৫০-এ শোলে

রমেশ সিপ্পি পরিচালিত ‘শোলে’। চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন সেলিম-জাভেদ। অভিনয়ে সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, হেমা মালিনী, জয়া বচ্চন, আমজাদ খান প্রমুখ। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট। হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী এই সিনেমা মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হল সম্প্রতি। নানা ঘটনার উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

প্রভাব বিস্তারকারী সিনেমা
রূপকথার মতো একটি ছায়াছবি। কী নেই? রোমান্স, অ্যাকশন, সাসপেন্স, হিংসা, প্রতিশোধ— সব আছে। তুমুল আনন্দঘন মুহূর্তের পাশাপাশি আছে এক আকাশ মনকেমন করা মুহূর্তও। সবমিলিয়ে অনবদ্য একটি সিনেমা ‘শোলে’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। অখ্যাত এক ছোট্ট গ্রাম রামগড় বদলে দিয়েছিল বলিউডের ইতিহাস। ঠাকুরের ডাকে জয় এবং বীরু নামের দুই ডাকাবুকো তরুণের ডাকাত ধরার সেই গল্প ক্রমেই হয়ে ওঠে হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সিনেমার একটি। সেই সিনেমা মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হল সম্প্রতি।
রামগড়ের মুক্তিদূত
‘শোলে’ শুধু একটি বড় বাজেটের তারকাখচিত সিনেমা নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মাইলফলক। পরিচালক রমেশ সিপ্পির নির্মাণ, সেলিম-জাভেদ জুটির ধারালো চিত্রনাট্য ও সংলাপ, আর ডি বর্মনের সুরের জাদু মিলেমিশে তৈরি করেছিল এমন এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, যা দর্শক আজও ভুলতে পারেননি। সাফল্যের নেপথ্যে কী কী কারণ ছিল? মনে করা হয়, ‘শোলে’র আগে বলিউডি নায়ক বলতে বোঝাত নির্মল, আদর্শ, ভুল-ত্রুটিমুক্ত মানুষ। তাঁরা কখনও অন্যায় করতেন না। শোনাতেন নৈতিকতার পাঠ। ‘শোলে’ ভেঙে দেয় চেনা ছক। হাজির করে ধূসর নায়ককে। যাঁরা বাস্তবের মতোই, ভাল-মন্দের মিশেলে তৈরি। জয় চরিত্রের অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং বীরু চরিত্রের অভিনেতা ধর্মেন্দ্র ছিলেন আগের বলিউড নায়কদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। তাঁরা জেলখাটা আসামি, পেশাদার চোর, মিথ্যাবাদী। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁরা হয়ে ওঠেন সাহসী যোদ্ধা, রামগড়ের মুক্তিদূত।

আরও পড়ুন-উৎপাদন দ্বিগুণ করছে বাংলার ডেয়ারি

জয়-বীরুর বন্ধুত্ব
‘শোলে’র আগে হিন্দি সিনেমায় বন্ধুত্ব ছিল প্রায় প্রেমের মতো। রোমান্টিক। কিন্তু বাস্তবে বন্ধুত্ব এমনটা নয়। বাস্তব বন্ধুত্বে ঠাট্টা-তামাশা থাকে, খুনসুটি থাকে, ঝগড়া হয়, আবার মুহূর্তের মধ্যে মনও মিলে যায়। জয়-বীরুর বন্ধুত্ব ছিল একেবারেই সেই বাস্তব ধাঁচের— তাঁরা পরস্পরকে খোঁচাতেন, মাঝে মাঝে ঝগড়াও করতেন। কিন্তু প্রয়োজনে একে অন্যের জন্য জীবন দিতেও পিছপা হতেন না। এটা ছিল বন্ধুত্বের পর্দায় উপস্থাপনার এক নতুন মানদণ্ড, যা পরবর্তী দশকে বলিউড বহুবার অনুসরণ করেছে।
স্বাধীনচেতা কর্মজীবী নারী
তখনকার দিনে হিন্দি সিনেমার বেশির ভাগ নায়িকা ছিলেন লাজুক, ঘরোয়া, পুরুষনির্ভর। এই ধ্যানধারণার বদল ঘটিয়েছিল ‘শোলে’। বাসন্তী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। বাসন্তী রামগড় গ্রামের স্বাধীনচেতা কর্মজীবী নারী। চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন হেমা মালিনী। বাসন্তী ছিলেন টাঙাওয়ালি— নিজের সংসার চালাতেন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতেন। তিনি শুধু নারী স্বাধীনতার প্রতীকই নন, বরং বলিউডে কর্মজীবী নারীর চরিত্রায়ণের পথপ্রদর্শকও ছিলেন। তাঁর হাসি, দুষ্টুমি, বুদ্ধি— সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রামগড়ের প্রাণকেন্দ্র।
সময়ের সাহসী উচ্চারণ
একজন তরুণী বিধবাও যে অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে, নতুন সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে পারে— দেখিয়েছে ‘শোলে’। অ্যাকশন, ড্রামা, প্রতিশোধে ভরা মশালা ছবি। তবু এখানে নিঃশব্দে বোনা হয়েছে এক অন্যরকম প্রেমকাহিনি— বিধবা রাধার জীবনে প্রেমের সম্ভাবনা। চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন জয়া বচ্চন। একটি দৃশ্যে সঞ্জীব কুমার অভিনীত ঠাকুর চরিত্র রাধার বাবাকে বলেন, মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিতে। বাবা বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, ‘সমাজ কী বলবে?’ ঠাকুরের উত্তর, ‘সমাজ মানুষের একাকীত্ব দূর করার জন্য, তাকে একা ফেলে রাখার জন্য নয়। আমরা কি অন্যের ভয়ে রাধাকে জীবিত থাকতে মৃত করে রাখব?’ এই সংলাপ শুধু চলচ্চিত্রের নয়, সময়েরও সাহসী উচ্চারণ ছিল। প্রসঙ্গত, শ্যুটিং চলার সময় জয়া ছিলেন গর্ভবতী।

আরও পড়ুন-বসিরহাটে বিধায়কের উদ্যোগে জব ফেয়ার

আড্ডায় উঠে আসে সংলাপ
‘শোলে’র সংলাপ এখনও আড্ডায় উঠে আসে। ‘কিতনে আদমি থে?’, ‘বাসন্তী, ইন কুত্তোঁকে সামনে মাত নাচনা’, ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর’, ‘গব্বর কা দিমাগ খারাব হো গয়া হ্যায়’— ইত্যাদি সংলাপগুলো পুরনো হওয়ার নয়। সিনেমার চরিত্রগুলো গব্বর, জয়, বীরু, ঠাকুর বা বাসন্তী যেন বাস্তবে নেমে এসেছেন, হয়ে উঠেছেন খুব কাছের কেউ। আসলে, ‘শোলে’ শুধু ছবি নয়, একটি প্রজন্মের স্মৃতি। এর বিদ্রোহী চেতনা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক চরিত্র আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
বাজেট বেড়ে তিন গুণ
‘শোলে’ ছবির মুক্তি নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। এক কোটি বাজেট নিয়ে এই ছবির কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ছবিটি তৈরি করতে দুই বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। ফলে বাজেট বেড়ে যায় প্রায় তিন গুণ। তার ওপর জরুরি অবস্থা, ছবিটি আদৌ বক্স অফিসে সাড়া ফেলবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন পরিচালক-প্রযোজকরা। মুক্তির সময় কোনও ঝামেলা হবে কি না, তা নিয়েও ভয়ে-ভয়ে ছিলেন তাঁরা। এই সবকিছুর মধ্যেই মুক্তি পায় ‘শোলে’। ছবির প্রতিটি সংলাপ জনপ্রিয়তার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আলাদাভাবে সংলাপের জন্য অডিও ক্যাসেট ও রেকর্ড প্রকাশ করতে বাধ্য হন প্রযোজক-পরিচালকরা। ক্যাসেট মুক্তির পর প্রায় পাঁচ লাখ অডিও ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল। ’৭০-এর দশকের সর্বাধিক বিক্রি হওয়া অডিও ক্যাসেট ছিল এটা।

তারকাদের পারিশ্রমিক
‘শোলে’র প্রতিটি চরিত্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় আমজাদ খান অভিনীত খলনায়ক ‘গব্বর সিং’। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি পান ৭৫ হাজার টাকা! ছবিতে সর্বাধিক পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ‘বীরু’ চরিত্রের অভিনেতা ধর্মেন্দ্র, প্রায় দেড় লাখ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। অমিতাভ বচ্চন পেয়েছিলেন এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক। ‘ঠাকুর বলদেব সিংহ’-র চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা অর্জন করেন অভিনেতা সঞ্জীব কুমার। অমিতাভের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। এই ছবিতে অভিনয় করে এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সঞ্জীব। ছবিতে অমিতাভের তুলনায় পঁচিশ হাজার কম পেয়ে হেমা মালিনী আয় করেন পঁচাত্তর হাজার টাকা। এই ছবিতে খুব কম সংলাপ ছিল জয়া বচ্চনের। তিনি পেয়েছিলেন সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক— পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা!
শতাব্দীর সেরা সিনেমা
২০৪ মিনিটের ছবিতে ভাল-খারাপের চিরাচরিত লড়াই দেখানো হয়েছে। সিনেমাটি বিবিসি ইন্ডিয়ার জরিপে ‘শতাব্দীর সেরা সিনেমা’ নির্বাচিত হয় এবং ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এটাকে ভারতের সেরা সিনেমা হিসেবে ঘোষণা করে। ‘শোলে’ শুধু যেন একটি সিনেমা নয়, বরং হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির প্রতীক। এর সংলাপ বিয়েতে বলা হয়, রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়, এমনকী বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা যায়।

আরও পড়ুন-বিসিসিআই নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে

পরিস্থিতি বদলে যায়
প্রথম মুক্তির সময় ‘শোলে’ তেমন প্রশংসা পায়নি। অনেক সমালোচক সিনেমাটি ব্যর্থ বলেছিলেন। ইন্ডিয়া টুডে সিনেমাটিকে বলেছিল ‘নিভে যাওয়া কয়লা।’ ফিল্মফেয়ারের এক লেখক বলেছিলেন, ‘এটি না ঠিক ভারতীয়, না ঠিক পশ্চিমি।’ প্রথম সপ্তাহে হলে দর্শক ছিলেন নীরব। অনেকেই চুপচাপ বসে থাকতেন। না-হাসি, না-কান্না, না-হাততালি। তৃতীয় সপ্তাহে থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়।
প্রিমিয়ারে সলমন
‘শোলে’র চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সেলিম-জাভেদ। অর্থাৎ সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার। তাঁরা একসঙ্গে ২৪টি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, যার মধ্যে ২২টিই ব্লকবাস্টার হিট। এমন ঘটনা বলিউডে আর ঘটেনি। হিন্দি সিনেমাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন এই দুজন। আজকাল লেখকদের পারিশ্রমিক নিয়ে কত কথা হয়। অথচ চার-পাঁচ দশক আগে তাঁরা নায়কের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক নিতেন। এই কথা এখন অবিশ্বাস্যই মনে হয়। হিন্দি সিনেমায় বহুল চর্চিত ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ ধারণা তৈরি হয় সেলিম-জাভেদের হাত ধরেই। ‘শোলে’ ছিল এই জুটির অন্যতম সিনেমা। তাঁরা প্রথমে গিয়েছিলেন মনমোহন দেশাইয়ের কাছে। সেখানে সবুজ সংকেত না পাওয়ায় যান প্রযোজক জিপি সিপ্পির কাছে। তিনি গল্প শুনে প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে যান। পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় রমেশকে। প্রসঙ্গত সেলিম খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আজকের সুপারস্টার সলমন খান। তিনি হাজির ছিলেন প্রিমিয়ারে।
এককথাতেই রাজি
ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল ধর্মেন্দ্রর। কিন্তু তাঁকে বীরুর চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেন পরিচালক রমেশ সিপ্পি। আর সেই সময় হেমা মালিনীর প্রেমে পাগল ছিলেন ধর্মেন্দ্র। রমেশের এককথাতেই রাজি হয়ে যান। আসলে ‘শোলে’র শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে হেমা মালিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সঞ্জীব কুমার। কিন্তু তাতে সায় ছিল না হেমার। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন ছবিতে সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে তিনি কোনও দৃশ্য শ্যুট করবেন না! সঞ্জীব কুমারের চরিত্রের নাম ঠাকুর বলদেব সিং রাখা হয়েছিল চিত্রনাট্যকার সেলিম খানের শ্বশুরমশাই বলদেব সিং চরকের নামের প্রেরণায়।

Latest article