বাংলা-বাঙালি অস্মিতার ‘চিনের প্রাচীর’

বাঙালির সেরা খেলা ফুটবল। এই খেলাতেই বাঙালির তাবৎ অস্মিতার প্রকাশ। এবং গোষ্ঠ পালেরও। প্রাতিস্বিক ভঙ্গিমায়। গতকালই ছিল তাঁর জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৬ সালের ২০ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আজ তাঁকে, তাঁর কথা স্মরণ করছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

প্রথম দেখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। প্রথম আলাপে তিনি পর্যন্ত বলে উঠেছিলেন, ‘‘তুমিই তা হলে সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল (gostha pal)!’’
গোষ্ঠ পাল নামটার সঙ্গে ‘চিনের প্রাচীর ‘ শব্দবন্ধের সার্বিক অভিযোজন এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
কী ভাবে শুরু হয়েছিল এই নামকরণ পর্ব?
এ বিষয়ে দুটি মতামত জানা যায়।
এক, তাঁর খেলা দেখে ভক্তরাই একটা সময় ডাকতে শুরু করেন ওই নামে। আর অন্য তত্ত্বটা হল, রোভার্স কাপে গোষ্ঠ পালের খেলায় মুগ্ধ এক ইংরেজ সাংবাদিক বলে ফেলেছিলেন, ‘‘হি ইজ় অ্যাজ় সলিড অ্যাজ় দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না।’’ এর পরে ‘দ্য ইংলিশম্যান’ সংবাদপত্রে গোষ্ঠ পালকে তিনি ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ বলে উল্লেখ করেন।
সেই শুরু। ১২৯ বছর পার হয়ে গেলেও সেই নাম একটুও ফিকে হয়ে যায়নি।
অতুল্য ঘোষ এক বার বলেছিলেন, ‘‘গোষ্ঠ পাল (gostha pal) হল, জেল না-খাটা এক স্বাধীনতা সংগ্রামী।’’
সত্যিই তাই।
গোষ্ঠ পাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন মাঠের সবুজ ঘাসে। খালি পায়ে ফুটবল খেলে তিনি ব্রিটিশদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই দেখতে তখন মাঠে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। গুলি না চালিয়েও তিনি ইংরেজদের ‘রক্তক্ষরণ’ ঘটাচ্ছেন, যেটা ব্রিটিশ রাজের কাছে একটা অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এর পরে শুরু হয় ছলে-বলে-কৌশলে মোহনবাগানকে নানা ভাবে আটকে দেওয়ার খেলা।

সাল ১৯৪৮। গোষ্ঠ পালের মা নবীন কিশোরী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় আসছেন তিনি ছেলের কাছে। গোয়ালন্দয় তাঁকে আটকায় পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ। বৃদ্ধার প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই তাঁদের। সুটকেসের তালা ভেঙে ভিতরের জিনিস ঘাঁটতে শুরু করে দেয় তাঁরা। অসহায় বৃদ্ধা হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন। আচমকা এক অফিসারের চোখ পড়ে সুটকেসের একটি ছবির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেন, ছবির ওই লোকটি আপনার কে হয়? বৃদ্ধার উত্তর , ‘‘আমার পোলা। ওর কাছেই তো যাইত্যাছি।’’ শোনামাত্র ওই অফিসার নতুন তালা কিনে সুটকেসে লাগান। নিজে এসে নবীন কিশোরী দেবীকে ট্রেনের জানালার পাশে বসিয়ে দিয়ে যান। পরে ছেলেকে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, তুই করস কী?’’ গোষ্ঠ উত্তর দেন, ‘‘কিসুই না। শুধু বল লাথাই।’’

আরও পড়ুন-হাতছানি দেয় পানবুদারা

অথচ গোষ্ঠ পাল (gostha pal) শুধু ফুটবলেই নয়, ক্রিকেট, হকি, টেনিসেও সমান দাপট দেখিয়েছিলেন। মোহনবাগানের হকি, ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন। এক বার ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছেন। পরেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রথমে বিপক্ষ দল কোনও আপত্তি জানায়নি। কিন্তু গোষ্ঠ পাল এক ওভারে দু’উইকেট নেওয়ার পর শুরু হল ঝামেলা। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়রা বলতে শুরু করল, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গোষ্ঠ পালকে ক্রিকেট খেলতে দেওয়া যাবে না। মোহনবাগানও মাঠ ছেড়ে উঠে যায়। শুধু সেই ম্যাচেই নয়, তার পরে বছর ছয়েক খেলা বন্ধ ছিল দু’দলের মধ্যে। গোষ্ঠ পাল খেলবেন এবং ধুতি পাঞ্জাবি পরেই খেলবেন। পাক্কা বাঙালি পোশাকেই সাহেবদের বিরুদ্ধে সাহেবদের খেলা খেলবেন। অস্মিতার প্রশ্নে কোনও আপস নয়।

সন ১৯৬২। প্রথম ফুটবলার হিসেবে পদ্মশ্রী পুরস্কার পাচ্ছেন গোষ্ঠ পাল। সেখানেও বাঙালিয়ানা পোশাক নিয়ে আপত্তি। পুরস্কার নেওয়ার সময়ে গলাবন্ধ কোট পরাটাই দস্তুর। সেটা জানার পরে গোষ্ঠ পাল রাষ্ট্রপতির আপ্তসহায়ককে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, তাঁর পক্ষে গলাবন্ধ কোট পরে পুরস্কার নিতে আসা সম্ভব নয়। সেই চিঠির জবাবে আপ্তসহায়ক লেখেন, ‘‘আপনি যে পোশাক পরেই আসবেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাতেই খুশি হবেন।’’এই হলেন গোষ্ঠ পাল। চলনে বলনে মননে ১০০ শতাংশ খাঁটি বাঙালি।
এবং ভারতীয়। জাতীয় সত্তা তাঁর চিন্তায় চেতনায়, সর্বাগ্রে।
১৯৩৪ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দলকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল গোষ্ঠ পালের। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে সরিয়ে নিলেন নিজেকে। সবাই জানল, চোট পেয়ে দলের সঙ্গে যাচ্ছেন না।
১৯৩৫ সাল। ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলছে মোহনবাগান। যখনই বিপক্ষ বক্সে বল নিয়ে উঠছেন মোহনবাগানের ফুটবলাররা, রেফারি বাঁশি বাজিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন। একটা সময় আর সহ্য হয়নি গোষ্ঠ পালের। দলের সবাইকে নিয়ে মাঠেই শুয়ে পড়লেন তিনি। জানিয়ে দিলেন, আর খেলবেন না। তৎকালীন আইএফএ-র সাহেব কর্তারা ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেননি। তদন্ত হল গোষ্ঠ পালের বিরুদ্ধে। এর পর সেই বছরেই যবনিকা নেমে আসে এই কিংবদন্তির ফুটবল জীবনে।
তবু কোনও আপস নয়।
১৮৪৭। দেশ স্বাধীন হল। তখন শোভাবাজারে থাকতেন গোষ্ঠ পালের পরিবার। সেদিন ইলিশ আর পায়েস রান্না করেছিলেন তাঁর স্ত্রী। পাড়ার ছেলেদেরও ডেকে খাইয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। তিনি তখন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব। সে বছরই দ্বিতীয়বার আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান। ফাইনালে হারায় ইস্টবেঙ্গলকে।

Latest article