কালে কালে আর কী কী যে দেখতে হবে!

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার কাছে এখন দুয়োরানি শুধুই মোদির ভারত। বাকি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিবেশী সব দেশের প্রতিই কমবেশি সদয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আবার ওদিকে বাঙালি যুবকের রুশ স্ত্রীর দেশ ছেড়ে পালানোর মামলায় সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র এবং দিল্লি পুলিশ প্রবল সমালোচনার মুখে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

শুনেছিলাম, ট্রাম্প আমাদের পরম মিত্র। সেই সূত্রে আঙ্কেল সাম আমাদের ঘরের শ্যামা খুড়ো হয়ে গেছে। আর চিন্তা নেই। বিপদে-আপদে, উন্নতিতে-বরবাদে তিনিই আমাদের পাশে থাকবেন।
কিন্তু যা দেখছি তাতে টের পাচ্ছি, ট্রাম্প চাচা আমাদের আপদে সহায় না হন, বিপদের কারণ। উন্নতির সিঁড়ি না হন, বরবাদের উপকরণ।

আরও পড়ুন-বাংলায় ব্যাপ্তি বেড়েছে উৎসবের, লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, অর্থনীতিতে জোয়ার, উৎসাহী বণিকসভা

কেন?
তবে খুলেই বলা যাক। ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির, অর্থাৎ মোদি সরকারের বাণিজ্যনীতি, কূটনীতি, বিদেশনীতি— সব কিছু ব্যাকফুটে থাকার সমাচার!
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার কাছে এখন দুয়োরানি শুধুই মোদির ভারত। বাকি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিবেশী সব দেশের প্রতিই কমবেশি সদয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যদিও ওইসব দেশের সিংহভাগ রাষ্ট্রপ্রধান মোদিজির মতো ট্রাম্পকে নিজের বন্ধু বলে প্রচার করেননি। ট্রাম্পের ভোটের প্রচার করতে আমেরিকা চলে যাননি।
দীর্ঘ টানাপোড়েন, কৌতূহল, টেনশন এবং জল্পনার পর অবশেষে শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বহু প্রতীক্ষিত সংশোধিত বাণিজ্য শুল্ক ঘোষণা করলেন। আর সেখানে দেখা গেল, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশের পণ্য রফতানির উপর ট্রাম্প যে আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন, তার পরিমাণ ভারতের তুলনায় অনেক কম। এই প্রতিটি দেশের উপর বলবৎ হতে চলেছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক। এমনকী উন্নত অর্থনীতির জাপানকেও দিতে হবে ১৫ শতাংশ। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। নরেন্দ্র মোদির বন্ধু ট্রাম্প ভারতের রফতানিকৃত পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
এই তালিকায় অবশ্য মায়ানমারকে রাখলে ভুল হয়ে যাবে। সেদেশের পাঠানো পণ্যের উপর আমেরিকার আমদানি শুল্ক বসবে ৪০ শতাংশ। এর কারণও আছে। ২০২১ সালেই অভ্যুত্থানের সাজা হিসেবে মায়ানমারের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল আমেরিকা। তারই পরিণতি এই উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ।
ভারতের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার উপর ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে স্বল্প শুল্ক আরোপ উদ্বেগজনক। কারণ, টেক্সটাইল ও রেডিমেড গার্মেন্ট এক্সপোর্ট সেক্টরে ভারতকে রীতিমতো কোণঠাসা করে দিলেন ট্রাম্প। এই দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সবথেকে বড় প্রতিযোগিতাই হল টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট রফতানিতে। ২০২৪ সালে ভারত যে পরিমাণ টেক্সটাইল এবং রেডিমেড জামাকাপড় রফতানি করেছে, তার ৩৩ শতাংশই আমেরিকায়। সুতরাং ভারতের এই সেক্টর বিপুল ধাক্কা খেতে চলেছে। এবং সরাসরি সংকটে পড়বে সাধারণ কর্মীরা। এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ইতিমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, গার্মেন্ট কারখানা ও সংস্থা এই লোকসান সামলাতে বিপুল কর্মী ছাঁটাই করতে পারে। এরপরও সরকারের অন্দর থেকে দাবি করা হচ্ছে, এই শুল্কের ফলে ভারতের সামান্যই লোকসান হবে—মোট জিডিপির ০.২ শতাংশ।

আরও পড়ুন-৮ অগাস্ট থেকে স্নাতকোত্তরে ভর্তির আবেদন

বাণিজ্যশুল্ক নিয়ে ট্রাম্প স্পষ্ট বুঝিয়েছেন, ভারত তাঁর বন্ধুরাষ্ট্রই নয়। বরং পাকিস্তান তাঁর অনেক কাছের। তাই তাদের দিতে হবে মাত্র ১৯ শতাংশ শুল্ক। সোজা কথায়, স্বাধীনতার পর থেকে আমেরিকা যেভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েই ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে গিয়েছে, সেই প্রবণতা মোদি-ট্রাম্পের তথাকথিত বন্ধুত্বে বদলায়নি। বরং প্রতিটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে সমর্থন ও সামরিক সাহায্য বেড়েছে। ট্রাম্প এই নয়া বাণিজ্য শুল্ক সংক্রান্ত এগজিকিউটিভ অর্ডারে স্বাক্ষর করে শুক্রবার বলেছেন, কয়েকটি দেশ সম্পর্কে আমি সম্প্রতি কিছু অতিরিক্ত তথ্য পেয়েছি। তাই সেইসব দেশের উপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আগামী ৭ অগাস্ট থেকে বলবৎ হবে এই নয়া শুল্ক নীতি। প্রশ্ন হল, ভারত বারংবার বলে এসেছে, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি হচ্ছে এবং ইতিবাচক দিকেই এগোচ্ছে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর অথবা বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বারবার বলেছেন, ভারত ও আমেরিকা উভয় পক্ষেরই লাভ হবে—এমন চুক্তি হচ্ছে। কিন্তু সেই চুক্তি এখনও হল না। বরং চুক্তির আগেই ট্রাম্প ভারতের উপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে দিলেন।
এসব নিয়ে ব্যর্থ মোদি সরকারের কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের মাথায় এখন ভিন্নতর দুষ্টুমির ঘুণপোকা। যার সুবাদে ‘বুরে দিন’ শুরু! শুল্ক ঘায়ে বিষফোঁড়া হিসেবে এবার ছ’টি ভারতীয় সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাল আমেরিকা। ইরানের সঙ্গে পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য ব্যবসার ‘অপরাধে’ ভারতীয় সংস্থাগুলির উপর খড়্গহস্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন।
তেহরানকে নিশানা বানিয়ে মার্কিন বিদেশ দফতর বুধবার বলেছে, নিজেদের অপকর্মের জন্য অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে পশ্চিম এশিয়ার সংঘাতে এখনও ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে ইরান সরকার। দেশের মানুষকে অবদমিত করতে ও বিদেশে সন্ত্রাসবাদে মদত দিতে ইরান যে অর্থ ব্যয় করে, তার প্রবাহ বন্ধে আজ পদক্ষেপ করল আমেরিকা। ওয়াশিংটনের বক্তব্য, ইরানকে শায়েস্তা করতেই তেহরানের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ও পেট্রোকেমিক্যাল সামগ্রীর ব্যবসা করা মোট ২০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপান হয়েছে। এই সংস্থাগুলি মূলত ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার। এই তালিকাতেই ভারতের ছ’টি সংস্থা রয়েছে। মার্কিন বিদেশ দফতর বলেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও দেশ বা ব্যক্তি ইরানের সঙ্গে তেল বা পেট্রোপণ্যের ব্যবসা করলে তাদের মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। তাদের আর আমেরিকায় ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া ভারতীয় সংস্থাগুলি হল কাঞ্চন পলিমার্স, অ্যালকেমিক্যাল সলিউশনস, রামনিকলাল এস গোসালিয়া অ্যান্ড কোম্পানি, জুপিটার ডাই কেম প্রাইভেট লিমিটেড, গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস লিমিটেড ও পারসিস্ট্যান্ট পেট্রোকেম প্রাইভেট লিমিটেড। এরই মধ্যে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার ‘বন্ধুত্বে’র নয়া বার্তা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের।

আরও পড়ুন-আবারও আদালতে প্রশ্নের মুখে সিবিআইয়ের ভূমিকা

এরই মধ্যে অমিত শাহর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রোজ ব্যর্থতার নতুন নতুন মাইলফলক ছুঁয়ে চলেছে। একদিকে তারা যেমন দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি অনুপ্রবেশের পথ রুখতে ব্যর্থ তেমনই বাঙালি যুবকের রুশ স্ত্রীর দেশ ছেড়ে পালানোর মামলায় শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র এবং দিল্লি পুলিশকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশেরই নিরাপত্তা গাফিলতির কারণে ভিক্টোরিয়া বসু নাবালক সন্তান স্তাভ্যকে নিয়ে রাশিয়া চলে যেতে সমর্থ হয়েছেন বলেই এদিন শুনানির পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেন বিচারপতি সূর্য কান্ত। সঙ্গে ছিলেন আর এক বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। কেন্দ্রের আইনজীবী তথা অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ঐশ্বর্য ভাট্টির উদ্দেশে তাঁরা বলেছেন, ভুলে গেলে চলবে না যে, বাচ্চাটি দেশের সুপ্রিম কোর্টের হেফাজতে ছিল। আমাদের হেফাজত থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে ফেরার হয়েছেন তার মা। দিল্লি পুলিশের গাফিলতিতে এই ঘটনা ঘটেছে।
দেশ জুড়ে সুশাসনের অন্তরায় এই বিজেপি। এদের বিদায় ঢাকে কাঠি পড়ার দিন বেশি দূরে নয়।

Latest article