শূন্যে নিয়ে গেছে। তবে তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হয়ে পশ্চিমবাংলার বুকে নেমে এসেছে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দল। প্রতিনিয়ত খবর পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে, তাদেরকে কাঠের পুতুলে পরিণত করে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের নাম তারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করতে চাইছে। বিহার থেকে এই খেলা তাঁরা শুরু করেছে, এরপর বাংলার পালা। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছে, এই বাংলার মাটি থেকেই ১৯৯৩ সালে বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই হয়েছিল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য লড়াই। একটি সহজ সূত্র ধরিয়ে দিতে হয়, দেশের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়ন করে একটি কলেজিয়াম গঠন করার সুপারিশ করেছিলেন। সেই কলেজিয়ামে প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও প্রধান বিচারপতির থাকার কথা। কিন্তু সেই সুপারিশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রধান বিচারপতির জায়গায় রাখা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী কে? নরেন্দ্র মোদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে? অমিত শাহ। তা হলে কলেজিয়ামে কার পাল্লা ভারী? বিজেপির। নির্বাচন কমিশনার কার? বিজেপির। নির্বাচন কমিশন কার? বিজেপির।
আরও পড়ুন-লুকার সই ডায়মন্ড হারবারে, ডুরান্ডের আগে শহরে মিকেলও
বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন কমিশনের তরফে হঠাৎ করেই রাজ্যের ভোটার তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। বিরোধীদের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, পরিযায়ী শ্রমিক— যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই দলিত, জনজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের— তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এমনকী গত লোকসভা নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও এখন নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের প্রতি আস্থা তলানিতে ঠেকার পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। মোদি তাঁর প্রচারে বালাকোটে বায়ুসেনার অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে ভোট-প্রার্থনা করেছিলেন এবং রাহুল গান্ধী ওয়েনাড় থেকে প্রার্থী হওয়ায়, সেই কেন্দ্রকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু কমিশন এইসব অভিযোগ খারিজ করে দেয়, যদিও তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা এ-বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। তার পরিণামস্বরূপ লাভাসা এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আয়কর বিভাগের তদন্ত শুরু হয়, তাঁকে বিদেশে বদলি করে দেওয়া হয় এবং শেষে তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন।
আশঙ্কার উদ্রেক হয় যখন শুনি দিল্লির জয় হিন্দ কলোনিতে যেখানে মূলত বাঙালি শ্রমিকেরা বসবাস করেন দশ দিনের বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে, দরিদ্র মানুষের পানীয় জল নেই, গর্ভবতী মায়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বাংলাভাষী হওয়ার জন্য তাঁদের এই শাস্তি, এই ভোগান্তি। বুকের ভিতর ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে যখন শুনতে পাই আমার বাংলার মায়েদের, বোনেদের, ভাইয়েদের বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিজেপি সরকার কোনও প্রামাণ্য নথির পরোয়া না করে তাঁদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ জুলাই প্রতিবাদ সভামঞ্চ থেকে স্পষ্টতই বলেছেন শেষ রক্তবিন্দু অবধি তিনি বাঙালির গরিমাকে, বাঙালির অস্মিতাকে রক্ষা করে যাবেন। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামী ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন শুধুমাত্র বিজেপিকে পরাস্ত করার নির্বাচন নয়, এই নির্বাচন বাঙালির অধিকার রক্ষা, বাঙালির সম্মান রক্ষা ও বাঙালির অস্মিতাকে রক্ষা করার নির্বাচন।
এই পক্ষপাতিত্বের মধ্যে, এই অনিয়ম- বেনিয়মের মধ্যে, এই বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী আবহাওয়ার মধ্যে আমরা বাংলার মানুষ বাঁচতে চাই না। তাই এই একুশের শপথ হোক— বাংলার বুক থেকে বিজেপিকে উৎখাত করার! এই একুশের শপথ হোক— গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার! এই একুশের শপথ হোক— চতুর্থ বারের জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনার!