ভূমিকন্যা

শ্রাবণের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি বোঝে একজন কৃষকই, বোঝে মাটি কর্ষণের মূল্য। আর সেই কৃষক যদি হন কোনও নারী তা হলে তিনি প্রকৃতির আরও কাছের বন্ধু হয়ে যান। এমনই এক কৃষক হলেন মুর্শিদাবাদের ভূমিকন্যা মৌসুমী বিশ্বাস। যাঁর কোমল হাতের ছোঁয়ায় কঠিন মাঠে নিত্যদিন সোনা ফলে। মেয়েরা চাষবাস করতে পারেন না এই মিথকে ফ্যাক্টসে পরিণত করেছেন মৌসুমী। পেয়েছেন বহু সম্মান এবং ভালবাসা। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

‘শ্রাবণে না ধরে পানি,
তেরো দিনে বন্যা জানি।’
শ্রাবণ মাস নিয়ে খনার এই বচনটির অর্থ শ্রাবণে যদি অতিরিক্ত বৃষ্টি হয় এবং জল ধারণের ক্ষমতা না থাকে তাহলে ১৩ দিনের মধ্যেই বন্যা অবধারিত। শ্রাবণ মাস নিয়ে এরকম কত কথা প্রচলিত।
ভরা বর্ষার অনুষঙ্গের অভাব নেই। বিশেষ করে শ্রাবণের অনেক রূপকল্প। আকাশ কালো করা মেঘ, অঝোর বৃষ্টি মাঝে রোদের লুকোচুরি খেলা, পদ্মপাতায় টলটলে জল, চড়ুই পাখির স্নান, মহাদেবের আরাধনা, ব্রত উপবাস, বিয়ে, মাঙ্গলিক কর্ম— সবমিলিয়ে এক অন্য মাহাত্ম্য রয়েছে এই মাসটির। কিন্তু শ্রাবণ মানেই সব ভাল এমনটা নয়। শ্রাবণের প্রকৃতি বড়ই খামখেয়ালি। সেই মুডের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সহজ কাজ নয়। কবে হাসাবে আর কবে কাঁদাবে কেউ জানে না। কখনও পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে, দু’হাত ভরে আশীর্বাদ বর্ষণ করে, আবার কখনও খামখেয়ালে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির অভিশাপ দেয়, ধ্বংস হয় ফসল, চোখের জল ফেললেও নরম হয় না সেই কঠিন প্রকৃতি মা। চাষবাস মানেই তো হল জল। সেই জল বেশি হলে বন্যা আর কম হলে খরা। তাই ফলন ভাল হতে হলে বৃষ্টির পরিমাণ হতে হবে ব্যালান্স— না একটু কম, না বেশি। সেই ভারসাম্য টালমাটাল হলেই বিপদ। কিন্তু তার গারান্টি কে দেবে? কারণ প্রকৃতিই এখানে হর্তা, কর্তা, বিধাতা। ধানচাষ হোক বা সবজি বা মাছচাষ, শ্রাবণ হোক বা ভাদ্র— সবটাই প্রকৃতি-নির্ভর। আমার মনে হয় মানুষের জীবনও প্রকৃতি-নির্ভরই। তাই প্রকৃতির বুকে সোনার ফসল ফলানোর কারিগর, সেই কৃষকদের কাছে এই নির্ভরতা কখনও গর্বের আবার কখনও অসহায়তার। কারণ তাঁদের ভাগ্য তাঁরাই জানে না। তাও প্রকৃতির সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষের গভীর নিবিড় সম্পর্ক। মাটিকে জড়িয়েই তাঁদের দিনগুজরান। মাটিই তাঁদের সুখ, দুঃখের একমাত্র সাথী। মাটি কর্ষণ করে সোনা ফলানোর মতো কঠিন কাজটা তাঁরা বছরের পর বছর অনায়াসে করে থাকেন। এই কাজ শুধু শ্রমসাধ্যই নয়, এই কাজে লাগে চরম শারীরিক বলও। আর ভরা বর্ষায় সেই কাজ হয়ে যায় আরও কঠিন। তাই বোধহয় কৃষিকাজে কোনও দিনই মহিলাদের দেখা মেলেনি বড় একটা। কিন্তু সেই মিথকে ফ্যাক্টে পরিণত করেছেন মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থানার ছয়ঘরি গ্রামের কৃষক মৌসুমী বিশ্বাস (Mausumi Biswas)।

২৮ বছরের নিরলস পরিশ্রমে আজ তিনি গোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের এক পরিচিত নাম। তিনি সফল এবং সমৃদ্ধশালী এক মহিলা কৃষক (Mausumi Biswas)। কিন্তু সেই সাফল্য এসছে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে, অনেক রক্ত ঝরিয়ে, কঠোর পরিশ্রমে এবং লেগে থাকার মানসিকতায়।
দেওয়ালে সম্পূর্ণ পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের যে অবস্থা হয় আজ থেকে ২৮ বছর আগে সেই অবস্থাই হয়েছিল মৌসুমীর। অজ গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে যেখানে সেই সময় ছিটেফোঁটা শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি তখনই মৌসুমীর পরিবার ছিল শিক্ষিত। মা লেখাপড়া না জানলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো শিখিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যত কষ্টই হোক লেখাপড়া শেখাতে হবে তবেই ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে পারবে। খুব অল্প বয়সে বাবা চলে যান। মৌসুমীর (Mausumi Biswas) বয়স তখন মাত্র দেড়মাস। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের সংসার। এহেন লড়াইময় জীবনে কোনওমতে পড়াশুনো চালিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদ্যম প্রচেষ্টা ছিল সবারই। একটা সময় দাদা মুম্বইয়ে চাকরি পেলেন। খুব কমবয়সে সংসারের হালও ধরলেন। তখন মৌসুমী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পাঠরতা। কিন্তু বিধি বাম! মাঝপথেই বাজ ভেঙে পড়ল মাথায়— দাদার মৃত্যু হয় একটি দুর্ঘটনায়। অথৈ সাগরে তখন মৌসুমীর গোটা পরিবার। এবার কী হবে! মৌসুমী মাঝপথেই এমএ দ্বিতীয় বর্ষেই পড়া ছেড়ে ফিরে এলেন গ্রামে। দিশাহারা। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, এক বোন অ্যামনিশিয়ার রোগী, আর-এক দাদা শ্বাসকষ্টের রোগী। দাদার স্ত্রী ছেলেমেয়ে— সব দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ল মৌসুমীর। মৌসুমীর কথায়, ‘‘সংসারে তখন জিরো ব্যালান্স। কিচ্ছু আয় ছিল না। সেই শূন্য থেকে শুরু। তখন গ্রামের কিছু ছেলেমেয়েকে পড়ানো শুরু করি। অজ গাঁয়ের মানুষ তারাও। সবাই বেশ গরিব তাই টাকাপয়সা দিতে পারত না। অত কষ্টেও হতাশ হইনি কখনও। মা আমাকে সাহস জোগাতেন। বলতেন পরিশ্রম করতে আর ঈশ্বরকে ভরসা রাখতে।’’
মায়ের সেই অনুপ্রেরণা মৌসুমীকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। শুধু ভিটেটুকু ছাড়া কিছুই ছিল না। পরের জমি লিজে নিলেন। শুরু করলেন চাষবাস। গ্রামে একমাত্র চাষবাসটাই অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে আসতে পারে এই দূরদৃষ্টি ছিল তাঁর। এইভাবেই যদি সংসারের অচল গাড়ি দৌড়ায়! কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে পড়া শিক্ষিত মেয়ে তাঁর পক্ষে জমিতে লাঙলচষা একেবারেই সহজ ছিল না। দুরূহ সেই কাজেই হাতেখড়ি হল তাঁর। এই কঠিন কাজটি করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থতার মুখ দেখেছেন তিনি। কী বীজ দিতে হয়, কোন সার ব্যবহার করা উচিত, কী পেস্টিসাইড দিতে হয়, কোন ফসল লাভজনক কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। তখন রেডিওর আকাশবাণীতে কিষাণবাণী অনুষ্ঠানটি মন দিয়ে শুনতেন, যেখানে কৃষি বিশেষজ্ঞরা চাষবাস সম্পর্কে নানা তথ্য দিতেন। তারপর একদিন এগ্রিকালচার অফিসে গিয়ে কিছু বই পেলেন চাষের।
সেই সময় একমাসের একটা প্রশিক্ষণ নিলেন কৃষির ওপর। বিধানচন্দ্র কৃষিবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আবার প্রচেষ্টার শুরু। প্রথমে এক নতুন পদ্ধতিতে ধানচাষ দিয়ে শুরু হল কাজ। গ্রামের একটি মেয়ে ধানচাষ করতে মাঠে নেমে পড়েছে দেখে কম কটূক্তি বা ব্যঙ্গোক্তির শিকার হননি তিনি। ‘মাথার দোষ হয়ে গেছে’— এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু নতুন পদ্ধতির প্রয়োগে সেই ধানচাষেই সফল হলেন মৌসুমী, প্রচুর ফলন হল সেবছর। আর পিছন ফিরে তাকাননি। এরপর ওই এলাকার সবচেয়ে লাভজনক ফসল ‘একানি’ চাষ শুরু করেন। একানি হল একধরনের ফসল যা মাছচাষের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এই ফসল তখন ভারতের বাইরেও বিক্রি হত। সেইসময় মাঠে দশ এগারো ঘণ্টা কাজ করতেন। মা পাহারা দিতেন মৌসুমীকে, জমিতে গিয়ে বসে থাকতেন। আজ হাজার হাজার চাষি-বন্ধুরা দূর-দূরান্ত থেকে তাঁকে ফোন করে পরামর্শ নেন। সুদূর কাশ্মীর থেকে এক চাষি বন্ধু আপেল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাঁর পরামর্শ নিয়েছিলেন। মৌসুমী আজ শুধু পরামর্শদাতাই নন, তিনি চাষিবন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁদের এলাকায় গিয়ে কৃষি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় গাইড করেন। শস্যে রোগ হলে তার উপায় বাতলে দেন। ২৮ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি শুধু সফল কৃষক নন একজন কৃষি-বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি-গবেষকও। তাঁর কথায়, ‘‘বর্ষা মানে চাষির হাসিও, আবার বর্ষা মানে চাষির কান্নাও। যে চাষই করি না কেন আমরা প্রকৃতি নির্ভর। তাই অতিবৃষ্টিতে যখন বন্যা হয় বা খরায় ফসল ফলে, মেঘলা আবহাওয়ায় মাছ চাষের ক্ষতি হয় তখন আমাদের মুখে সেই হাসি থাকে না। মেঘলা প্রকৃতি মাছ চাষের ক্ষতি করে। কাজেই প্রকৃতির সঙ্গেই আমাদের মানিয়ে চলতে হয়।’’

আরও পড়ুন:কার্গিল দিবসের নামে এসআইআরের ছক! 

দীর্ঘদিনের গবেষণায় মৌসুমী আবিষ্কার করেছেন উন্নতমানের বীজ। কম জলে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় অধিক ফলনশীল ধান চাষের জন্য এই নতুন বীজটি তিনি উদ্ভাবন করেন যার নাম ‘এম যামিনী’। কিন্তু কেন এই বীজ তিনি তৈরি করলেন? এই প্রসঙ্গে মৌসুমী বললেন, ‘‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং দূষণের প্রভাবে পানীয় জলের পরিমাণ কমছে। আর বাড়ছে নোনা জলের পরিমাণ। ধান চাষে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন। রেশিওটা হল এক কিলো ধানচাষ করতে এক হাজার লিটার জল লাগে। সেই জল খরচ যদি কমিয়ে আনতে পারি তাহলে প্রকৃতি বাঁচবে। জল খরচ কমবে। আগামী প্রজন্মের জন্য অনেকটা জল সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু চাষও করতে হবে। এখনও ৭০% মানুষ চাষের ওপর নির্ভরশীল। তাই মনে হয়েছিল যদি এমন একটা বীজ তৈরি করা যায় যাতে জল কম লাগে। এরপর একটা দেশি ধানের বীজ এবং একটি বিদেশি ধানের বীজ সঙ্গে আরও চার-পাঁচটা বীজ নিয়ে দশ বছর গবেষণা করি। এতে যে বীজটা তৈরি হল তা অতি কম জলে চাষ হবে অর্থাৎ শুকনো আবহাওয়াতে লাগিয়ে দিলেও ফলন হবে।’’
মৌসুমীর এই আবিষ্কার এখনও পুরোপুরি সরকারি ছাড়পত্র পায়নি, আরও বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি রয়েছে, যেগুলো পেরিয়ে আগামী দিনে এই নতুন বীজ নতুন দিগন্তের সূচনা করবে আশা করাই যায়।
ফল, সবজি, ধান সবরকম চাষের সিংহভাগ কাজ তিনি একা হাতে সামলান। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ একাই করে চলেছেন। এ যুগের বিস্ময় বালিকা না হলেও বিস্ময় নারী তো তিনি বটেই। সেই সঙ্গে সামলেছেন নিজের পরিবারকেও। আকাশবাণী, দূরদর্শন থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নিয়মিত। বহু চ্যানেলের তিনি আমন্ত্রিত অতিথি। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৫-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘কৃষকরত্ন’ সম্মান, ২০১৬-তে ‘কৃষি রবি’ সম্মান, ২০১৭-তে ‘কৃষক সম্মান’ অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল ইনোভেশন অফ ইন্ডিয়া তাঁকে দেন ‘কৃতী কৃষক’ সম্মান, ইন্ডিয়ান আর্মির তরফেও তিনি পেয়েছেন বিশেষ সম্মান। ২০২৫-এ তাঁর জেলা মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের তরফে তাঁকে দেওয়া ‘ভূমিকন্যা’ অ্যাওয়ার্ড। আগামী দিনে মৌসুমীর পরিকল্পনা প্রকৃতিকে বাঁচানো, চাষে যথেচ্ছ সার আর কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, বিষমুক্ত ফসল ফলানো। এর জন্য জরুরি উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। যেসব মেয়ে আগামীতে কৃষিতে আসতে চান মৌসুমী তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেন। চাষের দিদিমণি হিসেবে আজ গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁকে চেনেন। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বাকি সময়টাও তিনি কৃষক বন্ধুদের জন্যই নিবেদন করেছেন। মৌসুমী বিশ্বাস আজ শুধু মেয়েদের কাছে নয় সমগ্র মানবজাতীর অনুপ্রেরণা।

Latest article