রবীন্দ্রনাথ ঘোষ
একুশে জুলাই ১৯৯৩-এর দিনটি বাংলার মানুষের কাছে এক কালো দিন, স্মরণীয় দিন৷ ২১শে জুলাই মানেই একটা আবেগ। প্রত্যেকটা মানুষের জন্য পরিচয়পত্র এবং তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধের দাবি-সহ বিভিন্ন দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন আজকের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন যুবনেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-এক নারীর আন্দোলনের ধাত্রীভূমি
দিদির ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন সারা রাজ্য থেকে লাখো লাখো মানুষ ওই কর্মসূচিতে হাজির হন। পাঁচটি জায়গায় জমায়েত করে নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু হয়। আমি তখন কোচবিহার জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি, কয়েক হাজার দলীয় কর্মী নিয়ে আমরাও হাজির হয়েছিলাম ওই কর্মসূচিতে। কোচবিহার থেকে যোগ দেওয়া কর্মীদের দুটো ভাগে ভাগ হয়ে অর্ধেকটা বউবাজার, যেখানে রাজ্য সংগঠনের সভাপতি সুব্রত বক্সি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আর বাকিটা কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে, যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৎকালীন যুবনেতা মদন মিত্র, সৌগত রায় প্রমুখ। আমি বউবাজার থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেস ক্লাবের সামনে যাই, তখন একটি টেম্পোর উপর মাইক বেঁধে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখছিলেন। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চলছিল, একটু একটু করে বৃষ্টিও পড়ছিল। হঠাৎ করে বিনা প্ররোচনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে শান্তিপূর্ণ মিটিংয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চলতে থাকে। গুলিতে পরপর বেশ কিছু যুবকর্মী রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই ১৩ জন যুবকর্মীর মৃত্যু হয়, আরও শতাধিক যুবকর্মী গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হয় এবং তাদেরকে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে মিটিং ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ও সব জায়গায় মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সময় এত টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ ছিল না, কিন্তু যতটুকু ছিল তার মাধ্যমেই খবর মুহূর্তের মধ্যে সারা রাজ্য ছড়িয়ে পড়ল। তখন মোবাইল ফোনও বের হয়নি, যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ল্যান্ডলাইন ফোন। হঠাৎ করেই চারিদিকে শ্মশানের স্তব্ধতা। তারমধ্যেই খুঁজতে শুরু করলাম কোচবিহারের কর্মীদের, বিশেষ করে যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে, তার মধ্যে কেউ আবার কোচবিহারের আছে কি না। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম যে কোচবিহারের কেউ আহত হয়নি।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, যে সরকারের মূল চালিকাশক্তি ছিল সিপিআই(এম)। ক্ষমতায় এসেই সিপিআই(এম) সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে রাখে আর ভোটের সময় বুথ দখল করে ভুয়ো ভোট দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়। নাবালক-নাবালিকাদের দিয়ে ভোট দিয়ে এবং মরে যাওয়া মানুষের নামে ভোট দিয়ে তারা ভোটে জেতে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝেছিলেন যে, ভোটের পরিচয়পত্র ছাড়া ভুয়ো ভোট আটকানো যাবে না। সেইসময় নির্বাচন কমিশনার ছিলেন টি এন শেষন। দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার টি এন শেষনকে চাপ দিচ্ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপের কাছে কমিশন নতি স্বীকার করে ও দাবি মেনে ভোটারদের পরিচয়পত্র দিতে বাধ্য হয়। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের ফসল আজ সারা দেশের মানুষ ভোগ করছে, আজ ভোটার কার্ড ছাড়া কোনওকিছুই হয় না। অর্থাৎ সেদিনের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের সুবিধা আজ সারা দেশ ভোগ করছে। এই ঘটনার পর সারা রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চরম নিন্দার ঝড় ওঠে। বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নামেন। উত্তাল হয় বাংলা।
তারপর প্রত্যেক বছর ২১ জুলাই দিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। ২১ জুলাই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সারা রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে যাঁরা ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই ওই কর্মসূচিতে ছিলেন তাঁরা, যাঁরা কমপক্ষে আজও বেঁচে আছেন, এই দিনটিতে তাঁরা এই কর্মসূচিতে যাবেনই। তাঁদের কেউ ডাকুক আর না ডাকুক। কারণ, এই দিনটা একটা আবেগের দিন। আজও যদি ভোটার পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা না হত, দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এই আন্দোলন না করতেন, তবে আজও হয়তো বামফ্রন্ট সরকারকে হারানো সম্ভব হত না। তাই দিদিকে স্যালুট জানিয়ে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা সমাপ্ত করলাম।