অমর শহিদের রক্ত-রাঙানো একুশে জুলাই, ভুলি নাই, মোরা ভুলি নাই…

‘আপনারা’ মানে ‘রাত দখলে’র ডাক দেওয়া বঙ্গ বিবেক হতে চাওয়া মানুষজনেরা।

Must read

দেবাশিস পাঠক

ধর্মতলায় দিন দুপুরে
তেরোটি যুবা খুন হলেন,
ধর্মতলা নয় তা অনেক দূরে
আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
মেয়ো রোডে চৌরঙ্গিতে
বাম-পুলিশ খুন করেন
এবং যখন মদতদাতা বাম নেতারা
শহিদ যুবাদের ভ্রান্তি খোঁজেন
আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
খুনখারাপি রাহাজানির
বাম চূড়ামণি যখন বলেন
এমনটা তো কতই ঘটে
নাই বা এতে নাক গলালেন!
আপনারা সব কোথায় ছিলেন?
‘আপনারা’ মানে ‘রাত দখলে’র ডাক দেওয়া বঙ্গ বিবেক হতে চাওয়া মানুষজনেরা।
‘আপনারা’ মানে ‘রামরেড’রা যাঁরা পদ্ম পার্টিকে ভোট দেন আর প্রগতিশীলতার ঝাণ্ডা ধরে ন্যাকা সাজেন, তাঁরা।
‘আপনারা’ মানে ‘অধুনালুপ্ত’ বামফ্রন্টের ছোটো শরিককুলের মেজ সেজ ন রাঙা জ্ঞানী-গুণীরা, যাঁদের সন্ধান তার অনুবীক্ষণ যন্ত্রও দিতে পারে না, তাঁরা।
‘আপনারা’ মানে বাংলার বৌদ্ধিক বিকাশ-বৃদ্ধির স্বঘোষিত বামাচারী পুরোহিতরা।
আর ‘ধর্মতলায় দিন দুপুরে তেরোটি যুবা খুন হলেন’ যেদিন, সেই দিনটা ছিল ২১ জুলাই, ১৯৯৩। হিংস্র বাম শাসনের ন্যক্কারজনক চেহারা অগোপন হওয়ার দিন।

আরও পড়ুন-নেত্রীর লড়াই-আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে হাওড়া স্টেশন চত্বরে প্রদর্শনী

‘নো আইডেন্টিটি কার্ড নো ভোট’ আওয়াজ তুলে বাংলার শাসনব্যবস্থায় ভরকেন্দ্র মহাকরণ অভিমুখে মিছিলে স্লোগানে ভরা অভিযানে শামিল হওয়ার দিন।
জ্যোতি বসুর সরকার, দানবিক বামফ্রন্ট সরকার সেদিন বলেছিল, হত্যালীলার সপক্ষে সাফাই দিয়েছিল, সশস্ত্র যুবকেরা সেদিন মহাকরণ দখল করতে আসছিল। জননেত্রীর নেতৃত্বে জনতা তাণ্ডব চালাবে বলে এগোচ্ছিল। আর সেই ‘হিংস্র’ জনতার কাছ থেকে উদ্ধার করা দ্রব্য সামগ্রীর ‘সিজার লিস্ট’ আরও সাক্ষ্য দিচ্ছে, পুলিশ সেদিন মহাকরণমুখী হিংস্র জনতার কাছ থেকে উদ্ধার করেছিল ১৭টা না-ফাটানো বোমা, একটা পাইপগান, দুটো ভোজালি, দুটো তলোয়ার, একটা চপার আর একটা ক্ষুর। এই নাকি সশস্ত্র জনতার মহকরণ দখলের জন্য প্রয়োজনী অস্ত্র সম্ভার! কত্তা, আর কয়েন না ঘুড়াতেও হাসবো।
গুলি চালিয়ে সেদিন খুন করেছিল জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ। আর বিধানসভার রেকর্ড বলছে, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১-তে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ওই জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘ডাক্তার (বিধানচন্দ্র) রায় ও কালীপদ মুখার্জি কন্ট্রোলরুমে বসে অর্ডার দিলেন ছাত্রদের লাঠি পেটা করতে। আপনারা চরম অপরাধী। যদি আপনারা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির এতই ভক্ত হন তাহলে একটা পাবলিক এনকোয়ারি করলেন না কেন?’
২৯ জুলাই, ১৯৬৯-এ ওই জ্যোতি বসুই বিধানসভায় দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলেছিলেন, ‘পুলিশবাহিনী আমাদের হাতে অত্যাচারের হাতিয়ার হবে না।’
আর ক্ষমতায় এসে জ্যোতি বসুর লালফ্রন্ট সরকার কী করেছিল? মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তু হত্যা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ১৯৯৩-তে ১৩ জন ছাত্র যুবককে হত্যার পরেও সেই হিংসার তাণ্ডব থামেনি। ২০০০-এ নানুর গণহত্যা, ২০০১-এ ছোট আঙারিয়াতে ১১ জন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীকে হত্যা, ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে গণহত্যা, ২০১১-তে নেতাইয়ে গণহত্যা, একের পর এক হিংসার বিকৃত মুখব্যাদান। জ্যোতি বসুর পরম্পরা বহন করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও।
একদা পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার ঘটনায় যিনি ‘পাবলিক এনকোয়ারি’র দাবি করেছিলেন গণতন্ত্রের অভিজ্ঞান হিসেবে, তিনি ১৯৯৩-তে ১৩ জন শহিদের শরীর পুলিশের গুলিতে লাশ হয়ে যাওয়ার পর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের অধীনে প্রশাসনিক তদন্তের আদেশ দিয়ে দায় সেরেছিলেন। খুনিকেই খুনের নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীকে শনাক্ত করার নাটক করেছিলেন।
হ্যাঁ! এটা নাটকই ছিল। কারণ, ১৯৭৮-এই জাতীয় পুলিশ কমিশন স্পষ্ট বলে দিয়েছিল, পুলিশের গুলিতে দুজনের বেশি লোক মারা গেলে বাধ্যতামূলকভাবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বসাতে হবে।
সেই সুপারিশকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সেদিন জ্যোতি-বুদ্ধ ‘নাটক’ই করেছিলেন।
কোন কালে উৎপল দত্ত মশাই ‘ব্যারিকেড’ নাটকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পুলিশ কখনও গুলি চালায় না, গুলি চালাতে বাধ্য হয়। অথচ আজও সব্বাই ‘ভুল’ করে বলে, ’৯৩-এর ২১ জুলাই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।
কারা মারা গিয়েছিল সেদিন?
রঞ্জিতকুমার দাস, বয়স ২৫, বাবার নাম রত্নেশ্বর দাস, বাড়ি গাইঘাটায়।
প্রদীপ রায়, বয়স ৩২, বাবার নাম নবীন্দ্র রায়, বাড়ি কলকাতার কসবায়।
শ্রীকান্ত শর্মা, বয়স ৪৪, বাবার নাম রামরতন শর্মা, বাড়ি কলকাতার কসবা অঞ্চলেই।
রতন মণ্ডল, বয়স ৫০, বাড়ি সোনারপুর।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বয়স ২০, বাবা বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বাড়ি যাদবপুর। ম্যাটাডোর থেকে নামিয়ে পুলিশ এঁকে হত্যা করে।

আরও পড়ুন-প্রয়াত সৌদির ‘ঘুমন্ত’ রাজকুমার

অসীম দাস, বয়স ২৫, বাবা গৌরাঙ্গ দাস, বাড়ি চুঁচুড়া।
বিশ্বনাথ রায়, বয়স ২৩, বাবা মদন রায়, বাড়ি বরানগর।
কেশবচন্দ্র বৈরাগী, বয়স ৩০, কাঁচরাপাড়ার রেলকর্মী।
দিলীপ দাস ও বন্ধন দাস, বাড়ি উত্তর কলকাতায়।
মুরারি চক্রবর্তী, কলকাতার মেট্রো সিনেমার সামনে পড়েছিল এই অজাতশত্রু মানুষটার লাশ।
বাকি দুই শহিদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের—
ইনু মিঞা আর আবদুল খালেক।
নিথর ত্রয়োদশকে দেখলে উইলফ্রেড আওয়েন ফের প্রশ্ন করতেন, করতেনই, “Are limbs, so dear achieved, are sides,/ Full-nerved still warm, too hard to stir?/ Was it for this the clay grew tall?”
[অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি, যেগুলি যত্নলব্ধ, পার্শ্বদেশগুলি পূর্ণক্ষম স্নায়ুসম্পন্ন— এখনও উষ্ণ— এত শক্ত হয়ে যায়নি তো যে নাড়ানো যাবে না? এজন্যই কি এই মাটির পৃথিবীতে মানুষ বেড়ে ওঠে]
সেদিন কুণাল ঘোষের তৎপরতায় জননেত্রীকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে না নিয়ে গেলে তিনিও প্রাণে বাঁচতেন না।
১৩ মে, ২০১১। ৩৪ বছরের হিংস্র বাম জমানার অবসান। মা-মাটি-মানুষের সরকার গঠনের দিন। মুখ্যমন্ত্রিত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেবার কিন্তু আলাদা কোনও দিনে পালিত হয়নি বিজয় উৎসব।
দুমাস পরের ২১ জুলাইকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল জয়নিনাদ ঘোষণার জন্য।
এই একটা ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় ২১ জুলাইয়ের তাৎপর্য। ২১শের পরম্পরা।
২১ জুলাই দিনটি তাই প্রতিবাদের ভাষাকে বাঙ্ময় করে তোলার দিন। ২১ জুলাই যে ছিল বাংলার মানুষের কথা বলার দিন। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই ছিল এ-রাজ্যে স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদ জানাতে বাংলার যৌবনের আহুতি দেওয়ার দিন।
২১ জুলাই তাই কেবল শোকের দিন নয়। শোকের অশ্রুকে শপথ নেওয়ার যজ্ঞাগ্নিতে পরিণত করার দিন।
আমাদের শপথের পবিত্র স্বাক্ষরে নতুন সূর্য শিখা জ্বলবে / আমাদের সংগ্রাম চলবে।
মমতাময় আন্দোলনের যে মৃত্যু হয় না।
একুশে জুলাই অমর রহে।

Latest article