আমাদের শরীরের নানা জৈবিক প্রক্রিয়ার নিখুঁত সচলতার এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী লাইসিন— একটি অত্যাবশ্যক অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মানবদেহে গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে রোগ-প্রতিরোধ পর্যন্ত বিস্তৃত প্রভাব ফেলে। প্রোটিন সংশ্লেষ, এনজাইম বা উৎসেচক সক্রিয়করণ, হরমোন উৎপাদন ও ক্যালসিয়ামের শোষণ— সবক্ষেত্রেই লাইসিন এক নীরব অথচ নির্ভরযোগ্য সহচর। এই নিবন্ধে আমরা লাইসিনের সেই নেপথ্য ভূমিকার পর্দা সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করব— একটি মৌলিক অণু কীভাবে প্রাণযন্ত্রের সুরে সুর মেলায়।
আরও পড়ুন-অভিষেকের প্রশ্নে সংসদে বেআব্রু হল মোদি সরকার
লাইসিনের গুরুত্ব
লাইসিন আমাদের দেহের সার্বিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। প্রোটিনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে এই লাইসিন আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন উৎপাদন করে। দেহের ভিতরের কোষগুলোকে সারিয়ে তোলা, মাংসপেশিগুলোর ঠিকঠাক বৃদ্ধি, শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালের সবরকম গঠন ও কাজকর্ম যেন ঠিকমতো হয়, সে-খেয়ালও রাখে লাইসিন। শরীর চালানোর জন্য জরুরি শক্তি উৎপাদন ও ফ্যাটি অ্যাসিড মেটাবলিজমের জন্য দরকারি কারনিটিন তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই লাইসিনের। মানবদেহের সামগ্রিক কোষের দেখভাল, হাড়ের শক্তি ধরে রাখা, ক্ষতস্থান সারিয়ে তোলা কিংবা চামড়ার মতো কানেকটিভ টিস্যুর সুস্থতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় কোলাজেন সংশ্লেষণেও প্রধান কাজটি করে ওই লাইসিন।
প্রয়োজনে নানারকম খনিজ পদার্থগুলোকে মানবদেহের নানা জায়গায় পৌঁছে দেয় লাইসিন। এটি এমন একটি মৌলিক অ্যামিনো অ্যাসিড, যা ক্যালসিয়াম হোমিওস্ট্যাসিসে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে প্যারাথাইরয়েড হরমোন ও ক্যালসিটোনিনের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। হিস্টোন মডিফিকেশনে, লাইসিন রেসিডু অ্যাসেটাইলেশন বা মিথাইলেশনের মাধ্যমে জিনের এক্সপ্রেশন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে, এপিজেনেটিক নিয়ন্ত্রণে লাইসিন একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে, যা এপিজিনোমের গঠন ও কার্যকারিতাকে নির্ধারণ করে।
আরও পড়ুন-হিমাচলের পরিবেশ, উদ্বেগে শীর্ষ আদালত
লাইসিনের পরিচয়
লাইসিন আমাদের শরীরের একটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, যা বহুসংখ্যক প্রোটিন উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে কাজে লাগে। অ্যামিনো অ্যাসিড হল এমন একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ যার মধ্যে অ্যামিনো এবং কার্বক্সিলিক অ্যাসিড উভয়ই কার্যকরী গ্রুপ হিসেবে উপস্থিত থাকে। প্রায় ৫০০টি এই ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ২২টিকে মানব জীবনের জেনেটিক কোডে দেখতে পাওয়া যায়। এই ৫০০টির মধ্যে আবার মাত্র ২২টি আলফা অ্যামিনো অ্যাসিড, যেগুলো প্রোটিন-শৃঙ্খলে যুক্ত থাকে, যার মধ্যে লাইসিন অন্যতম। আমাদের শরীরের মধ্যে উপস্থিত মাংসপেশি ও অন্যান্য কোষসমূহে যে প্রোটিন ব্লকগুলো রয়েছে, তাদের গঠনে জলের পরে দ্বিতীয় যে উপাদানটির আধিক্য রয়েছে, তা হল অ্যামিনো অ্যাসিডের অংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রির নির্ধারিত নামকরণে লাইসিনের সাধারণ নাম তো লাইসিনই। তবে সিস্টেমের নাম কী? সেটা হল ২,৬-ডাই-অ্যামিনো-হেক্সানোয়িক অ্যাসিড। যদিও মানবদেহ সরাসরি লাইসিনকে নিজের মধ্যে সংশ্লেষ করতে পারে না; তাই দৈনন্দিন জীবনে নানারকম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই লাইসিন আমাদের দেহে প্রবেশ করে। এটি বায়োসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় প্রোটিন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি নিউরোট্রান্সমিটারের সঠিক পরিবহণে সহায়তা করে, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতায় ভারসাম্য আনে। এছাড়া, পৃথিবীর প্রাচীন প্রাণ সৃষ্টির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় লাইসিনের উপস্থিতি প্রমাণ করে প্রোটিন জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল, যা জীবনের আবির্ভাবে এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিল বলে গণ্য করা হয়।
লাইসিন সর্বপ্রথম খুঁজে পাওয়া যায় ক্যাসেইন নামে একপ্রকার ফসফোপ্রোটিনের হাইড্রোলাইসিসের সময়। সেই ১৮৮৯ সালে জার্মান জৈব রসায়নবিদ ফার্দিনান্দ হাইনরিখ এডমান্ড ড্রেসেল লাইসিনকে আলাদা করেন। স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে প্রায় ৮০ ভাগই ফসফোপ্রোটিন, সেই তুলনায় মানুষের দুধে মাত্র ২০-৬০ ভাগ। ক্যাসেইন প্রাথমিকভাবে দুধের মধ্যে তেল কিংবা চর্বি ও জলকে একত্রে মেশানোর জন্য এমালসিফায়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্রিক শব্দ লাইসিস, যার অর্থ আলগা করা, ওখান থেকেই লাইসিন কথাটা এসেছে। ১৯০২ সালে দু’জন জার্মান রসায়নবিদ এমিল ফিসার ও ফ্রিৎজ্ উইজার্ট লাইসিনের সংশ্লেষণ করে তার কেমিক্যাল স্ট্রাকচার প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন-‘দিদি’র সিদ্ধান্তে সম্মানিত অভিষেক
লাইসিনের অভাব
লাইসিন আমাদের শরীর তথা প্রাণীদেহের জন্য আবশ্যিক একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ। এই লাইসিনের পরিমাণ দেহের মধ্যে ঘাটতি দেখা দিলে নানারকম জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, শরীরের সংযোজক কোষগুলোর কাঠামোতে আঘাত করে, ফলে চামড়ার স্থিতিস্থাপকতা, হাড়ের স্বাস্থ্য ও গাঁটের নমনীয়তা ব্যাহত হয়। নির্ধারিত ফ্যাটি অ্যাসিড মেটাবলিজম ঠিকমতো হয় না, কারনিটিনের উৎপাদন কমে যায়, মাইটোকন্ড্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ফ্যাটি অ্যাসিড পৌঁছায় না। শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেহে বিপাকীয় সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান কমে যায়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, অনাক্রম্যতা কমে, নানারকম রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। লাইসিনের অভাবে লোহিত রক্তকণিকায় মজুত প্রোটিন, হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমে যায়, আয়রন বা লোহার ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে প্রাণীদেহ অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতায় ভোগে।
প্রয়োজনীয় খনিজগুলো ঠিকঠাক শরীরের সবজায়গায় পৌঁছায় না, ক্যালসিয়াম ফসফরাসের ঘাটতি পূরণ হয় না, অপুষ্টি বাড়ে, শরীর মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়, এই লাইসিনের কমতি হলেই। মস্তিষ্কের মধ্যেকার স্নায়বিক কাজকর্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়, ফলে নানা ধরনের নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের শিকার হয় মানবদেহ। বলে রাখা ভাল, লাইসিন সরাসরি প্রাণিদেহের কোনও নির্দিষ্ট একটি রোগের কারণ নয়, লাইসিনের অভাবে নানারকম রোগের লক্ষণ ফুটে ওঠে আমাদের দেহে। তবে বৈজ্ঞানিক কসরত জারি আছে, খুঁজে দেখার চেষ্টা চলছে, শরীরের কোনও রোগের সঙ্গে সরাসরি লাইসিনের কোনও যোগ রয়েছে কি না।\
আরও পড়ুন-লিস্টনের জোড়া গোল, জিতল মোহনবাগান
লাইসিনের লক্ষ্য
প্রাণিদেহের সাধারণত লিভারে, বিশেষ করে মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে লাইসিনের ক্যাটাবলিজম বা বিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শিশুদের ক্ষেত্রে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম প্রতি কেজি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩০ মিলিগ্রাম প্রতি-কেজির মতো লাইসিনের পুষ্টিগত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রতিদিনকার জীবনে আমরা যেসব খাবার খাই, আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে তার মধ্যে যেন লাইসিনের উপস্থিতি যথেষ্ট হয়। সাধারণত ডিম, গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, শুয়োরের মাংস, পোল্ট্রি কিংবা পারমেজান চিজ, আবার মাছ বলতে কড কিংবা সার্ডিন এমনকী ডালশস্যের মধ্যেও লাইসিন ভরপুর পাওয়া যায়। ব্যস, আমাদের খাদ্যগ্রহণের সময় যেন সবকিছুই ব্যালান্সড হয়, সেদিকে নজর দিলেই আর কোনও সমস্যা নেই।