মূল প্রবাদটা এরকম : চোরের মায়ের বড় গলা। পরিবর্তিত আধুনিক রূপ : চোরের বাপের বড় গলা।
কথাটা মনে হল মোদিজিকে দেখে।
কলকাতায় এসেছিলেন। যেমন ফি বার ভোটের আগে আসেন, তেমনই এসেছিলেন। একই রকম বড় বড় কথা। একই রকম নীল-গোলাপি স্বপ্ন দেখানো সফর। তবে এবারের নয়া সংযোজন। চাট্টি জ্ঞান বিতরণ। এবং নিজে সাধু সাজার চেষ্টা। সেই সঙ্গে পাপ ক্ষালনেরও।
বাঙালি পিটিয়ে বাংলা প্রেম দেখানোর চেষ্টায় কোনও খামতি যাতে না থাকে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল মোদিজির।
‘আমাদের সৌভাগ্য, আমরা বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার তকমা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি।’
বক্তা কে? স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি।
আরও পড়ুন-মিড-ডে মিলে একাধিক পদ ইলিশে ভূরিভোজ পড়ুয়াদের
নাটকটি যাতে মনোগ্রাহী হয়, সেজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল মেট্রো রেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করছিলেন যিনি, তাঁর তরফেও বাঙালিনী হয়ে ওঠার প্রবল চেষ্টা ছিল। সেজন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত স্টেশনের প্রসঙ্গ যতবার উঠেছে, ততবার তিনি ‘হিমন্তা’, ‘হিমন্তা’ বলে কাটিয়েছেন। বাংলায় কথা বলার নাটক করেছেন মোদি স্বয়ং।
বললেন, ‘‘বড়রা প্রণাম নেবেন। ছোটদের ভালবাসা জানাই।’’ এরপর কৌশিকী অমাবস্যার শুভকামনা জানিয়ে, কালীঘাট ও দক্ষিণেশ্বর মন্দির এবং দমদমের হনুমানজি মন্দিরের কথাও বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় উঠে এসেছে, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোষ্ঠ পালের মতো বহু গুণী মানুষ ও মহাত্মা জন্মগ্রহণের প্রসঙ্গ। আবেগের উদ্গীরণ নয়, হিসেবি পদসঞ্চারণ।
গেরুয়া শিবিরের মুখপাত্র অমিত মালব্য দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন—বাংলা কোনও ভাষাই নয়। দেশ জুড়ে বাংলাভাষী মানুষের উপর অত্যাচার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই কোনও না কোনও বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি পীড়নের খবর প্রকাশ্যে আসছে। বাঙালিকে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত। ওদিকে বছর ফুরোলেই ভোট। তাই পরিস্থিতিতে প্রলেপ দিতে মোদি স্পেশাল ন্যাকামি। এদিকে বলছেন, ‘‘বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বিজেপি সরকার বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করতে গর্বের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের সৌভাগ্য, সেই ভাষাকে শাস্ত্রীয় ভাষার তকমা দেওয়ার সুযোগ মেলায়।’’
আর ওদিকে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার তারতিপুরের নাজিমুদ্দিন মণ্ডলকে সোজা বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ চলছে। ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান চলছে।
তারই জন্য এ-রাজ্যে ‘শ্রমশ্রী’। সেটা আর পাঁচটা সরকারি প্রকল্প থেকে আলাদা। এটাই ‘বাঙালি খেদাও’- এর প্রতিস্পর্ধী প্রতিক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গের। বাঙালির উপর ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ। অত্যাচারীর কবল থেকে অত্যাচারিতকে সুরক্ষিত করার প্রকল্প।
এখানে তো রাজধর্ম পালিত হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। বর্ধমানের ফাগুপুরে ঘটে এক ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা। মারা গেলেন ১১জন। জখম হলেন ৩২ জন। মৃত ও জখমরা ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তবুও তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাংলার দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-বসিরহাটে বিধায়কের উদ্যোগে জব ফেয়ার
আরও দেখার বিষয়, ফের একবার বাংলায় ঘুরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলা বলে বাঙালিপ্রেমী সাজার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনার টাকা নিয়ে টুঁ শব্দ করলেন না।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মোদিজি বারবার বাংলায় আসবেন। আসবেন ছাব্বিশের নির্বাচনী প্রচারের শেষদিন পর্যন্ত। তারপর দু’বছর তাঁর টিকিও দেখতে পাবে না বাংলা। অতীতের পারফরম্যান্স তেমনটাই বলছে। মোদিজি চুরি করে সরকারের গদিতে বসে থাকার কথা বললেন। বাংলায় দাঁড়িয়েই বললেন।
শুনলাম। কিন্তু মনে পড়ে গেল, ক্যাগ রিপোর্ট-এর কথা। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া গত ১১ বছরে এমন বিস্ফোরক রিপোর্ট দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছিল, দিল্লি থেকে গুরগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে হঠাৎ কেন ১৪০০ শতাংশ নির্মাণব্যয় বেড়ে গেল? কেন ৩৬০০ কোটি টাকার তহবিল অন্য খাতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে? লক্ষ লক্ষ রোগীর নামে চিকিৎসা বিমার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে যে রিপোর্ট দেখানো হয়েছে, সেই রোগীরা আসলে মৃত। অর্থাৎ এই রোগীদের চিকিৎসাই হয়নি ওই বিমার আওতায়। সাড়ে ৭ লক্ষ এরকম পেশেন্টের নাম পাওয়া গিয়েছে, যাদের মোবাইল নম্বর একই।
হঠাৎ দেখা যায় ঠিক যে অফিসাররা এই অনিয়মগুলি অডিট করেছিল, তাদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ক্যাগ কর্তৃপক্ষ বার্তা পেয়ে গিয়েছিল যে, এই আমলে কী করা উচিত। তাই ক্যাগ বলে আর কোনও জুজু নেই এখন। ক্যাগ এখন নখদন্তহীন।
এটা যাঁরা করলেন তাঁরা এখন নীতির পাঠ দিতে এসেছেন বাংলায়!
নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন ব্যবস্থায় একটি কলেজিয়াম প্রক্রিয়া গ্রহণ করার সুপারিশ করেছিল অর্থ কমিশন ২০১৫ সালে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি শুনছিল। বিষয় ছিল, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করা দরকার। সর্বাগ্রে নির্বাচন কমিশনারদের মনোনয়ন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক পক্ষপাতহীন ব্যবস্থা করা দরকার। ২০২৩ সালের ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশিকা জারি করে জানায়, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের একটি বিশেষ কমিটি নিয়োগ করবে। কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। অর্থাৎ ২০১৫ সালে ঠিক যে সুপারিশ করেছিল অর্থ কমিশন সেটাই আবার এল।
আরও পড়ুন-ইতিহাস যারা বিকৃত করছে তাদের ক্ষমা নয় : চন্দ্রিমা
সুপ্রিম কোর্টের রুলিং-ও গ্রাহ্য করল না। মোদি সরকার যে কমিটি তৈরি করল, সেখানে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁরই মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রইলেন না। সুতরাং, কমিটির কাঠামোই এমন করে দেওয়া হল যে, কোনও সিদ্ধান্তে সর্বদাই প্রধানমন্ত্রীর কথাই শেষ কথা হবে। কারণ তিনজন সদস্য। একজন মাত্র বিরোধী দলনেতা। বাকি দু’জন সরকারের। অতএব ভোটাভুটি হলে সর্বদাই জয়ী হবে সরকারপক্ষ। ঠিক এই নিয়ম মেনেই বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করা হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং এরপর নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এখন অথবা আগামী দিনে আর পক্ষপাতহীন এবং স্বাধীন থাকা সম্ভব নয়।
এসব যাঁরা দেশ জুড়ে করে বেড়াচ্ছেন তাঁদের মুখে নীতির বুলি… আর কইয়েন না কর্তা! ঘুরাতেও হাসবো।