অনেক দিনের কর্মসূচি এটা আরএসএস-এর। শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, তিনটেকেই কবজা করা।
আইন বিভাগে এখন বিজেপি (BJP)। সংসদে এবং অধিকাংশ বিধানসভায় তাদের সংখ্যাধিক্য। কেন্দ্রে মোদি সরকার, মানে শাসন বিভাগের দখল তারা নিতে পেরেছে।
রামমন্দির হয়ে গেছে। ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত। এবার তারা হাত বাড়িয়েছে বিচার বিভাগের দিকে।
কেন এই অনুভব? সেটা বোঝানোর জন্য একটা জীবনপঞ্জি তুলে ধরা যাক।
নাম আরতি সাঠে। আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাবা অরুণও বর্ষীয়ান আইনজীবী। বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে কোনও অসুবিধা নেই। নেই বিতর্কের অবকাশ। ২০ বছরের আইনি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাঠে মূলত প্রত্যক্ষ কর সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর বিরোধ পরিচালনা করেছেন। তিনি বোম্বে হাইকোর্টে বৈবাহিক বিরোধে ক্লায়েন্টদের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI), সিকিউরিটিজ অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল (SAT) এবং কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল (CESTAT)-এর সামনে মামলাও পরিচালনা করেছেন।
এসবে কোনও অসুবিধা নেই।
কিন্তু গোল বেধেছে অন্য জায়গায়।
অরুণ সাঠে বিজেপির সক্রিয় কর্মী। দীর্ঘদিন আরএসএসের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাতেও অসুবিধা ছিল না।
কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। স্বয়ং আরতি সাঠে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্র বিজেপির মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত হন। সবে গত বছর জানুয়ারিতে ওই পদে ইস্তফা দিয়েছেন। আর এই অগাস্ট মাসে তাঁকে বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ করা হয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে রাজনীতির আখড়া করে তোলার চেষ্টা সুস্পষ্ট। দেশের সংবিধানকে অপমান করারও বন্দোবস্ত। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধানকে কোণঠাসা করা হচ্ছে। সমস্ত স্বশাসিত সংস্থা এমনকী নির্বাচন কমিশনও বর্তমান সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলছে। এবার কোপ পড়েছে বিচার ব্যবস্থায়। এটি ন্যায়বিচার এবং সংবিধানের জন্য একটি গুরুতর বিপদ।
বিচার ব্যবস্থার প্রতি দেশের আমজনতার আস্থা রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আবেদন, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হোক। অবিলম্বে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করা হোক।
বিচারক হিসেবে একজন রাজনৈতিক মুখপাত্রের নিয়োগ কি ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতিকে লঙ্ঘন করে না এবং সম্প্রসারিতভাবে, সংবিধানকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা গঠন করে না? নিযুক্ত ব্যক্তির যোগ্যতার উপর কোনও আপত্তি না থাকলেও, এই ধরনের সিদ্ধান্ত সাধারণ নাগরিকদের অনুভূতিতে আঘাত করে, যে কোনও পক্ষপাত ছাড়াই ন্যায়বিচার প্রদান করা হয়।
অনতি অতীতে কলকাতা হাইকোর্টেও এ জিনিস দেখেছি। নন্দীগ্রামের নির্বাচনী মামলার সময় বিচারপতি কৌশিক চন্দকে নিয়ে যে-ভাবে বিতর্ক হয়েছে, সাম্প্রতিক কালে কলকাতা হাইকোর্টের ক্ষেত্রে সেটা নজিরবিহীন। বিচারপতি চন্দর এজলাসে শুনানি হলে মিলবে না সুবিচার। এই যুক্তিতে মমতা বন্দোপাধ্যায় ওই এজলাস থেকে মামলা সরানোর আবেদন জানান। আইনের পরিভাষায় যাকে বলে ইন্টার লোকেটারি অ্যাপ্লিকেশন।
বিচারপতি চন্দের জন্ম ১৯৭৪ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে আইনে স্নাতক হওয়ার পরে ১৯৯৮ সালে আইনজীবী হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন তিনি। বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন ভাবে ওকালতির পাশাপাশি কৌশিকবাবু ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ছিলেন। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর তিনি অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারপতি চন্দকে স্থায়ী পদে নিয়োগের ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুখ্যমন্ত্রীর মতামত চেয়েছিলেন। তার জবাবেই নিজের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কৌশিকবাবু যখন আইনজীবী ছিলেন, সেই সময়ে তাঁর বিজেপি-ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি প্রায় সর্বজ্ঞাত।
কৌশিক চন্দ বিজেপির ঘনিষ্ঠ শুধু নন, তাঁকে বিজেপির সভায় উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে। বিজেপির হয়ে একাধিক মামলা লড়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে একটি ফেসবুর পোস্টে তথাগত রায় এজন্য কৌশিক চন্দের ব্যাপক সুখ্যাতি করেন। এ-ধরনের নানান প্রশ্ন ও আপত্তি ওঠার পরে বিচারপতি চন্দ নন্দীগ্রামের সেই নির্বাচনী মামলার শুনানি থেকে অব্যাহতি নেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচারপতি কৌশিক চন্দকে কলকাতা হাইকোর্টের স্থায়ী পদে নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্ট।
যদি একটি স্বাধীন বিচার বিভাগকে একটি প্রজাতন্ত্রের হৃদয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র বর্তমানে গুরুতর হৃদরোগে ভুগছে। প্রকৃতপক্ষে, দেশের উচ্চতর (উচ্চতর) বিচার বিভাগ সম্প্রতি বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ উভয়ভাবেই ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হচ্ছে, যা আমাদের রাজনৈতিক শরীরের স্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং অগ্রগতিকে পঙ্গু করে দিতে বাধ্য, কারণ একটি অসুস্থ হৃদয় তার জনগণের সুস্থ স্বাস্থ্যের জন্য তীব্র রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না।
পরিশেষে একটা সত্য কথা উচ্চারণ।
আইন প্রণয়নের এক ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার আলাপ করেছিলেন কেসভিক। তিনি বলেন, ‘বিচারের পর্বতপ্রমাণ ভ্রান্তি হচ্ছে কোনও কোনও গোষ্ঠী এই বিশ্বাস দ্বারা আক্রান্ত যে ন্যায়পরতাকেও আইনের অক্ষর দ্বারা বিধিমালায় রূপান্তর ঘটানো যায়। তারা ভুলে যায় কিংবা জানেনই না যে প্রাচীন গ্রিকরা ব্যর্থ হয়েছেন, হয়েছেন রোমানরা, এমনকী শিল্পবিপ্লবের উন্নত দশাও এই ভ্রান্ত অসম্ভাব্যতাকে জারি রেখেছে। চারিত্রিক ন্যায়পরতার ব্যাপারে আইনের খসড়া যার দায়িত্ব, তার চাইতে বড় নির্বোধ আর বোধ হয় কেউ নাই।’
আরও পড়ুন: শুল্কবৃদ্ধির জেরে লাভের গুড় খেতে চলেছে অন্য একাধিক দেশ