লজ্জাও করে না এদের !

ডবল ইঞ্জিন সরকার মানেই স্বর্গরাজ্যের অনুভূতি। আবার ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতি। বিগত দশ বছরে বিজেপি সরকারের দেওয়া একটার পর একটা প্রতিশ্রুতি রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখে পেশাদার সাংবিধানিক পদাধিকারীদের একটা বিরাট অংশ অপমানে, অবহেলায় নীরবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন প্রাক্তন এক পদ্মপাল। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে টুকলি করে মহারাষ্ট্রে চালু করেছিল সেখানকার ডবল ইঞ্জিন সরকার। কিন্তু যেখানে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি, সেখানেই দুর্নীতি। মহারাষ্ট্র তার ব্যতিক্রম হয় কী করে?
আসলে মহারাষ্ট্র বিধানসভার ভোটের আগে বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ধাঁচেই ‘লড়কি বহিন’ প্রকল্প চালু করেছিল মহাযুতি জোট। কার্যত ওই প্রকল্পে ভর দিয়েই দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে তারা।
রাজ্যের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের জন্য গত বছর মহারাষ্ট্র সরকার শুরু করেছিল এই ‘লড়কি বহিন’ প্রকল্প। এ বার জানা গেল, এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় প্রতারণামূলক ভাবে আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন ১৪,০০০-এরও বেশি পুরুষ!
শিন্দের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মুখ পুড়েছে। এটাই ডবল ইঞ্জিন সরকারের প্রকৃত চেহারা। টিভিতে সান্ধ্য বৈঠকে এই নিয়ে কোনও আসর বসেনি।
সব চুপচাপ। বিজেপি সরকার চলছে যে! এসব নিয়ে কোনও কথা নয়।

আরও পড়ুন-সায়ন আরও গোল করতে চান, চলে এলেন হামিদ

গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পের ধাঁচে মহারাষ্ট্রেও অনুরূপ মহিলা-ভাতা প্রকল্প চালু করেছিল শিন্দের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। প্রকল্পের আওতায় ২১-৬৫ বছর বয়সি যেসব মহিলার পরিবারের বার্ষিক আয় আড়াই লক্ষ টাকার কম, তাঁদের মাসে ১,৫০০ টাকা করে দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু সম্প্রতি নারী ও শিশু উন্নয়ন বিভাগের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গত ১০ মাসে নারীদের পাশাপাশি এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন ১৪,২৯৮ জন পুরুষ! এঁরা সকলেই অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের সময় কারচুপি করে নিজেদের মহিলা হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। ফলে সব মিলিয়ে এই অতিরিক্ত ১৪,২৯৮ জনকে টাকা দিতে এখনও পর্যন্ত মহারাষ্ট্র সরকারের পকেট থেকে খসেছে ২১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা!
বহু মহিলা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও আবেদন করেছেন। প্রকল্পে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, প্রতিটি পরিবারে সর্বাধিক দু’জন মহিলা এই সুবিধা নিতে পারবেন। কিন্তু ৭.৯৭ লক্ষেরও বেশি মহিলা একই পরিবারের তৃতীয় সদস্য হিসাবে নাম নথিভুক্ত করেছেন। শুধুমাত্র এই কারণেই সরকারি কোষাগারের ১,১৯৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে! এ ছাড়া, প্রকল্পের সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা, অর্থাৎ ৬৫ বছরের বেশি বয়সি ২.৮৭ লক্ষ মহিলা এই প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। এর ফলে ক্ষতি হয়েছে ৪৩১.৭০ কোটি টাকা। এমনকী, চার চাকার গাড়ি রয়েছে, এমন পরিবারেরও ১.৬২ লক্ষ মহিলা এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন! ফলে সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রথম বছরেই আনুমানিক ১,৬৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের।
এঁরা কী ভাবে প্রকল্পে আবেদন করেছিলেন? কে তাঁদের সাহায্য করেছিল? এর নেপথ্যে আরও বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে।
মহারাষ্ট্রের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী অদিতি তটকরে জানিয়েছেন,এখনও মোট ২৬.৩৪ লক্ষ সুবিধাভোগী অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন!
এরা কোন মুখে দুর্নীতির ধুয়ো তুলে বাংলায় মনরেগা আর আবাসের টাকা আটকায়! নির্লজ্জ বেহায়ার দল!
এই অসভ্য জঞ্জাল পার্টি সংবিধানের রীতিনীতি শিকেয় তুলে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিগত দশ বছরে বিজেপি সরকারের দেওয়া একটার পর একটা প্রতিশ্রুতি রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখে পেশাদার সাংবিধানিক পদাধিকারীদের একটা বিরাট অংশ অপমানে, অবহেলায় নীরবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই তালিকায় যেমন আছেন নোটবন্দির সময় সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেল, তেমনি আছেন তৎকালীন দুই নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা ও অরুণ গোয়েল। দু’জনই স্বয়ংশাসিত নির্বাচন কমিশনকে বিজেপির শাখা অফিসে পরিণত করার বিরোধিতা করেই বিদায় নেন। আজ এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই, অশোক লাভাসা ও গোয়েলজি কমিশনের মাথায় থাকলে বিহার ও বাংলার ভোটের আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন কিছুতেই করতে দিতেন না। বড় সংঘাতের জায়গা তৈরি হত।

আরও পড়ুন-আজ ডুরান্ডে ডায়মন্ড হারবার, মহামেডানকে হালকাভাবে নিচ্ছি না : কিবু

নিঃসন্দেহে এই তালিকার সর্বশেষ চমকপ্রদ সংযোজন, একদা বিজেপি ও সঙ্ঘের অতি-ঘনিষ্ঠ উপ রাষ্ট্রপতির অতিনাটকীয় বিদায়! এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গেরুয়া আহ্লাদ ও আদর কতটা ক্ষণস্থায়ী হতে পারে! পান থেকে চুন খসলেই গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে কেউ দু’বার ভাববে না। যাঁরা রাজ্যে রাজ্যে গেরুয়া দলের মুখিয়া সেজে লম্ফঝম্প করেন, লোককে শাসান, উপড়ে ফেলার হুমকি দেন, এই ঘটনা তাঁদের কাছে যেমন শিক্ষার, তেমনি গড় ভোটারের কাছেও আত্মোপলব্ধির! কথায় কথায় এই দলই গণতন্ত্রের কথা বলে, হিন্দু ‘সোচ’ নিয়ে নানা উপদেশ দেয় এবং তা সাধারণকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। কিন্তু নেপথ্যে ধ্রুবপদ একটাই, যতদিন তুমি তালে তাল ঠুকে অনুগত থাকবে, ততদিনই নিঃশ্বাস নিতে পারবে। সামান্য ভুলচুক হলেই সারাজীবনের বিশ্বাস মিলিয়ে যেতে কয়েক সেকেন্ডও লাগবে না। ব্যাস খেল খতম! আসলে ‘রাজার চেয়ে বড় রাজভক্ত হতে নেই’, অনুগত সাজতে রাজার কথায় কারও বিরুদ্ধে চক্রান্তেও যুক্ত হতে নেই। কথাটার মর্মার্থ নিশ্চয়ই আজ হাড়ে হাড়ে বুঝছেন সদ্য প্রাক্তন উপ রাষ্ট্রপতি। যিনি রাজ্যপাল থাকাকালীন বাংলার রাজভবনকে বঙ্গ বিজেপির শাখা অফিস বানিয়েছিলেন, তাঁর বোঝা উচিত নিকৃষ্ট পলিটিক্যাল অপারেটরদের শেষে এমন পরিণতিই হয়। সম্ভবত ১৯৫০ থেকে ২০২৫, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থা ও সংবিধানের পথচলার গৌরবময় অধ্যায়ে উপ রাষ্ট্রপতি পদের এমন অবমাননা আর হয়নি। মূলত একশো দিনের কাজ, গ্রামীণ আবাস যোজনার মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ করা নিয়ে গত সাড়ে তিন বছর ধরে কেন্দ্র-রাজ্যের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। দুর্নীতির দোহাই দিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবর্ষ থেকে ১০০ দিনের কাজ এবং তার পরের বছর থেকে গ্রামীণ আবাস যোজনায় বাংলাকে কানাকড়িও দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। যে দুর্নীতি বা ভুয়ো জব কার্ড তৈরি করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছে কেন্দ্র, তাতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ। যেমন, গত অর্থবর্ষে উত্তরপ্রদেশে ভুয়ো জব কার্ড পাওয়া গিয়েছে সাড়ে ৩ হাজার। আর পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ২টি! তবু বাংলা টাকা পাচ্ছে না, উত্তরপ্রদেশে টাকা দেওয়া একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।
অথচ মহারাষ্ট্রে? কী চলছে সেখানে?
লজ্জাও করে না দু’কানকাটাদের।

Latest article