জারোয়াদের বন্ধু

বঙ্গসন্তান ডাঃ রতনচন্দ্র কর। দীর্ঘদিন ছিলেন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। চিকিৎসা পরিষেবা দিয়েছেন জারোয়াদের। সুস্থ করেছেন এই উপজাতির বহু মানুষকে। হয়ে উঠেছিলেন বন্ধুর মতো। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন পদ্মশ্রী। তাঁর জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনি প্রেরণা জোগায় তরুণ চিকিৎসকদের। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

প্রাচীনত্বের এক ভাণ্ডার
আন্দামান ও নিকোবর। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই মনোমুগ্ধকর দ্বীপপুঞ্জ গঠিত ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে। সেগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৮টি জনবসতিপূর্ণ। জীববৈচিত্র এবং মানব বিবর্তনের প্রাচীনত্বের এক ভাণ্ডার। প্রায় ২০০০ বছর আগের। দ্বীপগুলিতে ছয়টি উপজাতি গোষ্ঠী রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি আদিম উপজাতি হিসাবে চিহ্নিত। আদিম উপজাতিদের মধ্যে একটি জারোয়া বা জারাওয়ারা। এই উপজাতি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী। দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জঙ্গল। জারোয়ারা মধ্য ও দক্ষিণ আন্দামানের কিছু অংশে বাস করে। একটা সময় পর্যন্ত তারা সভ্য জগতের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলত। কোনও কারণে বিরক্ত বোধ করলে বিষাক্ত তির ছুঁড়তেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না।

আরও পড়ুন-মৌ বনের মৌমাছিরা

রোগের প্রাদুর্ভাব
১৯৯০ সালের পর থেকে বহিরাগত এবং জারোয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগের হার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বহিরাগতরা তাদের এলাকায় গেলে জারোয়ারা যখন-তখন আর তির ছুঁড়ত না। বোঝার চেষ্টা করত যারা এসেছে, তারা কেমন। সমস্যা হল, জারোয়ারা যখন থেকে বহিরাগতদের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে, তখন থেকেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বাইরের নানারকম রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যেমন মাম্পস, হেপাটাইটিস ই ইত্যাদি। শুরু হয়েছে এইসব রোগের মহামারী। কারণ এইসব রোগের বিরুদ্ধে তাদের শরীরে কখনও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়নি। যদিও উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, মানসিক অসুস্থতা এবং হৃদরোগের মতো রোগগুলি তাদের কাছে অপরিচিত ছিল। বলা যায়, কার্যত তারা এই রোগগুলো থেকে ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। তবে ত্বকের ঘা, কৃমির উপদ্রব এবং কুমিরের আক্রমণে আঘাতগুলি প্রচলিত রোগ ছিল। রোগ সারাতে প্রতিটি পরিবার ‘আলাম’ তৈরি করত, যা ছিল লালমাটির গুঁড়ো। শুয়োরের চর্বির সঙ্গে মিশিয়ে হালকা ব্যথা এবং ব্যথায় প্রয়োগ করা হত।
মহামারীর কারণে
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ঘটে একটি ঘটনা। এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে জোর আঘাতে এনমাই নামে এক জারোয়া যুবকের পা ভেঙে যায়। সে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। নজরে আসে বসতি স্থাপনকারীদের। তারা সাহস করে এনমাইকে পোর্ট ব্লেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে এনমাইয়ের দু’মাস ধরে চিকিৎসা হয়। সুস্থ হওয়ার পর, তাকে জারোয়াদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে না দেখতে পেয়ে জারোয়ারা ধারণা করেছিল যে, এনমাই হয়তো মারা গেছে। দু’মাস পর ফিরে এসে এনমাই জারোয়াদের কাছে বিস্তারিতভাবে জানায়, হাসপাতালে কীভাবে তার যত্ন নেওয়া হয়েছে এবং তাকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। তার গল্প শোনার পর, জারোয়ারা অপরিচিতদের উপর তির-ধনুক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৯৮ সালের শুরুতে তারা অন্যদের সঙ্গে আরও ভালভাবে মেলামেশা শুরু করে। সমস্যা হল, সভ্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করার পর তারা হামের মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। অসংখ্য মানুষ মারা যায়। তখন জারোয়া জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, হামের মহামারীর কারণে একদিন তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জানা যায়, এই প্রাদুর্ভাবের সময় ১০৮ জন জারোয়া হামে আক্রান্ত হয়েছিল। কপালে ভাঁজ পড়ে তাদের।

আরও পড়ুন-দুই বিষয় দুই বই

চিকিৎসক নিয়োগের অনুরোধ
সেই সময় তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কল্যাণ কর্মীরা। হামের হাত থেকে উপজাতিদের রক্ষা করার জন্য তাঁরা কেন্দ্রকে ওই অঞ্চলে চিকিৎসক নিয়োগের অনুরোধ করে। সবকিছু জানার পর কেন্দ্র বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। যদিও খুব কম সাড়া পাওয়া যায়। তখন এগিয়ে এসেছিলেন একজন সাহসী বঙ্গসন্তান, ডাঃ রতনচন্দ্র কর। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের ভূমিপুত্র। ১৯৫৪ সালের ৪ মে জন্ম। ডাঃ নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রাক্তনী। ১৯৭৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। একটা সময় তিনি কোনিয়াক উপজাতির সঙ্গে নাগাল্যান্ডে কাজ করেছিলেন। অভিজ্ঞতা ছিল। সেই কারণেই জারোয়া উপজাতির সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে কেন্দ্র তাঁকে মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কদমতলা হাসপাতালের জন্য নির্বাচিত করে। যাতে তিনি জারোয়াদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে পারেন। জারোয়া উপজাতি কদমতলা হাসপাতালের কাছেই একটি ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গলে বাস করত।
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ
বহিরাগতদের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হলেও, জারোয়া উপজাতির মানুষেরা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা অজানা ছিল না ডাঃ রতনচন্দ্র করের। তবু তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন এবং রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ধীরে ধীরে জারোয়াদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা গড়ে ওঠে। তিনি করতে থাকেন তাদের চিকিৎসা। ২০০৩ সালে তাঁকে পোর্ট ব্লেয়ারে বদলি করা হয়। কিন্তু তারপরেও নিয়মিত তিনি পৌঁছে যেতেন প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে। ২০০৬ সালে তাঁকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক বিভাগে ডেপুটি ডাইরেক্টর (জনজাতি কল্যাণ) করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নেইল দ্বীপে তাঁকে নিয়োগ করা হয়। ধীরে ধীরে তিনি উপজাতি সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে সক্ষম হন।
জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাশীল
সরকারও পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কারণ, বিশ্ব জুড়ে জারোয়াদের বিলুপ্তির আশঙ্কা ছিল। ডাঃ রতনচন্দ্র কর উপজাতির সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে তাদের ভাষা আয়ত্ত করেন। সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তুলতে তিনি তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতেন। জারোয়াদের বহু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি তাদের থেরাপিউটিক পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তারা কীভাবে প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহার করে, তা সরাসরি দেখেছিলেন। তবুও, তিনি এবং তাঁর দল জারোয়াদের জীবন বাঁচাতে সমসাময়িক ওষুধ ব্যবহার করেছিলেন। এককথায় তিনি জানোয়ারদের জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

আরও পড়ুন-এই একুশের শপথ হোক

জঙ্গল থেকে হাসপাতালে
যেখানেই গেছেন, তিনি যে তাঁদের বন্ধু, উপকারের জন্য এসেছেন, জারোয়াদের বোঝাতে পেরেছিলেন ডাঃ রতনচন্দ্র কর। তাই তাঁর কাছে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল জারোয়ারা। অনেকেই সাঁতার কেটে বা দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে তাঁর কাছে আসত। চিকিৎসা পরিষেবা নিত। ডাঃ রতনচন্দ্র করও কখনও কখনও তাদের কাছে পৌঁছে যেতেন নৌকায় চেপে অথবা পায়ে হেঁটে। একটা সময়ের পর ভাষাগত সমস্যা অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, জারোয়াদের কেউ কেউ নাকি বাংলা ভাষা বুঝত। বাংলায় কথাও বলতে পারত। দ্বীপাঞ্চলে বসে উপজাতির মুখে বাংলা ভাষা শুনে অবাক হতেন ডাঃ রতনচন্দ্র কর। মনে মনে গর্ব অনুভব করতেন মাতৃভাষার জন্য। প্রতিদিন তিনি ১৫-২০ জন রোগী দেখতেন এবং ওষুধ দিতেন। হামের প্রাদুর্ভাব থাকাকালীন তিনি প্রতিদিন ৪০ জন পর্যন্ত রোগী দেখতেন। প্রয়োজনে তিনি গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের জঙ্গল থেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। চিকিৎসার পাশাপাশি অস্তিত্বের সংকটেও তাদের পাশে থেকেছেন তিনি।
জীবনের লক্ষ্য
ডাঃ রতনচন্দ্র কর কদমতলা হাসপাতালে একটি পরিবেশবান্ধব ভবন, কংক্রিটের তৈরি মেঝে-সহ জারোয়া ওয়ার্ড তৈরি করেছিলেন। বাঁশ, খড় এবং শুকনো গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে তাদের বাড়ির প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হয়েছিল। ছয়জন ব্যক্তির জন্য একটি শাওয়ার এবং ওয়ার্ডের কেন্দ্রে একটি অগ্নিকুণ্ড-সহ একটি সাধারণ বাথরুম তৈরি করেছিলেন। কেবলমাত্র ডাঃ রতনচন্দ্র করের কর্মীদেরই সীমাবদ্ধ এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন থাকত। আদিবাসী সদস্যরা প্রথমদিকে এলাকাটিকে ভুল ব্যাখ্যা করেছিল এবং এটাকে কারাগার বলে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু একটা সময় তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত, ডাঃ রতনচন্দ্র করের আন্তরিক প্রচেষ্টায় উপজাতিগুলি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। জারোয়া জনগণের সেবা করাই ডাঃ রতনচন্দ্র করের জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। সেই লক্ষ্যে তিনি সফল হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-ট্রাম্পের দাবি নিয়ে কেন্দ্র নীরব কেন?

ছড়িয়ে পড়ে নাম
আন্দামানের উত্তর সেন্টিনেল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপে বসবাসকারী জারোয়াদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতির স্বীকৃতিস্বরূপ ডাঃ রতনচন্দ্র করকে পদ্মশ্রী প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর হাতে পদ্মশ্রী সম্মাননা তুলে দেন। এরপর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। তাঁর জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনি প্রেরণা জোগায় আজকের তরুণ চিকিৎসকদের। অবসর গ্রহণ করেছেন ডাঃ রতনচন্দ্র কর। বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি ‘জারোয়াস অফ দ্য আন্দামান’ নামে একটি বই লিখেছেন। যেখানে তাঁর কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। জারোয়াদের কথা উঠলেই তাদের ভয়ঙ্কর রূপের ছবি জনমানসে ফুটে ওঠে। ডাঃ রতনচন্দ্র কর খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের মানবিক রূপ। পেয়েছেন তাদের সারল্য এবং সংস্কৃতির পরিচয়। বইয়ের লেখাগুলোয় প্রকাশ পেয়েছে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। গল্প মনে হলেও, একশো শতাংশ সত্যি।

Latest article