রাতে প্রতিবাদ স্রেফ ক্যালকুলেটিভ

রাত দখলের নাটকের পুনরাভিনয়। কিন্তু কেন? বিচার চেয়েছিলেন। তদন্ত চেয়েছিলেন। তদন্তকারী বেছেছেন আপনারাই। এখন তদন্ত রিপোর্ট মনোমত হয়নি। তাই তদন্তকারী সংস্থার প্রতি ক্ষোভ। স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক যেটা সেটা হল, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার প্রতি ক্ষোভ দেখাতে প্রতিবাদ রাজ্যের রাস্তায়। অপূর্ব! এবং মর্মান্তিক। এই হিসেবি আন্দোলনের কানাগলি বেছে নেওয়া তো আদতে প্রতিবাদের ঝাঁঝটাই নষ্ট করে দেওয়া। সেই সঙ্গে আছে আন্দোলনের হাওয়া তুলে আর্থিক তহবিলের স্ফীতি ঘটানোর গোপন অ্যাজেন্ডা। মুখোশ ছিঁড়ে সত্যিটা তুলে ধরলেন পৌলমী ভট্টাচার্য

Must read

বহুদিন আগে পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতায় পড়েছিলাম, ‘‘বৃক্ষ শব্দটাকে আমরা ঠিকমত উচ্চারণ করতে ভুলে গেছি /আর বজ্র শব্দটাকেও’’ … আজ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, প্রতিবাদ (Protest) শব্দটিকেও বোধ করি উচ্চারণ করতে ভুলেছি আমরা। যদিও এ কবিতার শরীর ধরে এগোলে, আরও একটি লাইনে গিয়ে ঠোক্কর খেতে হয়।
‘‘মুক্তি শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে একবার আমাদের হাড়মাসে ঢুকে পড়েছিল কনকনে শীত। তাই সংগ্রাম শব্দের মত তাকেও আমরা যৎপরনাস্তি এড়িয়ে চলি’’ … এই এড়িয়ে চলাটাই যেখানে দীর্ঘদিনের প্রতিপাদ্য, সেখানে হঠাৎ প্রতিবাদের হিড়িক মুখবদলের স্বাদ দেয় বৈকি। তবে, আভিধানিক অর্থে ‘‘প্রতিবাদ’’ শব্দের অর্থ যেহেতু কোন কিছুর বিরোধিতা করা বা আপত্তি জানানো। তাই প্রতিবাদ কোনও কাজের প্রতি অসন্তুষ্টি বা অসম্মতি প্রকাশ করার একটি মাধ্যম তো বটেই। আর সেই কারণেই গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদ, কেবল ঘটনা মাত্র নয়, বরং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর একটি অধ্যায়।

কিন্তু বেদনার হলেও প্রবল সত্যকে অস্বীকার করলে ইতিহাস ক্ষমা করে না। সত্তর দশকের উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের মাঝ-বরাবর প্রতিষ্ঠিত বাম শাসনের আশ্চর্য শান্তির ঘেরাটোপে প্রতিবাদ (Protest) শব্দটির ক্রমাগত ক্লিশে অবস্থান বাংলা তথা বাঙালির কাছে এক বিরাট জিজ্ঞাসার মতো ঝুলে থেকেছে। গোটা সময় জুড়ে মেনে ও মানিয়ে নেওয়ার সে সুচারু অনুশীলনের পুরস্কার স্বরূপ ‘‘পাইয়ে দেওয়ার’’ এক চমৎকার রাজনীতি। শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদের স্পর্ধা হারানো একটা জাতি কেবল বলশেভিক বিপ্লবের স্বপ্ন মাখা চোখে ক্লাব সংস্কৃতির উঠোন থেকে পাড়াময় নজরদারি করেছে। প্রতিবাদ করেনি।

আরও পড়ুন-পুজোয় ফিরছে ’রক্তবীজ ২’

পুঁথি-পোড়ো সেই ক্লীব প্রজন্মের কাছে সংগ্রাম শব্দটিকে যৎপরনাস্তি এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি। গোল বেঁধেছে, অধুনা যাত্রাপথে। গণতন্ত্রের বিরোধীপক্ষের অবস্থান চিরকালই তীব্র হওয়া জরুরি। তাতে রাষ্ট্র কাঠামোর আদতে উপকার। কিন্তু শাসকের বিপরীতে দাঁড়িয়েও সংগ্রামে অনভ্যস্ত সুবিধাবাদ তার জায়গা ছাড়বে কেন? বা ছাড়তে চাইলেও, ছাড়তে পারবে কেন? তাই, তলায় তলায় মাথা রেখে উপরের অংশে বিভক্ত প্রতিবাদ। যার কোনও আশু পূর্ণতা নেই। আছে, জনমনের আবেগ নিয়ে চু-কিত-কিতের অবকাশ।
চেম্বারের ঘেরাটোপে চিকিৎসার মতো সংবেদনশীল দায়িত্বের ভার নিয়েও যথেষ্ট চেনা পরিচিতির গণ্ডিতে পৌঁছতে না পারার বেদনা, ‘‘মিছিলের মুখ’’ হয়ে উঠে আত্মসুখ খোঁজে। যার সঙ্গে যোগ নেই, সমাজের স্বজনের। তাই, সমর্থনের তির সামান্য সরে গেলেই, পাততাড়ি গুটিয়ে দৌড়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা প্রধান ও প্রথম বিবেচ্য নয়। প্রতিবাদ কোথায় কতটা ভাপ দেবে সুবিধাবাদের তারজলিতে, তার নির্ভুল পাটিগণিত। অন্যায়টুকুই পাখির চোখ নয়। প্রতিপদে প্রতিবাদের চমৎকার বাজারদর নিরীক্ষণ।
মৃত্যুর কাফনে মোড়া শোকের অবয়ব থেকে, পেড়ে আনা সংস্কৃতির নির্লজ্জ আরক।
সন্তান হারানোর যাতনা প্রতিবাদের আগুন হল না। হয়ে গেল মিডিয়ার কনটেন্ট। এ কেবল চূড়ান্ত কষ্ট এর নয়। লজ্জার।
ব্যক্তিজীবনে ঘাড় গুঁজে প্রতিটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে দিতে হঠাৎ সন্ধ্যার টেলিভিশন চ্যানেলে স্কুল শিক্ষিকার স্বরসপ্তকে মেলে ধরা গোল গোল কথা সস্তা জনপ্রিয়তার আশ্চর্য ককটেলে বাঙ্গালিকে বুঁদ করলেও প্রেরণার শিকড় হয়ে উঠতে স্বভাবতই অপারগ। গোটা আয়োজন প্রতিবাদের সারবত্তায় টনক নড়িয়ে দেওয়ার দায় থেকে হাজার হাজার যোজন দূরে।

এই প্রসঙ্গে, মনে পড়ছে কয়েকদিন আগের একটি দৃশ্য। এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেটের কাছে একটি প্রিজন ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবাদী (Protest) জননেতা পথ অবরোধ করেছেন বলে, পুলিশ সবেগে ধাবমান। রাস্তা অবরুদ্ধ। সেই রাস্তার এক ধারে আটকে পড়া অসংখ্য প্রাইভেট বাসের একটিতে সওয়ারি আমি ও আমার মতো আরও অনেকে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ জননেতার হাতের কনুইটি ধরেছে। জননেতা ওই হাতেই পুলিশকে ইশারা করছেন তাঁর কলার ধরতে, বাম হাত উঁচু করে কাউকে বলছেন দ্রুত ছবি তুলতে। খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়া এমন একটি দৃশ্য যারপরনাই হাসি ছড়িয়েছিল, বাস ভর্তি জনগণের। সেদিন গরমে পথ অবরোধের বিপদ কিছুটা হলেও আমাদের লঘু হয়েছিল, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। পরে দেখেছি, জননেতার ওই ছবিটি তাঁর ফেসবুকের কভার পিকচার হয়েছে। এখন পোড়া দেশের জনগণের সামনে এমন একটি লাইভ কমেডি উপহার দেওয়ার জন্য জননেতা ধন্যবাদ-প্রাপ্য হতেই পারেন, কিন্তু, অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের বিরোধী অবস্থান থেকে প্রতিবাদ শব্দটিকে রাস্তার ধুলোয় টেনে আনার আহাম্মকি ইতিহাস ক্ষমা করবে কি!

Latest article