এক মাতৃত্বের অধিকারের গল্প। মায়ের সঙ্গে মায়ের লড়াই। এক পুত্রকে নিয়ে দুই মা দেবকী বনাম যশোদার টানাপোড়েন অথচ দুই মা সেভাবে মুখোমুখি আসেননি কখনও। কৃষ্ণ জীবনের যত প্রতিকূলতা আর ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে গেছেন সমস্ত কৃষ্ণভক্ত, যাঁরা সর্বক্ষণ কিছু না কিছু সমস্যার মধ্যে আছেন তাঁদের মিলিত সমস্যার চেয়েও ঢের বেশি। আর জন্মের পূর্বে মাতৃগর্ভ থেকে যে শিশু লড়াই করছে, তার চরিত্র যে জটিলতায় ভরা থাকবে এ তো বিধাতাও জানেন। তাই ভারতে সবচেয়ে পরিচিত, খ্যাতিমান এবং জটিল চরিত্রটি যে শ্রীকৃষ্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জটিলতা, বৈচিত্র্য, ম্যানেজমেন্ট আর ডিসিশন মেকিংয়ের ক্ষমতা কৃষ্ণকে মানুষ থেকে দেবতা এবং কালক্রমে দেবতা থেকে করেছে দেবোত্তীর্ণ।
শিশু জানে মায়ের কোল। জন্মের পর থেকেই কান্নায় মায়ের কোল, আনন্দে মায়ের কোল আর ক্ষুধায় মায়ের কোল। মহাভারতের গল্পকার জানতেন, শিশুর গোত্র বা পদবি ধারণে মাকে না লাগলেও নবজাতকের প্রাণ ধারণে লাগবে মাতৃদুগ্ধ। তাই জগৎপালককে অন্তত খাবার জোগাতে একটা অতিথি শিল্পীর ভূমিকাতেও আসতে হয়েছিল যোগমায়াকে। সে হিসাবে পরমব্রহ্ম যে দর্শনে অরূপের ঘর থেকে যা-ই রূপ ধারণ করুন, বিশ্ব উৎস বিন্দু হিসেবে মাতৃরূপ এগিয়ে থাকবেন সব সময়।
আরও পড়ুন-যাত্রার জয়যাত্রা
গল্পের শুরুটা বড়ই চেনা। মথুরায় ভোজ বংশের রাজা উগ্রসেনের পত্নী পদ্মাবতী কীভাবে যেন মিলিত হয়েছিলেন রাক্ষস দ্রুমিলের সঙ্গে। তাই কংসের অত্যাচারী হওয়ার কারণটাও অনুমেয়। উগ্রসেনের ভাই দেবকের কন্যা দেবকী। আদরের বোন দেবকীর বিয়ে হচ্ছে মহাধুমধাম করে পাশের যাদব বংশের রাজা শূরসেনের ছেলে বসুদেবের সঙ্গে। এ পর্যন্ত গল্পটা মসৃণ ছিল। বিয়ের পর বর-কনে মথুরার সীমানা ছাড়ানোর সময় হল দৈববাণী— এই দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান করবে কংস বধ। মেরে ফেলো এদের— না থাকবে মাথা, না থাকবে মাথাব্যথা। কিন্তু ওই যে বিধাতার লিখন— কংসের মনেও জাগল সামান্য দয়া । দেবকী আর বসুদেব হলেন কারাগারে বন্দি।
বন্দিত্ব আটকাতে পারেনি মিলন। দেবকীর এক-এক করে ছ’টি সন্তান হল, কারাগারেই। সেখানেই তাদের আছড়ে মারে মামা কংস। সেই ঋণ শোধ করছে আজও মামারা— ভাগনাদের গায়ে হাত তুলতে নেই। সাত নম্বরটি গর্ভস্থ অবস্থাতেই ট্রান্সপ্লান্ট হল বসুদেবের আগের পত্নী রোহিণীর গর্ভে। বিষ্ণু আসবেন তাই আগে পাঠালেন তাঁর আশ্রয় শেষনাগকে। এবার সেই বহু প্রতীক্ষিত অষ্টম গর্ভ। দেবতার আবির্ভাব তাই এবার মানুষ চলবে দেবতার কৃপায়।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমী, রাত বারোটা, ৩২২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই বুধবার। জুলাই আর ভাদ্র নিয়ে মেলানোর কোনও চেষ্টা বৃথা কারণ পাঁচহাজার বছরে ক্যালেন্ডারের প্রচুর সংস্কার ঘটেছে। দৈবের বশে প্রহরী তখন নিদ্রামগ্ন আর বসুদেব হয়েছেন শৃঙ্খলমুক্ত। দৈবনির্দেশে নবজাতককে রেখে আসতে হবে যমুনা পেরিয়ে গোকুলে। সেখানে বসুদেবের কাকার ছেলে নন্দরাজের ঘরে জন্মেছে একটি মেয়ে— দেবী যোগমায়া। সন্তান না জন্মালে হবে না মাতৃসুধা ক্ষরণ আর মায়ের দুধ না খেলে কৃষ্ণ বাঁচবেন কীভাবে? তাই আসতেই হল যোগমায়াকে। পুরুষ রক্ষায় নারীর বলিদান নারীত্বের অবমাননা নয়, দুষ্ট দমনে সমাজরক্ষায় নারীর অগ্রণী ভূমিকা, সে তো শহিদের মর্যাদা। যাইহোক দেবতার রহস্য কে খোঁজে!
শুরু হল দেবতার কষ্টের মানবলীলা। এক ঠাকুরের কথায় ‘সেথায় দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে’। শিশু যখন মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে তখন থেকে মায়ের শরীরের সঙ্গে কোষের আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটা স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মা শিশুর সমস্ত কিছু বুঝতে পারে। সেই মায়ের কোল থেকে শিশুকে যখন অন্য কোথাও সরানো হয় সে তখন যত আদরেই থাকুক, একটা জিনগত নিরাপত্তার অভাব তাকে তাড়া করে বেড়াবেই। আর এই অস্থিরতা, শরীরের ভিতরে চেনা স্পর্শের যাতনা বারবার শিশুকে দুর্বল করে তোলে। ফলে সে বিরাট কিছু করার মাধ্যমে তার দুর্বলতা ঢাকতে চায়। তাই আসে বকাসুর বধ, কালীয় দমন, গিরি গোবর্ধন উত্তোলনের মতো অতি মানবিক আচরণ।
আরও পড়ুন-কাচের ঘরে বসেই ঢিল প্রধানমন্ত্রীর, কড়া ভাষায় তোপ তৃণমূলের
যে মা ছ’টা নবজাতকের মৃত্যু দেখেছে সে অনেক কঠিন হলেও, কন্যা দেখে দাদাকে আবার অনুরোধ করেছে না মারার জন্য। আছড়ানোর সময় কন্যারূপ যোগমায়া শঙ্খচিল রূপে উড়ে গিয়ে দৈববাণী করেছে— তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। হতবাক কংস চলল গোকুলে ওর হন্তা খুঁজতে আর দেবকী-বসুদেব আবার হলেন কারারুদ্ধ।
জন্ম দেওয়ার ধকলে আসা ঘোর কেটে মা যশোদা দেখলেন পুত্রসন্তানকে।
মধ্যের শিশুবদল তাঁর অজানা। মাতৃকোষের আদান-প্রদান না থাকলেও অর্থাৎ জিনগত টান না থাকলেও শিশু পেল মায়ের আদর। যশোদা ও নন্দরাজের ঘরে কৃষ্ণ বড় হতে লাগল পরমাদরে। কৃষ্ণ তার বাল্যলীলায় আরও পাঁচটা বাচ্চার মতোই দুরন্ত, দস্যিপনা করে বেড়ায়। মা যশোদা শাসন করছেন, আদর করছেন। মাঝে মাঝে নানা ঘটনার মধ্যে প্রকাশ পায় এ-বাচ্চা সবার থেকে আলাদা। পুতনার বিষদুধেও সে বাঁচে, দড়িতে কুলায় না দামোদরের বাঁধন। যশোদা উপভোগ করছেন শিশুর শৈশব। শিশু জৈবিক হোক বা পাশের বাড়ির, চেনা হোক বা অচেনা, ছোট্ট বেলায় তার দুষ্টুমি সবাই উপভোগ করে। এক্ষেত্রে মা যশোদা কোনও কাহিনি না জেনেই নিজপুত্রজ্ঞানে কৃষ্ণর শৈশবলীলা উপভোগ করছেন, শিশুকে আদর করছেন, মোটকথা, এক আদর্শ সুখী পরিবারের ছবি ফুটে উঠছে। কখনও মুখে বিশ্বরূপ দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হচ্ছেন। মোটের উপর ছেলে যে একটু হলেও আলাদা এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তাই আনন্দের মাঝে একটু শঙ্কা হিমশৈলের চূড়ার মতো জেগেই থাকছে।
দিনের পর দিন শৃঙ্খলাবদ্ধ আরেক নারী তখন কী করছেন? কারাগারে আবদ্ধ, সমস্ত সুখ বর্জিত, একের পর এক সন্তানের মৃত্যু চোখে দেখা এক অভিশপ্ত মা। বারবার পেটে তৈরি হয়েছে জন্মদাগ, জরায়ুর পেশিও যেন বারবার সংকোচন প্রসারণ করে ক্লান্ত। আসলে দেবকী ভগবানকে গর্ভে ধরার দেনা শোধ করছেন!
রানি কৈকেয়ী অনুতপ্ত। বারবার ক্ষমা চাইলেন রামের কাছে। মন্থরার পরামর্শে যে ভুল করেছেন, সেই কৃতকর্মের ফল হয়েছিল ভয়ানক। আজ সুযোগ এসেছে পুত্রের কাছে ক্ষমা চাওয়ার। মায়ের হাজার অপরাধ হলেও পুত্রের কাছে মা যখন নতজানু তখন পুত্র মুখ ফিরিয়ে থাকেন কী করে। মা পুত্রের কাছে চেয়ে নিলেন প্রতিশ্রুতি, সামনের জন্মে এই পূর্ণব্রহ্মকে গর্ভে ধারণ করার বাসনা। রাম রাজি হলেন, কিন্তু নিঃশর্ত নয়। একজন্মের মহা পাপ কি শুধু অনুতাপে মেটে? তোমার গর্ভে জন্মালেও তোমার দুধে আমার পালন হবে না। প্রভু শুদ্ধ আত্মা ছাড়া ভোগ নেবেন কেন? তাই দেবকীর কোলে কৃষ্ণ এলেন দ্বাপরে, কিন্তু জন্মলগ্নেই হলেন মায়ের কোল-ছাড়া। এক মা একমাত্র বোঝে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর আনন্দ। দেবকী জন্মান্তরের পাপের শাস্তি হিসেবে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত।
আরও পড়ুন-মোদিজি আসুন ক্ষতি নেই, এসে বাংলার উন্নয়ন দেখে যান : চন্দ্রিমা
এক সন্তানকে ঘিরে দুই মায়ের এই টানাপোড়েন অথচ সেই অর্থে কেউ সেই সময়ে একে অপরের মুখোমুখি হননি। কেউ সেভাবে জানলেন না পুরো চিত্রনাট্য। অথচ পুরো রঙ্গমঞ্চ জুড়ে পরিবেশিত হল এক দারুণ সময়— শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা। বড় হওয়ার পর কৃষ্ণ গোকুল ছাড়লেন, রাধা ছাড়লেন, বাঁশি ছাড়লেন। এবার যে যমুনা পেরিয়ে এসেছিলেন বাঁচতে, সেই যমুনা পেরিয়ে আবার চললেন বাঁচাতে। এবার ধরবেন কর্তব্যের পথ, মথুরার পথ, এবার সুদর্শন চক্রের পথ। যশোদার স্নেহবন্ধন কাটিয়ে চললেন দেবকীর বন্ধনমুক্ত করতে।
কংস বধের পর কারাগারে চললেন মাতা-পিতার বন্ধন মুক্ত করতে। জীবনে প্রথমবার কিংবা দ্বিতীয়বার দেখলেন গর্ভধারিণীর মুখ। দেবকীর মনে মুক্তির আনন্দ বড় হয়ে উঠল না-দেখা পুত্রকে কাছে পেয়ে। কিন্তু যে সদ্যোজাতটি নাড়িকাটার পর ছোট্ট হাতে মাকে ছোঁয়, আজ বন্ধনমুক্তির সময় সেই হাত কিন্তু অনেকটাই বড়, অনেকটাই অচেনা। এতে স্নেহের থেকে কর্তব্যের রেখা অনেক বেশি। আজ দেবকী সর্বসুখী কিন্তু সম্পূর্ণ নন। হাসছেন দেবকী ফিরে পাওয়ার সুখে, কাঁদছেন দেবকী অনেক কিছু হারানোর দুঃখে। ঠিক একই ভাবে যমুনার অপর পাড়ে এক মা ভেঙে পড়েছেন আকুল কান্নায়, তিনি দুঃখী তাঁর ছেলে চলে গেছে তাঁকে ছেড়ে, কিন্তু তাঁর শোক নেই কারণ, তাঁর ছেলে গেছে কর্তব্যের টানে। মথুরায় কৃষ্ণ বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য সেরে চলে গেলেন দ্বারকায়। পিছুটান আর মোহ উন্নতির পথে অন্তরায়। এর পর ফিরবেন ধর্মক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্র মা ফলেষু কদাচন নিয়ে।
মহাপুরাণ মতে দুই মা একবার একত্র হয়েছিলেন— দেখা হয়েছিল একবার দেবকীর সাথে যশোদার। দু’জনার মধ্যে ছিল না কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ, ছিল না কোনও অভিমানের সুযোগ। দু’জনেই দু’জনার কাজ করে গেছেন অজান্তে, বিধাতার চিত্রনাট্যের ইঙ্গিতে। বরং এক অনন্ত মানসিক দ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েনে বড় হওয়া কৃষ্ণের চরিত্রের উপর ফেলেছিল জটিল প্রভাব। তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু— সবার উপরে চিনতেন কর্তব্যকর্ম। দুই মায়ের দুই রকম দুঃখ অজান্তেই কৃষ্ণকে করে তুলেছিল কঠিন, কঠোর, কর্তব্যবোধে অবিচল। দেবকীর দুঃখ বোঝার আগেই তিনি লালিত হয়েছেন যশোদার স্নেহে। যশোদার দুঃখ বোঝার আগেই তিনি নেমেছেন লক্ষ্যভেদে। তবুও এক জৈবিক আর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন তাঁকে দিয়েছে প্রাজ্ঞতা, ধীশক্তি আর চাতুরী। লড়ে গেছেন দুই মা। দেবকী হারিয়ে পেয়েছেন, যশোদা পেয়ে হারিয়েছেন।