রামরেডরা স্বাধীনতার শত্রু

জাতীয়তাবাদ নিয়ে এত হম্বিতম্বি! আসলে তো ওরা কোনওদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশই নেয়নি। কেউ দেখাতে পারবেন একজন গেরুয়া পার্টির নেতার নাম, যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন? যে তেরঙ্গা নিয়ে ওদের এত বুকনি সেই ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার ঘোর বিরোধী ছিল ওই গেরুয়া পক্ষ। এই নষ্টামির ইতিহাস যাদের, তারাই আজ নষ্ট করতে চায় আমাদের ইতিহাস। আবার, ১৯৪৭ এর অগাস্ট মাসে আজকের রাম-বামদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতার লড়াইকে বয়কট করেছিল। স্বাধীনতার আসল শত্রুদের চেনাচ্ছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

স্বাধীনতা দিবসে আমরা যখন শহিদদের স্মরণ করি, তখন আমরা যেন না ভুলি যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। হেডগেওয়ার কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসে অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন। তিনি মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে একটাও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন কি? সাভারকর মুক্তির পর ইংরেজ বিরোধী অবস্থান আর গ্রহণ করেননি। ভাই পরমানন্দ একই পথে গেছেন। আশুতোষ লাহিড়ীও তাই। শ্যামাপ্রসাদ তো জেলেও যাননি। সংগঠন হিসেবে হিন্দু মহাসভা বা আরএসএস সক্রিয়ভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেছে এমন প্রমাণ নেই। দল হিসেবে করেনি। ব্যক্তি বিশেষ কংগ্রেসি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন হয়তো। এঁরা সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন মুসলিম বিরোধিতায়। জিন্না ও তাঁর দলবল শক্তি ব্যয় করেছেন হিন্দু বিরোধিতায়।
ভাগ্যের বিড়ম্বনা যে এরাই আজ খাঁটি দেশভক্ত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মতবাদের যোগদান শূন্য। এই কথা জনে জনে প্রচার করা হোক।

আরও পড়ুন-সুস্থ হয়েই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছবির আবদার ছোটদের

‘হর ঘর তিরঙ্গা’ আর ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ শুনলে সাধারণ লোকের মধ্যে ধারণা হয় যে বর্তমান মোদি সরকারই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল এবং সর্বাধিক আবেগময়। জাতীয় পতাকার প্রতি যে কোনও অশ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি বা সংগঠনকে শাস্তিদানের জন্য এরা মুখিয়ে থাকে।
এই উগ্র জাতীয়তাবাদ দেখিয়ে কিন্তু ধর্মান্ধ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং হিন্দু মহাসভার আড়াল করে তাদের আসল ইতিহাস। তারা যে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার প্রতি কী অশ্রদ্ধাশীল ছিল সেই অধ্যায়টি আড়াল করার চেষ্টা আর কী!
আসল সত্য হল যে এই দুই হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী সংগঠনই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তাদের সদস্যদের তো লিখিত নির্দেশ দিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে। আর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভা সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। এর আগে হিন্দু মহাসভার সর্বোচ্চ নেতা, ভি ডি সাভারকর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য নির্লজ্জভাবে ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা কাপুরুষ পরম্পরা তৈরি করেন।
এই ভূমিকা বিশেষভাবে বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে ৯ অগাস্ট ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়— যখন ব্রিটিশরা হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীকে জেলবন্দি করছিল এবং তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছিল। হিন্দুত্ববাদীর দলের নেতা ও বাংলার মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আন্দোলন বয়কটের ডাক দিয়ে ছিলেন। ভুলে যেন না যাই, সেদিন একইভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে পা মাড়ায়নি কম্যুনিস্ট পার্টিও।
শ্যামাপ্রসাদ ২৬ জুলাই, বাংলার গভর্নর জন হারবার্টকে একটি বিতর্কিত পত্রে স্বাধীনতার লড়াইকে প্রবলভাবে সমালোচনা করেন। তিনি আর্জি জানালেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে, ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যদি কেউ জনগণের আবেগে নাড়া দিয়ে অভ্যন্তরীণ গােলযোগ বাধায় কিংবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, তবে সরকারের তাকে অবশ্যই প্রতিহত করা উচিত।’ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইংরেজ সরকারের আরও প্রীতিভাজন হওয়ার জন্য শ্যামাপ্রসাদ গভর্নরকে লিখলেন, ‘এই সংকট মুহূর্তে দেশ ও রাজ্যের সেবা করার জন্য আপনার একজন মন্ত্রী হিসেবে আমি আপনার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ একই রকম কথা কম্যুনিস্ট পার্টির পি সি যোশী লিখেছিলেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গভর্নর হারবার্টকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, ‘‘বাংলার প্রাদেশিক সরকার এমনভাবে প্রশাসন চালাবে যে আপ্রাণ চেষ্টা করেও কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হবে।’’ তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন সরকার বাহাদুরকে যে, তাঁর দলের মন্ত্রীরা জনগণকে বোঝাবেন যে স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস আন্দোলন শুরু করেছে সেই স্বাধীনতা ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধিরা পেয়ে গিয়েছেন… ভারতীয়দের উচিত ব্রিটিশদের ওপর ভরসা রাখা।” সব লিখিত নথিতে আছে।

আরও পড়ুন-দেহ হস্তান্তর নিয়ে গুজব পোস্টে সতর্ক করল পুলিশ

স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৪৭-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যার মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ আরএসএস কংগ্রেসের মত ও পথের প্রকাশ্য বিরোধিতার কথা ঘোষণা করেছিল। এই পত্রিকায় বলা হয়েছিল, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কোনওদিন তেরঙ্গা জাতীয় পতাকাকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করবে না। কারণ, ‘তিন’ সংখ্যাটাই অশুভর ব্যঞ্জনাবাহী আর তাই যে পতাকার তিনটে রং আছে সেটা জনমানসে নিঃসন্দেহে খারাপ প্রভাব ফেলবে এবং দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।
এই যুক্তিতে হিন্দু ধর্মের ত্রিমূর্তি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, অগ্রহণীয় এবং ভগবদ্গীতায় বর্ণিত ত্রিগুণ বর্জনীয়। ত্রিশূলেও তিনের প্রকাশ, তাই এটাও অশুভ! ‘বাঞ্চ অব থট্‌স’ শীর্ষক গ্রন্থে আরএসএস-এর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তিত্ব এম এস গোলওয়ালকর লিখেছেন, ‘আমাদের নেতৃবর্গ দেশের নতুন পতাকা নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু তাঁরা এমনটা করলেন কেন?… আমাদের দেশ সুপ্রাচীন এবং মহান, সেটির একটি মহান অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা ছিল না? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক বলে কিছু ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মননে এমন শূন্যতা কেন?’
গোলওয়ালকর চেয়েছেন পুরোপুরি হিন্দু পতাকা ‘ভাগওয়া ধ্বজ’ বা গেরুয়া রঙের চেরা পতাকাই ভারতের জাতীয় প্রতীক হোক। জাতীয় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা যে ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদের প্রতিনিধিত্ব করছে একেবারেই মানেননি।
গান্ধী-হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৮ মাসের জন্য যখন ভারতের তদানীন্তন উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আরএসএসের নেতৃবর্গকে জেলবন্দি করলেন, তখন আরএসএস জাতীয় পতাকার বিরোধিতার পথ পরিহার করে। জুলাই, ১৯৪৯-এ কারামুক্তির শর্ত হিসেবে তাদের মুচলেকা দিতে হয়েছিল যে তারা ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
আর এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে, জাতীয় পতাকার প্রতি যথাবিহিত মর্যাদা প্রদর্শনের অভাব ঘটলে নিরীহ নাগরিকদের পেটানোর দায়িত্ব নিচ্ছে সংঘ পরিবারের বাহুবলীরা।
এটাই হল নরেন্দ্র মোদির ও তাঁর সাম্প্রদায়িক দলের রাজনৈতিক গুরুকুলের পরম্পরা। সেদিনও তাঁদের পাশেই ছিল কম্যুনিস্ট পার্টি। লাল গেরুয়া এক ছিল ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আবহে।

Latest article