কানায় কানায় পূর্ণ নন্দন-৩। সমস্ত আসন ভর্তি। বহু মানুষ দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের চোখ পর্দায়। ভেসে উঠছে চলমান ছবি। কোনও পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র নয়, তথ্যচিত্র দেখার জন্য চোখে পড়ল দর্শকদের প্রবল উৎসাহ। ৬ অগাস্ট, বিকেলে। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস আয়োজিত একটি আসরে।
আরও পড়ুন-আজ জগন্নাথধামে সাড়ম্বরে বলরামজয়ন্তী দিল্লি থেকে এলেন ইসকনের ২২ সন্ন্যাসী
একটা সময় তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। ধীরে ধীরে বদলেছে পরিস্থিতি। এখন বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হয় তথ্যচিত্র। আয়োজিত হয় তথ্যচিত্রের উৎসবও। ফলে দর্শকদের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস চলচ্চিত্রের প্রসার ও প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সারা বছর বিভিন্ন জায়গায় চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে। দেখায় দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত ছবি। সেইসঙ্গে গুরুত্ব সহকারে তথ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করে।
এইদিনের অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়েছে তিনটি তথ্যচিত্র। ছিলেন প্রযোজক-পরিচালক অঞ্জন বসু। সংস্থার পক্ষে সবাইকে স্বাগত জানান রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম তথ্যচিত্র অভিজিৎ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘শবর— অরণ্যের অন্ন কথা’। ২০২৪ সালে নির্মিত। রাঢ় বাংলার শবর জনজাতির মানুষদের নিয়ে বোনা। তাঁরা মূলত অরণ্যচারী। অরণ্য তাঁদের কাছে দেবতাস্বরূপ। তুলে ধরা হয়েছে শবরদের দৈনন্দিন জীবনের কথা। যে-জীবন সমস্যা-জর্জরিত। তা সত্ত্বেও বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষগুলো নিজেদের নিয়ে আনন্দই আছেন। সুরক্ষিত রেখেছেন বনভূমি। বাঁচিয়ে রেখেছেন আপন সংস্কৃতি। মেতে ওঠেন টুসু পরব, শবর উৎসবে। অভাব আছে, কিন্তু অভিযোগ নেই। নেই লোভ। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই প্রকৃতির কাছ থেকে হাত পেতে নেন। এমন অনেক দিন গেছে, পেটে খিদে, অথচ উনুনে হাঁড়ি চড়েনি। খিদে ভুলতে কেউ কেউ ডুবেছেন নেশায়। আপনমনে গেয়েছেন গান। বেজে উঠেছে মাদল। সমস্তকিছু চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে ছবিতে। সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী শবর সম্প্রদায়ের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁদের উপর লেখালেখি করেছেন। তাঁর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে শবরদের জীবন এবং তাঁদের ভূমি ও অরণ্যের অধিকারের জন্য সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও, তিনি শবর সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। শবরদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারের জন্য কাজ করেছেন, তাঁদের সমাজের মূল স্রোতে আনার জন্য চেষ্টা করেছেন। এই সমস্তকিছু দেখানো হয়েছে ৬০ মিনিটের ছবিতে। তুলে ধরা হয়েছে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার। পুরুলিয়ায় হয়েছে শ্যুটিং। ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনায় সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী। সহকারী সাম্যজিৎ চক্রবর্তী। আকাশচিত্র স্বর্ণদীপ নাগের।
দ্বিতীয় তথ্যচিত্র ‘দ্বিতীয় পুরুষ’। পরিচালনা করেছেন অলোক দেব। ৩০ মিনিটের ছবিটি নির্মিত হয়েছে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর উপর। কম বয়সেই শিশিরকুমার অপেশাদার থিয়েটারে অভিনেতা হিসেবে আলোড়ন তুলেছিলেন। পেশায় তিনি তখন মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। ম্যাডান কোম্পানির নজর পড়েছিল তাঁর উপর। তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশিরকুমার চাকরি ছেড়ে যোগ দেন থিয়েটারে। ১৯২১ সাল। প্রথমেই মঞ্চস্থ করেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলমগীর’। প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুনত্বের ছোঁয়া। শুরুতেই বিপুল জনসমাদর। ১৯২২ সালে একই নাট্যকারের ‘রঘুবীর’ নাটকে নাম ভূমিকায় ও দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ‘চাণক্য’ চরিত্রে রূপদান। ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেন্স-এ অনুষ্ঠিত ক্যালকাটা ফেস্টিভ্যাল-এ নাটক মঞ্চস্থের সুযোগ। শিশিরকুমার অভিনয়ের জন্যে বাছলেন দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’। নাম ভূমিকায় প্রভা দেবী এবং রামচন্দ্র শিশিরকুমার স্বয়ং। দারুণ জমে গেল নাটক। কিন্তু এই নাটকটি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হল। ১৯২৪-এর ৬ অগাস্ট যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ মঞ্চস্থ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু নাটক মঞ্চে এনেছিলেন শিশিরকুমার। ১৯২৬ সালে ‘বিসর্জন’। প্রথমে ছিলেন রঘুপতির ভূমিকায়, পরবর্তীতে দশম অভিনয়ে জয়সিংহের ভূমিকায়। ১৯২৭ সালে ‘শেষরক্ষা’। ১৯৩০ সালে ‘তপতী’। শিশিরকুমার নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করেন শরৎচন্দ্রের ‘ষোড়শী’ উপন্যাস। এছাড়াও মঞ্চস্থ করেছেন আরও অনেক নাটক। বাংলার পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁর অবদানের কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। শিশিরকুমারের স্নেহচ্ছায়ায় এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গুরুর নাট্যনির্মাণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেন তিনি। এছাড়াও শিশিরকুমারের উপর আলোকপাত করেন পবিত্র সরকার এবং গণেশ মুখোপাধ্যায়। অনবদ্য তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে।
আরও পড়ুন-কতগুলো প্রশ্ন তো থেকেই গেল…
তৃতীয় তথ্যচিত্র ‘একটা ডাক আসা দরকার’। চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা এবং পরিচালনায় দিব্যেন্দু পোড়েল। বেতার-দূরদর্শন-ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ সাহার উপর নির্মিত। কবি হিসেবেও তিনি সমাদৃত। তাঁর ব্যক্তিজীবন এবং কর্মজীবন তুলে ধরা হয়েছে ৯৮ মিনিটের এই ছবিতে। নিজের কথা বলেছেন পঙ্কজ সাহা। পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে বলেছেন পবিত্র সরকার, বিভাস চক্রবর্তী, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, চৈতালি দাশগুপ্ত, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, পূর্ণচন্দ্রদাস বাউল, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত প্রমুখ। পঙ্কজ সাহার কবিতা আবৃত্তি করেছেন প্রণতি ঠাকুর। ভাষ্যপাঠে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। শ্যুটিং হয়েছে ২০২৩ সালে। এই দিনই হল প্রথম প্রদর্শন। তিনটি তথ্যচিত্রই মন ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের।