আমাদের আশপাশে এমন অনেক মেয়ে রয়েছেন, যাঁরা করেছেন অসাধ্যসাধন, গড়েছেন নজির, কুড়িয়েছেন প্রশংসা। যাঁরা দেখিয়েছেন মেয়েরা শুধু সংসারে নয়, মহাকাশেও বিচরণ করতে পারেন, আবার বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে পারেন তরতরিয়ে। এমন নারী যাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরুই হয়েছে ৬৫ বছর বয়সে। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। বয়স তাঁর কাছে আঙুলের করে গোনা সংখ্যা মাত্র, জীবন তাঁর কাছে বাধাহীন।
আরও পড়ুন-মুছে দাও বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস, শহিদের বেদিতে দালালেরা পাক মালা!
পুষ্পার দ্বিতীয় ইনিংস
‘পুষ্পা নাম শুনকে ফ্লাওয়ার সামঝে কেয়া? ফায়ার নেহি, ওয়াইল্ড ফায়ার হ্যাঁ।’— সংলাপটি সাম্প্রতিক সময়ের একটি অত্যন্ত ব্লকবাস্টার ছবি ‘পুষ্পা’র। কিন্তু বাস্তবে কি আর এরকম ওয়াইল্ড ফায়াররা আছেন? হ্যাঁ, ভারতের কর্নাটকেই আছেন এমন এক ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার। তিনিই পুষ্পা প্রকাশ। বেঙ্গালুরুর পুষ্পা জীবনের সেকেন্ড ইনিংস শুরুই করেছিলেন ৬৫ বছর বয়সে। এখন তাঁর বয়স ৬৮। এই তিন বছরে তিনি হিমালয়-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মোট ৪৯টি ট্রেক করে ফেলেছেন। আর একটা ট্রেক করলেই হয়ে যাবে পঞ্চাশটা। সেই ছোট্টবেলা থেকে হার না মানার লড়াইয়ে শামিল পুষ্পা। যখন তাঁর বয়স ৫০-এর দোড়গোড়ায় তখন নতুন কিছু করে দেখানোর তীব্র ইচ্ছে তৈরি হয় মনে। জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে চেয়েছিলেন পুষ্পা এবং চেয়েছিলেন প্রতিটা সুযোগকে কাজে লাগাতে। বয়সের দোহাই দিয়ে থেমে যেতে চাননি।
দুর্গম গিরির যাত্রা
যে বয়সে এসে মানুষ বিশ্রাম চায় নিরাপদ আশ্রয়ে, সেই বয়সে জীবনটাকে আলাদাভাবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ঝড় তুলেছিল পুষ্পার মনে। শুরুটা হয়েছিল রোজকার মর্নিং ওয়াক দিয়ে। আর সেই মর্নিং ওয়াক থেকে শুরু হল ছোট ছোট ট্রেক। এই ট্রেক তিনি করতেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে। যখন মেয়ে দেখল মা ছোট ছোট ট্রেকগুলো অনায়াসে করে ফেলছে তখন মাকে হাই অলটিটিউডের ট্রেকগুলোও চেষ্টা করতে উৎসাহ দেয়। এরপর প্রথমে বেঙ্গালুরুর কাছাকাছি ধীমানকিন্ডি, কনকপুরা এবং ভানান্তিমারির মতো জায়গায় ট্রেকিং শুরু করে ১৮ হাজার ফুট উঁচু এভারেস্ট বেস ক্যাম্পেও ট্রেক করে ফেলেন। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। নিউজিল্যান্ডে করেছেন স্কাইডাইভ, স্কুবাডাইভ করেছেন গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে। হাইয়েস্ট বাঞ্জি জাম্পিং করেছেন সাউথ আফ্রিকায়, হাইয়েস্ট টাওয়ার জাম্প করেছেন ম্যাকাও থেকে। জিম্বাবোয়ে এবং জাম্বিয়াতে গিরিখাতের ওপর দিয়ে দোল খেয়েছেন, হিমালয়ের হিমবাহতেও হেঁটেছেন।
স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা
বিশ্বজয়ের কান্ডারি পুষ্পার নির্ভেজাল জীবনযাপনই তাঁর সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি। তিনি জিমে যান না, মানেন না কোনও ডায়েট। কিন্তু বহু বছর ধরে সহজ ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করে থাকতে পেরেছেন ফিট অ্যান্ড ফাইন। পুষ্পা ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। যোগাসন, ধ্যান, প্রাণায়াম করেন শরীরকে ভাল রাখার জন্য। কোনওরকম বাইরের খাবার থাকে না তাঁর খাদ্যতালিকায়, থাকে শুধু বাড়ির তৈরি করা খাবার। খাবার বলতে শাকসবজি, ফল, বিভিন্ন দানাশস্য, রসুনের কোয়া— যেগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল পাওয়া যায় যা হার্ট ও মস্তিষ্কের কাজ ভাল রাখে, ক্যানসার প্রতিরোধ করে অনেকাংশে। পুষ্পার প্রত্যেকদিনের খাদ্য তালিকায় যেটা সবসময় থাকেই, সেটা হল ভাত। তিনি ২৪ ঘণ্টায় মোট তিনবার খাবার খান। রাতে সঠিক সময় শুয়ে পড়েন। পুষ্পা বলেন, ‘‘আমার মানসিক সুস্থতা এবং আমি যেভাবে শৃঙ্খলপূর্ণ জীবনযাপন করি— এই দুটি প্রধান কারণেই এই বয়সে আমি ট্রেকিং ও অ্যাডভেঞ্চার করতে পারি।’’
আরও পড়ুন-উৎসবের বাকি একমাস, তুঙ্গে কুমোরটুলির প্রস্তুতি
সন্তানের অনুপ্রেরণায়
পুষ্পা তাঁর রোমাঞ্চকর ট্রেকিং জীবনের বেশিরভাগ কৃতিত্ব দিয়েছেন তাঁর মেয়ে, সুমা নাড়াশা প্রকাশকে। পেশায় তিনি একজন সফটওয়্যার ডেভলপার। মায়ের প্রত্যেকদিনের মর্নিং ওয়াকের সঙ্গী তিনি। এক-একটা ট্রেক তাঁদের দু’জনের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। এই প্রসঙ্গে সুমা বলেছেন, ‘‘যখন আমি মাকে ট্রেক করতে দেখি, কখনও দেখি না সে বিশ্রাম নিচ্ছে বা বলছে সে ক্লান্ত। সে শুধু এগিয়ে যায়। কখনও হারে না। মা সত্যিই একজন প্রতিভাবান মানুষ।’’ জীবনে চলার পথে মেয়ে ক্রমাগত এইভাবেই তাঁর মা-কে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন, লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহস জুগিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। সুমা প্রকাশ একজন গর্বিত মেয়ে।
হারিয়েছেন অবসাদকেও
প্রতিটি নারীই জীবনের বিভিন্ন সময় অবসাদে ভোগেন। হরমোনজনিত পরিবর্তন, রজচক্রের শুরু, বিশেষ করে রজচক্রের শেষে প্রি এবং পোস্ট মেনোপজের সময় মেয়েরা ডিপ্রেশনের শিকার হন।
এই সময় থেকে তাঁরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন কিন্তু পুষ্পা তা চাননি। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বয়েস একটা সংখ্যা মাত্র, হারিয়েছেন অবসাদকেও। ২০২৪ সালে বিশ্ব লাইন লাইট অ্যাওয়ার্ড ফর ওম্যান পুষ্পাকে ‘ট্রেকার অফ দ্য ইয়ার’ (Trekker of the year) সম্মানে ভূষিত করে। পুষ্পার মতোই আমাদের সবার ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে সম্ভাবনা যা দেখাতে পারে নতুন পথের দিশা।
কিরণ মজুমদার শ
আমরা এখন অন্তেপ্রনেয়র শব্দটার সঙ্গে বেশ পরিচিত। ইন্ডিয়াতে সার্ক ট্যাংক সম্প্রচারের মাধ্যমে হোক বা ইন্টারনেটের দৌলতে স্টার্ট আপ কালচার এখন বেশ ট্রেন্ডিংয়ে। সবাই চায় তাদের স্টার্ট আপ খুলতে। কিন্তু স্টার্ট আপ ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ? খুব সহজেই কি স্টার্ট করা যায় স্টার্ট আপ? তবে আজ আমরা যার সম্বন্ধে কথা বলছি, তিনি কিন্তু সবার মতো গতে বাঁধা পড়াশোনা করেননি। কলেজে জু-লজি নিয়ে পড়লেও মাস্টার ডিগ্রি করলেন ব্রিউইং নিয়ে অর্থাৎ বিয়ার বানানোর বিদ্যা। ১৯৭৮-এ আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১০ হাজার টাকার লগ্নি আর একজন গ্যারাজ মেকানিককে দিয়ে বেঙ্গালুরুতে তাঁর ভাড়া বাড়ির গ্যারাজে শুরু করেছিলেন বায়োকেমিক্যালস বা জৈব রসায়নের ব্যবসা বায়োকন। তখন কোম্পানিতে তাঁর মালিকানা ছিল সত্তর শতাংশ। তিনি হলেন জৈব ওষুধ বা বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সম্রাজ্ঞীর কিরণ মজুমদার শ।
প্রথম সাফল্য
অস্ট্রেলিয়া সরকারের দেওয়া মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় পুরস্কার ‘অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া’ পেয়েছিলেন কিরণ। ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক ও শিক্ষাগত সম্পর্ক অটুট রাখতে কিরণের যে অবদান সেই কথা মাথায় রেখেই এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিরণ কি কখনও ভেবেছিলেন যে দেশে তিনি পড়তে যাচ্ছেন সেই দেশ থেকেই পাবেন এমন একটি পদক? কলেজের পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি মেডিক্যালে পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয় তাঁর। মেডিক্যালে পড়া হল না। ভর্তি হলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যালারেট কলেজে। লক্ষ্য তখন বাবার মতো ব্রিউ মাস্টার হওয়ার। ১৯৭৫ সালে তিনি পেলেন মাস্টার ডিগ্রি। কলেজে সেই সময় ব্রিউয়িং বিভাগে তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা ছাত্রী। প্রথমদিকে বিভিন্ন কোম্পানি যেমন কার্লটন অ্যান্ড বিউয়ারিশ, ব্যারেট ব্রাদার্স-এ ট্রেনি ব্রিউয়ার হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু কে জানত তিনিই ভবিষ্যতে হবেন বায়োকনের প্রতিষ্ঠাতা। জীবনে শুরুর পথে তিনি খুব একটা ভারতে কাজ করার সুযোগ পাননি। তাঁকে শুনতে হয়েছিল ‘It’s a man’s work.’
আরও পড়ুন-ডিভিসি অনিয়ন্ত্রিত জল ছাড়ায় বন্যার আশঙ্কা, যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
বায়োকনের খুঁটিনাটি
কিরণের বহু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার সুফল বায়োকন। বর্তমানে ইন্ডিয়ার সর্ববৃহৎ বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। কিন্তু বায়োকন প্রথমে ছিল উৎসেচক উৎপাদন কেন্দ্র। পরে এটি সম্পূর্ণভাবে জৈব ওষুধ তৈরি শিল্পে রূপান্তরিত হয়। তিনি আরও দুটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন : সাইনজিন (১৯৯৪), যা চুক্তিভিত্তিক প্রাথমিক গবেষণা ও উন্নয়ন সহায়তা সেবা প্রদান করে এবং ক্লিনিজিন (২০০০), যা ক্লিনিক্যাল গবেষণা পরীক্ষা এবং জেনেরিক ওষুধের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। পরবর্তীতে ক্লিনিজিন, সাইনজিন এক হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তিনি ভারতে একটি নতুন প্ল্যান্ট নির্মাণ করলেন যেখানে আধা স্বয়ংক্রিয় ট্রে কালচার প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে জাপানি প্রযুক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত মালিকানাধীন সলিড substate ফার্মেন্টেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হল। এখানে ওষুধ নিয়ে গবেষণার আরও উন্নতি হল। এর পরবর্তীকালে কিরণ মজুমদার তাঁর কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
সূচনা আয়ারল্যান্ডে
বর্তমানে কিরণ মজুমদার শ বিশ্বব্যাপী জৈব ওষুধ শিল্পের ২৫ জন প্রভাবশালীর একজন, পৃথিবীর ১০০ জন ক্ষমতাশালী নারীদের অন্যতম, এশিয়া প্যাসিফিকের ২৫ জন ক্ষমতাশালীদের মধ্যে তিনি একজন, ধনকুবের আরও অনেক শিরোপাই আছে তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু আজ থেকে ৪৭ বছর আগে যখন তিনি পথচলা শুরু করেছিলেন তখন পরিস্থিতি ছিল আলাদা। কিরণ যখন ভারতে বায়োকনকে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলেন তখন অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আসলে কিরণ মজুমদার ভারতে বায়োকনের ভিত্তিপ্রস্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু বায়োকনের মূল ছিল আয়ারল্যান্ডে। লেসলি অচিনকলস ছিলেন বায়োকন বায়োকেমিক্যাল লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সেই সময় এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি ভারতে তাঁর কোম্পানির অধীনস্থ শাখা খুলতে সাহায্য করবেন। তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কিরণের। তিনি রাজি হন লেসলির প্রস্তাবে কিন্তু কিছু শর্তে। প্রথমদিকে বায়োকন শুধুমাত্র উৎসেচক বানাত যা মদ, খাবার প্যাকেজিং এবং বয়ন শিল্পের কাজে লাগত। বিশেষত পাপাইন নামক উৎসেচক বানানো হত। পরে পাপাইন এবং আইসিংগ্লাস নামক দুই ধরনের উৎসেচক বানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠাতে থাকে বায়োকন। বছর ঘুরতেই কিরণ কুড়ি একরের একটি জায়গা কেনেন ব্যবসা বাড়ানোর জন্য।
যাঁরা পথ দেখালেন
কিরণের বাবা রাসেন্দ্র মজুমদার জীবনের প্রথম ধাপগুলিতে তাঁর হাত শক্ত করে ধরেছিলেন। পরবর্তীতে কিরণের জীবনে পথপ্রদর্শক ছিলেন তাঁর স্বামী জন শ। ১৯৯০-এর দশকে বেঙ্গালুরুতে একটি অনুষ্ঠানে কিরণ এবং জনের দেখা হয়। বন্ধুত্ব হয়। ১৯৯৮-এ তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিরণ মজুমদার নতুনভাবে পরিচিত হন কিরণ মজুমদার শ হিসেবে। একটি জায়গায় কিরণ তাঁর স্বামীকে বলেছেন ‘husband’, ‘mentor’ এবং ‘soulmate’। একটি পডকাস্টে কিরণকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর জীবনের সেরা ইনভেস্টমেন্ট কী ছিল? তিনি বলেছিলেন, জন শ।
আরও পড়ুন-দিল্লি পুলিশকে সুপ্রিম ভর্ৎসনা শিশু-সহ রুশ বধূ পালানোর, তদন্তের নির্দেশ দূতাবাসকে
মানবসেবায়
সৌভাগ্যবশত ঈশ্বর কিরণকে মন এবং অর্থবল দুটোই দিয়েছেন। তাই ফিল্যানথ্রোপি শব্দটায় একদম বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। বিশ্বাস করতেন, দয়া নয় প্রয়োজন টেকসই পরিবর্তনের। তাই ভারত-সহ কর্নাটকের গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য তৈরি করেছিলেন ‘দ্য বায়োকন ফাউন্ডেশন’। আরোগ্য রক্ষা যোজনার মাধ্যমে ২০১০ সালের মধ্যে মোট সাতটি চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করলেন যেখানে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ওষুধ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শুধু হাসপাতাল করেই থামলেন না, স্কুল থেকে শুরু করে গ্রামীণ রাস্তা এমনকী কর্নাটকে বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে তিন হাজার বাড়িও করলেন। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু, তাঁর স্বামী এবং মায়ের ক্যানসারের মতো রোগে দীর্ঘদিন কষ্ট পাওয়া তাঁকে কোথাও নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ২০০৯ সালে তিনি ১৪০০ বেডের একটি ক্যানসার কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১১ সালে তাতে যোগ করেন বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার।
ল্যাব থেকে লাইফলাইনে
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে অনেকেই ওষুধ কিনতে পারে না অর্থের জন্য। বায়োকনের সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলা চলে কিরণের সাশ্রয়ী উদ্ভাবনের দর্শন। তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন ওষুধ বানানোর খরচ কমিয়ে কম দামে ওষুধ বিক্রির জন্য। যাতে অধিকতর মানুষের কাছে চিকিৎসা এবং ওষুধ পৌঁছায়। বায়োকন প্রথমের দিকে মানে ২০০০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে স্টাটিন্স নিয়ে কাজ করা শুরু করে। স্টাটিন্স হল এক রকমের ওষুধ যা শরীরে কোলেস্টেরল কম করে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে। কিরণ ভারতের বাজারে স্টাটিনের বাজারমূল্য দেখে এবং মানুষের প্রয়োজনের কথা ভেবে স্টাটিনের বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। যা ভবিষ্যতে অত্যন্ত সাফল্য পায় এবং বায়োকন কোম্পানির ৫০ শতাংশ আয় স্ট্যাটিন থেকে আসা শুরু করে। কোম্পানি আয় সত্তর কোটি থেকে ৫০০ কোটিতে পৌঁছায় ২০০৪ সালে। বায়োকন ক্যানসার, ডায়াবেটিস এবং বিভিন্ন অটো ইমিউন রোগ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে বহুদিন। এই কোম্পানি এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইনসুলিন উৎপাদক কেন্দ্র। ২০১৪ সাল থেকে বায়োকন তাদের আয়ের ১০ শতাংশ নিয়োগ করেছে গবেষণার জন্য।
স্বীকৃতি ও সম্মান
কর্নাটকে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল কর্নাটকা রাজয়োথসভ অ্যাওয়ার্ড।
জৈব প্রযুক্তি বিভাগে তাঁর অসামান্য কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’। ‘বিজনেস ওম্যান অফ দ্য ইয়ার’ ২০২৪ এবং ‘গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ওমেন অফ দ্য ইয়ার’। এছাড়া কিরণ মজুমদার শ একটা অপ্রতিরোধ্য জেদের নাম। যিনি কোনওদিনও হারতে শেখেননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, নারীরা শুধু সাহস দেখাতে জানেন না, তাঁরা বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও সমাজের গতিপথও বদলে দিতে জানেন।