পর্যটনেও পশ্চিমবঙ্গ আজ স্বাবলম্বী

মোদিজি বাংলায় এসে এখানকার পর্যটন শিল্পে উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলে গেলেন। কিন্তু কেউ বুঝি ওঁকে বলে দেননি, বাংলার পর্যটনে ইতিমধ্যে বিপ্লব এনে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে। সেই কথাটাই আজ তুলে ধরলেন জিয়ান কর্মকার

Must read

ভারতবর্ষ তার অপার সৌন্দর্যের প্রতীক। আর সেই সৌন্দর্যের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারত। সেই উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি অংশ হল উত্তরবঙ্গ। যেখানে হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা একসাথে অবস্থান করে। সারাবছর অগণিত পর্যটকদের আনাগোনা থাকে এই শ্বেতশুভ্র, জঙ্গল ও পাহাড়ি ঝর্নার স্বর্গে। শুধু উত্তরবঙ্গই নয়, ভূস্বর্গ কাশ্মীর ও এই মায়াবী স্বর্গের বাইরে নয় এবং পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় অন্যতম। তবে পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) উত্তরবঙ্গে হোক বা কাশ্মীর, স্থানীয় সৌন্দর্যের বিনিময়ে কোনও অঞ্চল যে এতটা উন্নত হতে পারে তা পর্যটন কেন্দ্রগুলো দর্শন না করলে বোঝা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন যে কোনও রাজ্যের অর্থনীতিতে অক্সিজেনের জোগান দেয়। ভারতবর্ষের প্রতিটা রাজ্যেই এত শৈল্পিক অনুকরণ আছে বা বলা ভাল এত স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে যে পর্যটকুল সেই আকর্ষনে বারংবার ভারতে ছুটে আসে। তবে ভারতবর্ষের পর্যটন মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও জম্মু-কাশ্মীর এক আলাদাই মাত্রা রাখে, কারণ এই দুটি স্থানে স্থাপত্য বাদ দিলেও প্রকৃতির এত মনোমুগ্ধকর বৈচিত্রে সমৃদ্ধ যে সারা বছর পর্যটকগণ ছুটে আসে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে। তবে প্রকৃতির সাজানো কোনও কিছু আরও সমৃদ্ধ করার জন্য স্থানীয় সরকারকে অনেকটাই পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হয়। তার জন্য রাজ্যের পর্যটন বিভাগ-এর ভূমিকা থাকে অপরিসীম।
পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন বিভাগ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে দক্ষতার সাথে নানান নীতি প্রণয়ন করে যাচ্ছে বিগত এক দশক ধরে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে পর্যটনের ঢালাও সৌন্দর্যের অবস্থান সেখানকার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটন নির্ভর। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে, দারিদ্র্য দূর করে এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয়দের দক্ষতা ও জীবিকা অর্জনে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। পর্যটনের একটি প্রধান দিক হল স্থানীয়ভাবে থাকার সুযোগ-সুবিধা। ওয়েস্ট বেঙ্গল হোমস্টে ট্যুরিজম পলিসি ২০১৭ (সংশোধিত ২০১৯ এবং ২০২২)-এর মাধ্যমে হোমস্টেগুলো পরিষেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। বর্তমানে পর্যটন, বন এবং আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগ দ্বারা মোট ৫৩২২টি হোমস্টে নিবন্ধিত হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রায় ৪১,৩২০ জনের ( প্রত্যক্ষ ২৫,৮২৫ জন এবং পরোক্ষ ১৫,৪৯৫ জন) কর্মসংস্থান হয়েছে। হোমস্টে পর্যটনের ক্ষেত্রে CAGR (Compound Annual Growth Rate) বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশের মতো, যা দেশের মধ্যে অন্যতম। রাজ্যের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে হোটেল, লজ, গেস্ট হাউস, রেস্টুরেন্টগুলোর দেখভাল এবং পরিচালনার জন্য পর্যটন দফতরের অধীনে ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড সর্বদা প্রচেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র তৈরিতে সচেষ্ট থাকে। ঠিক এমন ভাবেই ২০২৪-এও কিছু নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে যেমন পুরুলিয়ার মুরগুমা পর্যটন কেন্দ্র, বাঁকুড়ার বারোঘুটু, রামপুরহাটের তারাবিতান ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স ইত্যাদি। একটা বিষয় এখানে না বললেই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার বারংবার দাবি করে এসেছে যে কাশ্মীর এখন শান্ত, কিন্তু কাশ্মীর যে কাশ্মীরেই আছে তা পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। কাশ্মীরের অর্থনীতির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পর্যটন ব্যবসা। সেই পর্যটনের উপর যে আঘাত নেমে এসেছে তার দায় কার?
ভরা মরশুমেও আজ কাশ্মীর পর্যটক শূন্য। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহও এখন চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে। কারণ জম্মু-কাশ্মীরের গ্রামীণ এলাকার বহু মানুষের রুটি রোজগারের একমাত্র পথ এই পর্যটন। তাই জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও এসেছেন এবং তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য। বাংলার (West Bengal) মানুষের একটা বড় অংশ কিন্তু প্রতিবছর জম্মু-কাশ্মীরে বেড়াতে যান, সেটা যাতে বন্ধ না হয় সেই বিষয়েও তিনি সচেষ্ট। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অধীনে ২০১৪-১৫ সালে ‘প্রসাদ প্রকল্প’ চালু হয়। এই প্রসাদ প্রকল্পের অর্থ হল ‘তীর্থ যাত্রা পুনর্জাগরণ এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি অভিযান’। এর উদ্দেশ্য হল ভারতবর্ষ জুড়ে যে ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো আছে তার সমৃদ্ধকরণ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কি এমন কোনও ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র নেই যে এই প্রসাদের আওতায় আসতে পারে?
ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত প্রসাদ প্রকল্পে মোট ১৬৪৬.৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে তার মধ্যে ১০৩৬.৯৬ কোটি টাকা খরচও হয়েছে এই প্রসাদ প্রকল্পের আওতায়। তবে মজার বিষয় হল ভারত সরকারের যে দুটি রাজ্য পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র বললেই চলে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও জম্মু-কাশ্মীর এই দুই রাজ্যে মাত্র একটি করে জায়গায় প্রসাদ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে হযরতবল মাজারের উন্নয়ন এবং পশ্চিমবঙ্গে বেলুড় মঠের উন্নয়ন। পশ্চিমবঙ্গে এত সতীপীঠ এবং ধর্মীয় স্থান থাকা সত্ত্বেও এই প্রকল্পে বরাদ্দ নেই।
পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সতীপীঠ যেমন কালীঘাট (কলকাতা), কঙ্কালীতলা (বীরভূম), নলহাটি (বীরভূম), বক্রেশ্বর (বীরভূম), তারাপীঠ (বীরভূম), এছাড়াও আরও কত। প্রত্যেকটি দর্শনীয় স্থান আজ সুসজ্জিত। এমনকী কালীঘাট ও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্কাইওয়াক এবং নতুন যোগ হয়েছে জল্পেশ মন্দিরের স্কাইওয়াক, আজ যা পর্যটন মানচিত্রে আলাদাভাবেই সমাদৃত। যেখানে গুজরাতের চারটি, উত্তরপ্রদেশে ছটি, উত্তরাখণ্ডের তিনটি ধর্মীয় স্থানে এই প্রসাদ প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দ পেয়েছে সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ঝুলি সেই শূন্যই। পশ্চিমবঙ্গ নামটা কিন্তু বিশ্ববাসীর মননে গেঁথে গেছে, বিশেষ করে সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের মেলবন্ধনে যে এত সমৃদ্ধ হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, তাই হয়ত রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব ট্যুরিজম বিভাগ অনুমোদিত প্যাসিফিক এরিয়া রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন পশ্চিমবঙ্গকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক পর্যটন গন্তব্যের সম্মান দিয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও কেন্দ্রের পর্যটন বিভাগের বরাদ্দে পশ্চিমবঙ্গের কোনও নাম নেই। বর্তমানে আরও কিছু নতুন প্রকল্প প্রসাদ স্কিমের আওতায় আনা হয়েছে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রকল্প নেই। এত বঞ্চনা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) কিন্তু পিছিয়ে যায়নি বরং সঠিক পরিকল্পনা ও নিজস্ব তহবিলের উপর ভর করে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু আজ স্বাবলম্বী এবং পর্যটন শিল্পে বলতে গেলে বিপ্লব এনেছে। এখন তাবড়-তাবড় শিল্পপতিদের চোখ কিন্তু বাংলার এই পর্যটন শিল্পে।

আরও পড়ুন: প্রয়াত ‘ব্ল্যাক সাবাথ’-এর ফ্রন্টম্যান ওজি অসবোর্ন

Latest article