মৌ বনের মৌমাছিরা

মৌমাছি শুধু মধু দেয় না, গোটা বিশ্বের পরিবেশগত ভারসাম্যের রক্ষায় এই পরাগবাহকেরা অপরিহার্য ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের গুনগুন শব্দ। কমছে মৌমাছির সংখ্যা। মৌমাছি সংরক্ষণে নিতে হবে জোরদার পদক্ষেপ। কোনও একটা দিন পালন নয়, চাই বছরভর একযোগে উদ্যোগ। লিখলেন দেবস্মিতা মণ্ডল

Must read

মৌমাছিদের গুনগুন শব্দ যেন প্রকৃতির এক অনন্য সুর, যা আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে। যে ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে নিয়ে একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান বেঁধেছিলেন ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে সেই প্রাণীগুলির গুনগুন শব্দ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এবার কাব্য নয়, কড়া বার্তা দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
মৌমাছিরা শুধুই কি আমাদের মধু দেয়
যদি আপনাদের এই ভুল ধারণা থেকে থাকে যে মৌমাছিরা শুধু মধু দেয় তাহলে এখনই সেই ভুল ধারণা মাথা থেকে বার করে ফেলুন। ওরা আমাদের খাবারের প্লেটকেও রঙিন করে তোলে। আম, আপেল, লেবু, কফি, বাদাম— এসবের উৎপত্তিতেও মৌমাছিদের ভূমিকা সরাসরি। মানে, ধরুন, যদি ওরা না থাকত, তাহলে আমাদের খাদ্য তালিকা হত এক্কেবারে হস্টেলের দুপুরের খাবারের মতো— ফ্যাকাশে, নীরস আর মন খারাপ করা। UNEP-এর মতে বিশ্বের মোট ৯০ শতাংশ বন্য ফুলের গাছ আর ৭৫ শতাংশ ফসলই নির্ভর করে এমন পরাগবাহকদের ওপর। আর এইসমস্ত ফুলগাছ বড় হয়ে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পালন করে প্রচুর বন্যপ্রাণী বাসস্থান রূপে বা খাদ্য সংস্থানের মাধ্যম হিসেবে।
মৌমাছিদের দিন
মৌমাছিদের নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক মহলে রীতিমতো বৈঠক বসেছে। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মৌমাছি দিবসও ঘোষণা করেছে। মৌমাছিদের জন্য আলাদা একটা দিন! এতদিন ভেবেছিলেন তো যে শুধু ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ফ্রেন্ডশিপ যথেষ্ট? কিন্তু না এখন মৌমাছিদেরও নিজস্ব দিবস আছে এবং এর পেছনে একটা দারুণ গল্প আছে। সেল্ভেনিয়াতে ১৭৩৪ সালের এই দিনে জন্মেছিলেন এনটন জেনশো। তিনি যত বড় হতে থাকেন তার এপিকালচার বা মৌমাছি প্রতিপালনের ওপর আগ্রহ বাড়তে থাকে। ১৭৬৯ সালের মৌমাছি প্রতিপালনকেই তিনি ফুলটাইম জব হিসেবে বেছে নেন। তাই তার সম্মানেই বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনকে মৌমাছিদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই ভদ্রলোককে আধুনিক এপিকালচারের পথপ্রদর্শক বলা হয়। ২০১৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এফএও রিজিওনাল কনফারেন্স ফর ইউরোপ সংস্থাটি মৌমাছিদের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে মৌমাছি দিবস পালনের প্রস্তাব দেয় এবং ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় মৌমাছিদের জন্য নির্দিষ্ট দিন পালন।
মৌমাছিরা আমাদের পুষ্ট করে
২০২৫-এ মৌমাছি নিয়ে আমাদের লক্ষ্যকে সম্পূর্ণরূপে জানতে হলে এক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। মৌমাছি এবং অন্যান্য পরাগ বাহকদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুব সমাজ যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেই লক্ষ্যে ‘Bee engaged with Youth’ বা যুব সমাজের সঙ্গে মৌমাছিরা জড়িত এই থিমে কর্মসূচি গড়ে তোলা হয়েছিল বিগত বছরে। মৌমাছি পালন এবং পরাগরেণু সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় যুবসমাজকে জড়িত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছিল। সেই গুরুত্বের উপর আরও অনেকটা গুরুত্ব আরোপ করেই এবং মৌমাছিদের ওপর বাড়তে থাকা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই ২০২৫ এর থিম রাখা হয়েছে ‘Bee inspired by nature to nourish us all’। যার অর্থ হল মৌমাছিরা প্রকৃতির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের পুষ্ট করে। এই থিমের প্রধান লক্ষ্যই ছিল বিশ্বব্যাপী যুবসমাজকে মৌমাছিদের ওপর আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন করা এবং মৌমাছিদের সংরক্ষণের আরও জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া।

আরও পড়ুন-গুজরাতের বৃহত্তম রিফাইনারি এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার মুখে

বিপদটা ঠিক কোথায়?
মৌমাছিদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে আর এর জন্য দায়ী কারা? উত্তর, আমরা। আমরাই মৌমাছিদের অবাসস্থলের ক্ষতি করি। এক ফসলের মতো চাষ পদ্ধতি, অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক-এর ব্যবহার, বন ধ্বংস এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন, আক্রমণাত্মক পরজীবী ভারোয়া ডিস্ট্রাক্টর মাইট এবং অন্যান্য রোগ এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে এবং মৌমাছিদের জীবনকে একেবারে সাসপেন্স থ্রিলারে পরিণত করছে। আচ্ছা মনে করুন তো, ওরা যদি সত্যিই একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তাহলে মানবসভ্যতার একটা বিশাল অংশ হুমকির মুখে পড়বে। ইউনেস্কোর মতে, পরাগবাহকদের কমে যাওয়া মানে ভবিষ্যতের খাদ্যসংকট, জীববৈচিত্র আর পরিবেশের ভারসাম্যের ধ্বংস।
তাহলে আমাদের কী করণীয়?
সবার আগে আমাদের মৌমাছিদের জন্য একটা মৌমাছিবান্ধব পরিবেশ বা বলতে পারি এই খুদেগুলোর জন্য হ্যাপি প্লেস বানাতে হবে— সেটাই আমাদের করণীয়। যেমন বাড়ির ছাদে বা ব্যালকনিতে ফুল গাছ লাগিয়ে একটু জল রেখে দিতে পারি। কৃষির জন্য জমির পরিমাণ ক্রমাগত না বাড়িয়ে কৃষি বনায়ন (এমন একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যার মাধ্যমে একই ভূমিতে বৃক্ষ এবং ফসল ফলানো হয়) এবং আন্তঃফসল বা ইন্টার ক্রপিং (একই জমিতে বহুবিধ ফসল ফলানো হয়)-এর মতো পরিবেশবান্ধব চাষ-পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারি। স্থানীয় মৌমাছি সংরক্ষকদের কাছ থেকে মধু কিনে তাদের এই কাজে উৎসাহ দিতে পারি, কম পরিমাণে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে ওদের রক্ষা করতে পারি। মৌমাছিদের রক্ষা করা যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় সেটা সবার মধ্যে প্রচার করে সচেতনতা বাড়াতে পারি। সহজ ভাষায়, আমাদের এমন কিছু কাজ করতে হবে, যা ওদের রক্ষা করে।

আরও পড়ুন-ট্রাম্পের দাবি নিয়ে কেন্দ্র নীরব কেন?

মৌমাছি সংরক্ষণে বহির্বিশ্বের তৎপরতা
সত্যিই তো! এখনও যদি তৎপরতা না দেখানো হয় তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বাইরের অনেক সংস্থাই মৌমাছিদের প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন— যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিজ ফর ডেভেলপমেন্ট’ সংস্থাটি বিশ্ব জুড়ে জীব বৈচিত্র বজায় রাখার জন্য মৌমাছি পালনকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ইউরোপের ‘পেস্টিসাইড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’ হল একটি জনস্বার্থ ও পরিবেশগত সংগঠন। এই সংস্থাটির প্রধান উদ্যোগ হল মৌমাছি ও কৃষকদের বাঁচানো এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে কীটনাশক-মুক্ত ইউরোপ তৈরি করা।
বিভিন্ন উদ্যোগ
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে মৌমাছিদের রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য। যেমন, EFSA-এর নেতৃত্বাধীন MUST B প্রকল্প যা জিনগত এবং জৈবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মৌমাছির স্বাস্থ্য ও আচরণ সম্পর্কে তথ্য দেয় এবং টেকসই কৃষি-পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌমাছিদের রক্ষা করে। MUST B প্রকল্পের একটি গবেষণামূলক মডেল তৈরি করা হচ্ছে। নাম Apisram।
পিছিয়ে নেই ভারত
ভারতের, আন্ডার দ্য ম্যাংগোট্রি নামক সংস্থাটি গ্রামীণ কৃষকদের মৌ-চাষে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে। তারা ১০০০-এরও বেশি মহিলাদের মৌ-চাষে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যা তাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা বাড়িয়েছে।
মধুর বাজারে মিঠে বিপ্লব
রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে ভারতীয় মধুর বাজারের মূল্য ছিল প্রায় ২৫.২ বিলিয়ান টাকা, এবং আশা করা হচ্ছে ২০৩২ সালের মধ্যে এটি পৌঁছবে প্রায় ৪৮.৬ বিলিয়ন টাকায়। এই তথ্য শুধুই পরিসংখ্যান নয়— এর পেছনে আছে হাজারো মানুষের রোজগারের গল্প, গ্রামবাংলার মাটির ঘ্রাণ, আর এক ফোঁটা মধুর ভেতর লুকিয়ে থাকা আশা।
আইএমএআরসি গ্রুপের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে ভারতীয় মধুর বাজারে ৮.৪ শতাংশ হারে চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক বৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু এই বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে মানুষের জীবনের পরিবর্তন। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ার ফলে মানুষ আজকাল চিনি ছেড়ে মধুর দিকে ঝুঁকছে। ডায়াবেটিসের ভয়, ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, কিংবা শুধুই ‘প্রাকৃতিক খাবার’ খাওয়ার ইচ্ছা—সব কিছু মিলিয়ে মধু হয়ে উঠছে প্রতিদিনের সঙ্গী।
অসংখ্য বাড়ির রান্নাঘরে এখন মধু শুধু এক চামচ চায়ের জন্য নয়, বরং স্যালাড ড্রেসিং, ফেস প্যাক, এমনকী হোম রেমেডির অপরিহার্য উপাদান। যেখানেই দেখুন, প্রাকৃতিক ও জৈব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই পরিবর্তন ভারতের গ্রামীণ জীবনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও মধু ভারতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আয়ুর্বেদের প্রাচীন শাস্ত্রে মধুকে বলা হয়েছে ‘অমৃত’—স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ। তাই একে ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে আস্থা আর বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন-ফের বঙ্গােপসাগরে নিম্নচাপ, বুধবার থেকেই বাড়বে বৃষ্টি

মৌ চাষে আরও সচেতনতা জরুরি
মাণীশ বৈদ্য (সহকারী অধ্যাপক, বাণিজ্য বিভাগ, কালিয়াগঞ্জ কলেজ) এবং সংঘমিত্রা পুরকাইত (পিএইচডি স্কলার, ডায়মন্ড হারবার উইমেনস ইউনিভার্সিটি) পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে JETIR জার্নালে প্রকাশিত হয়। তাঁদের গবেষণাটি ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার চারটি ব্লকে—বংশীহারি, গঙ্গারামপুর, হরিরামপুর ও কুশমণ্ডি— ৭৪ জন মৌচাষির ওপর। এই সংখ্যাগুলি শুধু সংখ্যাই নয়, এর পেছনে আছে জীবনের গল্প, সংগ্রামের অধ্যায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মৌচাষিরা মৌমাছির গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। প্রায় ৭৫.৬৮% মৌচাষি জানেন যে মৌমাছি ফসলের পরাগায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু তবু এখনও ২৪.৩২% মানুষ জানেন না এই মৌমাছিদের প্রাকৃতিক অবদানের কথা। ৪১.৮৯% মৌচাষি জানান, তাঁরা কৃষিজমিতে মৌচাষ করার তেমন অনুমতি পান না। অনেকে অর্থের বিনিময় বা মধু দিয়ে জমির মালিকদের থেকে অনুমতি পান। সব মিলিয়ে মৌচাষ যেন এক নীরব লড়াই।
গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌচাষিরা বছরে কোটি কোটি ডলার আয় করেন পরাগায়ণ পরিষেবা দিয়ে, কিন্তু ভারতে এই সচেতনতার অভাব রয়েছে। গবেষকরা সুপারিশ করেছেন—সচেতনতামূলক কার্যক্রম, বিদ্যালয়ে মৌচাষ প্রশিক্ষণ, সরকার ও এনজিওর সহায়তা এবং সুষম কীটনাশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব।
মৌমাছিদের অবক্ষয় আমাদের পরিবেশ, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর হুমকি। এদের সংরক্ষণে একযোগে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি-উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশবান্ধব কৃষি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মৌচাষের প্রসারই হতে পারে টেকসই সমাধান। কারণ, মৌমাছিকে বাঁচানো মানে প্রকৃতিকে বাঁচানো— এবং প্রকৃতিকে বাঁচানো মানেই আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।

Latest article