সুশাসন আর দুর্নীতি দমনের নামে আক্রান্ত গণতন্ত্র, ছায়াপাত জরুরি অবস্থার

১৩০ তম সংশোধনী। টার্গেট পরিষ্কার। 'করাপশন' নয়, 'অপোজিশন’। উদ্দেশ্য, কেস ঠুকে প্রমাণ ছাড়াই বিরোধী পক্ষকে জেলে ভরা আর দোষী সাব্যস্ত না করেই তাদের নেতৃবর্গের পদ হরণ। একেবারে ফ্যাসিবাদের প্রকাশে জনকণ্ঠ রোধের আয়োজন। এই ফ্যাসিবাদী প্রয়াসের বিরুদ্ধে একযোগে লড়তে না পারলে আমরা সূচিত করব ভারতীয় গণতন্ত্রের শবযাত্রা। লিখছেন ডাঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার

Must read

২০ অগাস্ট, ২০২৫— ভারতের সংসদে যে ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ হয়েছে, তা আপাতদৃষ্টিতে ‘সুশাসন’ ও ‘দুর্নীতি দমন’-এর প্রতিশ্রুতি বহন করে। কিন্তু গভীরতর পর্যালোচনায় এই বিলের আসল চেহারা স্পষ্ট হয়— এটি আসলে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ডে আঘাত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের নামে এটি কার্যত এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার পূর্বাভাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’র স্বপ্নে এমন এক ভারতের কথা বলেছিলেন, যেখানে স্বাধীনতা ও মর্যাদা অটুট থাকবে। সেই স্বপ্ন আজ অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে। শাসকের হাতে যখন অসীম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, তখন স্বাধীনতার বাতি নিভে যাওয়ার শঙ্কাই জাগে।

আরও পড়ুন-থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ উত্তেজিত জনতার, যোগীরাজ্যে গণধর্ষিতা দলিত তরুণী, অবসাদে আত্মঘাতী

সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার ব্যাখ্যা
সংবিধানের ধারা ৭৫ ও ১৬৪ অনুযায়ী মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের ‘সুখভোগে’ পদে বহাল থাকেন। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়— Shamsher Singh বনাম State of Punjab (১৯৭৪) কিংবা Nabam Rebia বনাম Deputy Speaker (২০১৬)—স্পষ্ট করে দিয়েছে, এই ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারী নয়, বরং মন্ত্রিসভার পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যকর হতে হবে।
কিন্তু ১৩০তম সংশোধনী রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালকে ‘সরাসরি অপসারণ’-এর ক্ষমতা দিচ্ছে। এটি নির্বাচিত সরকারের উপর এক অসাংবিধানিক তলোয়ার ঝুলিয়ে দেবে। কলকাতা হাইকোর্ট বহুবার উচ্চারণ করেছে যে, অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত নির্দোষ। অথচ এই বিল অনুযায়ী, মাত্র ৩০ দিনের আটকই মন্ত্রীর রাজনৈতিক মৃত্যুর সমান। দোষ প্রমাণিত না হলেও ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া যাবে— এ এক অশুভ নজির।
আন্তর্জাতিক আইন ও ভারতের মর্যাদা
জাতিসংঘ সনদের ১ ও ৫৫ নং ধারা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ (UNHRC) বারবার বলেছে, ন্যায্য বিচার ও সমান রাজনৈতিক সুযোগ গণতন্ত্রের অঙ্গ। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (ICJ) মতবাদও একই— শাসকের ইচ্ছা নয়, আইনের শাসন হবে শেষ কথা।
তাহলে ভারত কি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ভাঙতে চলেছে? দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশে এই ধরনের আইন রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়েছে। পাকিস্তানে প্রতিপক্ষকে আটক করে ক্ষমতার খেলা গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। ১৩০তম সংশোধনী কার্যকর হলে ভারতে ফেডারেলিজম ক্ষতিগ্রস্ত হবে— রাজ্য সরকারের ওপর কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বাড়বে।
এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার ছায়া
১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার দুঃসহ স্মৃতি এখনও দেশবাসীর মনে। তখন মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়েছিল। আজ আবার সেই অন্ধকার ফেরার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। বিরোধী নেতাদের আটক করে ৩০ দিনের মধ্যে পদচ্যুত করা গেলে নির্বাচনের মানে কী? গণতন্ত্র তখন কার্যত শাসক দলের বন্দি।
সুপ্রিম কোর্টের Kesavananda Bharati (১৯৭৩) মামলার রায়ে বলা হয়েছিল—সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা যাবে না। কিন্তু ১৩০তম সংশোধনী কার্যত সেই কাঠামোকেই আঘাত করছে।
রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির সতর্কবার্তা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’-এ বলেছিলেন, দমননীতির উপর সভ্যতা দাঁড়াতে পারে না। আর মহাত্মা গান্ধী শিখিয়েছিলেন, গণতন্ত্র মানে জনগণের কণ্ঠস্বরকে মর্যাদা দেওয়া। গান্ধীজির ভাষায়—‘গণতন্ত্র শাসকের নয়, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা।’
যদি অভিযোগের ভিত্তিতেই জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া যায়, তবে গণতন্ত্র কেবল কাগুজে শব্দে পরিণত হবে।

আরও পড়ুন-পাঁচিল টপকে সংসদ ভবনে

উপসংহার
১৩০তম সংশোধনী বিল ভারতের গণতন্ত্রকে বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি ‘অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’-এর নীতি লঙ্ঘন করছে, মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করছে, নাগরিকদের অধিকার খর্ব করছে।
আজ প্রয়োজন এক সজাগ নাগরিকসমাজ, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভয়শূন্য ভারত আর গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। নইলে গণতন্ত্রের আলো নিভে যাবে, শুরু হবে এক নতুন অন্ধকার যুগ।

Latest article