দেবতাদের প্রিয় মাস শ্রাবণ (Shrabon) মাস। এই মাসের পূর্ণিমাতে শ্রবণানক্ষত্রটি চাঁদের সাহচর্যে থাকে বলে এই মাসের নাম শ্রাবণ। শ্রাবণ শব্দের উৎসে রয়েছে শ্রবণ। এ-মাস যাবতীয় শুভ কথা শ্রবণের মাস। শিব হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা। ঈশ্বরের সৃজন পালন ও সংহারে ত্রিশক্তি যথাক্রমে ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও মহাদেবের এই তিন দেবতার রূপে পরিচিত ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন বিষ্ণু পালন করে আর শিব ধ্বংস করেন।
শিব পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে শিব স্বয়ং ঈশ্বর রূপে বন্দিত হয়েছেন। পুরাণ মতে, হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পবিত্র মাস হল শ্রাবণ মাস। এই মাসটি শিবকে উৎসর্গ করা হয়। শ্রাবণ মাসে প্রতি সোমবার বা গোটা মাস জুড়ে শিবের পুজো করার জন্য আমবাঙালি-সহ গোটা ভারতবর্ষের মানুষ অধীর আগ্রহে থাকেন।
শ্রাবণ (Shrabon) মাসকে বলা হয় মনস্কামনা পূরণের মাস। হিন্দু পরম্পরায় শ্রাবণের পবিত্র মাসে কিছু আচার পালন করলে যাবতীয় মনস্কামনা পূর্ণ হয় এমন ধারণা আবহমানকালের লক্ষ লক্ষ মানুষের। পুণ্য ফলদায়ী পবিত্র মাসও বলা হয় শ্রাবণকে। এই মাসের প্রতিটি দিন শুভ এবং বিশেষ দিন।
হিন্দু সংস্কৃতিতে সমুদ্রমন্থনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অপরিসীম।
পুরাণ অনুসারে অমরত্ব লাভের জন্য দেবতা আর অসুরদের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল তারই ফলশ্রুতি হিসাবে সমুদ্রমন্থন হয়। এবং সেই মন্থনে অমৃতের সঙ্গে আসে বিষ। যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
শ্রাবণ মাসেই ঘটেছিল সমুদ্রমন্থন। মন্থনের ফলে উঠে আসা বিষকে নিজকণ্ঠে ধারণ করে মহাদেব সৃষ্টিকে রক্ষা করেন। এর প্রভাবে মহাদেবের কণ্ঠ নীল হয়ে ওঠে, সেজন্যই মহাদেবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। সেই বিষের তীব্র জ্বালা এমন ছিল যে স্বর্গের সমস্ত দেবতা শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালতে থাকেন সেই হলাহলের জ্বালা কমানোর জন্য। এই জন্যেই এই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল, দুধ, দই, ঘি, পঞ্চগব্য দিয়ে জল প্রদানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এই মাস হল শিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাস। তিনি যেমন নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন তেমনই ভক্তদের রোগ ভোগ বা কোনও বিপদ থেকে রক্ষা করে আশীর্বাদ দেন। এই কারণেই এই মাস শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত।
পুরাণে আরেকটি ঘটনার কথাও বলা আছে, সেখানে সতী দেহত্যাগের পর আবার জন্ম নেন দেবী পার্বতী রূপে। এবং শিবকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য কঠোর সাধনা শুরু করেন। দীর্ঘ সাধনার পরে পার্বতীর অটল ভক্তিতে শিব সন্তুষ্ট হয়ে বিয়ে করতে সম্মতি দান করেন। এবং কথিত যে, শ্রাবণ মাসে শিব-পার্বতীর পুনর্মিলন হয় এই বিশ্বাস থেকেই অবিবাহিত মেয়েরা শ্রাবণ মাসে ব্রত পালন করে সুখী এবং সফল বিবাহিত জীবন লাভের আশায়। আবার বিবাহিত জীবনের সুখ-শান্তি যাতে হয় এই ফলের আশাতেও এই মাসের শিবের পুজোয় ব্রতী হন অনেকেই।
শ্রাবণ মাস ভক্তদের কাছে অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ। আবার এটাও বলা হয়ে থাকে, এই শ্রাবণ মাসেই শিব মর্ত্যে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আসেন। তাঁকে ভক্তি ও ভালবাসা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নানারকম চেষ্টা করা হয়। অভিষেক করা হয় পঞ্চামৃত অর্থাৎ দুধ দই ঘি মধু কোশাদক দিয়ে।
আরও পড়ুন: ভিন রাজ্যে হেনস্থা: বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে West Bengal Police, রইল হেল্পলাইন
যেহেতু শ্রাবণ (Shrabon) মাসে শিব মর্ত্যে আসেন তাই এই মাসে দেবাদিদেব ভক্তদের অনেক কাছে চলে আসেন। অল্পেতেই সন্তুষ্ট শিবশম্ভু তাঁর ভক্তদের মনস্কামনা পূরণের আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন। এমনটাই বিশ্বাস। এই কারণে শ্রাবণ মাসকে মস্কামনা পূরণের মাস বলা হয়ে থাকে। মর্ত্যবাসীদের কাছে শ্রাবণ মাসের তাৎপর্য অপরিসীম।
আমরা চিরকাল এমনই শুনে আসছি যে মহাদেব খুব রাগী ও তেজি দেবতা। তবে অল্পে খুশি। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে ও তাঁর কৃপা পেতে হলে সঠিক নিয়মে ও সময়ে তাঁর উপাসনা করতে হয়।
তাই শিবের উপাসকদের কাছে শ্রাবণ মাসের মাহাত্ম্যই আলাদা। শৈব উপসনা এই সময় আদর্শ। বছরের অন্য সময় শিবপুজো করলে যা পুণ্য লাভ হয় এই সময় করলে তা নাকি একশো আট গুণ বেড়ে যায়। এমনটাই কথিত।
বনমাস নিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় কাহিনি হল এইরকম যে, ভগবান বিষ্ণু যখন তাঁর বামন অবতারের মাধ্যমে রাজা বালির পরীক্ষা করেছিলেন তখন তাঁর দানশীলতা এবং নিঃস্বার্থতার জন্য তিনি খুশি হয়েছিলেন। ভগবান বিষ্ণু চিরকাল পাতালভজা বালির ভূবর বস্তু জগতে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই কথা শুনে বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী খুব মনে কষ্ট করেন। তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব এবং ভগবান ব্রহ্মার কাছে যান। তাঁরা সব শুনে তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তাঁরা বছরে চার মাস ভগবান বিষ্ণুর পরিবর্তে পাতালে কাটাবেন। এবং ভগবান বিষ্ণুকে আট মাসের জন্য মুক্ত করেন। এই চার মাসের মধ্যে শ্রাবণ মাস প্রথম মাস, এই মাস থেকেই শিব লক্ষ্মীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন।
শ্রাবণ সোমবারের ব্রতকথাও বেশ মনোগ্রাহী। কোনও এককালে ছিলেন এক মহাজন। মহাজন হলেও তিনি সৎ জীবনযাপন করতেন। অত্যন্ত ধার্মিক এই মহাজন শিবের উপাসক ছিলেন। কিন্তু সব সুখ থাকলেও তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না। মহাজনের দীর্ঘ প্রার্থনায় তাঁদের কোলে আসে পুত্রসন্তান। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী হল তার আয়ু মাত্র বারো বছর!
প্রচণ্ড মন খারাপ এবং অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নিয়ে ছেলেকে বড় করতে লাগলেন মহাজন ও তাঁর স্ত্রী। বারো বছর বয়েস হলে ছেলেকে এক আত্মীয়ের সঙ্গে পাঠান কাশীতে অধ্যয়নের জন্য।
পথে দেখা গেলে একটি বিয়ের আসর। কিন্তু সেখানে তখন কান্নার রোল। কারণ বর চোখে দেখে না। পাত্রীর বাবা অনুরোধ করলেন মহাজনপুত্রকে বরের আসনে বসতে। বালকের আত্মীয় বললেন তার অদৃষ্টলিখনের কথা। কিন্তু তাতেও রাজি হলেন পাত্রীর বাবা।
মহাজনপুত্রের বিয়ে হয়ে গেল। নতুন বউকে নিয়ে সে গেল কাশী। এরপর এল তার শেষ সময়।
কিন্তু মহাজন আর তাঁর স্ত্রীর ভক্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন মহাদেব। তাই তিনি অদৃষ্টলিপি বদলে দীর্ঘ জীবন দিলেন মহাজনপুত্রকে। পুত্র ফিরে এল বাবা-মায়ের কাছে। সংসার ভরে উঠল সুখ শান্তি ও আনন্দে।
একেক জায়গায় বা এক-একটি রাজ্যে একেকভাবে পালন হয় শ্রাবণ মাসের শিব পুজো। রাজস্থানি, গুজরাতিরা শ্রাবণ মাস ধরে সূর্যাস্তের পর কিছু খান না। এমন রীতি ওখানে প্রচলিত। তার আগে সারাদিন নিরামিষ হালকা খাবার সাবুমাখা বা ফলমূল খেয়ে থাকেন।
অনেক জায়গায় ভক্তরা নুনহীন খাবার খান গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে। কেউ কেউ আবার শ্রাবণ মাসের সোমবারে একদম নির্জলা উপবাসে থাকেন। বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে পুরুষ-নারী এই শ্রাবণ মাসে শিবের ব্রত পালন করেন। অনেক ভক্ত শ্রাবণ মাসে সাপ হত্যা করে না। প্রতি সোমবার নির্দিষ্ট করে পুকুর বা যেকোনও জলাশয়ে গিয়ে মাছকে খাবার খাওয়ানোর রীতি পালন করেন। এই একটা মাস নেশা-ভাঙ থেকে বিরত থাকেন। শ্রাবণ মাসে শিবের উপাসকরা জলাভিষেক বা রুদ্রাভিষেক করে থাকেন। রুদ্রাভিষেকেও বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।
রুদ্রাভিষেক হল ভগবান রুদ্রের
অর্থাৎ শিবেরই একটি বিশেষ পুজো। এই পুজোর মাধ্যমে শিবের উগ্ররূপের পুজো করা হয় আমাদের প্রসিদ্ধ পুরাণ রামায়ণেও রুদ্রাভিষেকের উল্লেখ রয়েছে।
রুদ্র অর্থাৎ শিব কল্যাণকর। তিনি নেতিবাচকতার বিনাশকারী। পূজার অর্থ যা পূর্ণতা থেকে জন্মগ্রহণ করে।
বৈদিক শাস্ত্রে রুদ্রাভিষেক নিয়ে বলা হয়েছে দুঃখ থেকে মুক্তি, আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং সমৃদ্ধির জন্যই রুদ্রপুজোর বিধি। রুদ্রাভিষেক ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন কাল থেকে অনুসৃত একটি রীতি। পৃথিবীতে নেতিবাচক এবং ইতিবাচক শক্তি দুই-ই সবসময় খেলা করে। এই পুজো নেতিবাচক শক্তি দূর করে ইতিবাচক শক্তি তৈরি করে। ভক্তেরা ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করে রোগ-ভোগের মতো নেতিবাচক শক্তি, ইতিবাচক শক্তি, শান্তি-সমৃদ্ধি আনন্দে যেন রূপান্তরিত হয়। শরীর মন এবং আত্মার তিনটে স্তরে শান্তি যেন থাকে এমন প্রার্থনাই করা হয় এই পুজোয়। বিশ্বাস করা হয় যে শিব বা রুদ্রের উপাসনা রোগের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
হিন্দুধর্মে ভগবান শিব একজন বিশিষ্ট দেবতা। বিভিন্ন রূপে চিত্রিত তিনি। কখনও গভীর ধ্যানে নিযুক্ত একজন শান্ত তপস্বী, এখনও গলায় জড়ানো সাপ আর হাতের জিরো ভাবে আঁকড়ে ধরা ত্রিশূল তৃতীয় নয়ন সজ্জিত দেবাদিদেব মহাদেব পরম দেবত্বের প্রতীক। আপনি সৃষ্টির প্রতিটি পরমাণুতে নিরাকার এবং সর্বব্যাপী।
হিন্দুধর্ম অনুসারে শ্রাবণ মাস ভগবান শিবের মাস হিসেবে পালিত হয় এই মাসে পুজো করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।