পরিবর্তনের স্রোতে
বাঙালি গণেশ বলতে চেনে দুর্গার কোলের ছোট ছেলেকে। আদরের গনু। আর গণেশের সাবালক অবস্থা একটু ছুঁয়ে যায় পয়লা বৈশাখের দিনটাতে তাও দিদি লক্ষ্মীর সাথে। কলম পেশা জাতের যত ভাব বিদ্যেবতীর সাথে। কিন্তু গণেশও কম যান না। মহাভারত লেখা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এখন চারিদিকে সমাজের একটা ব্যাপক পরিবর্তন আর এর প্রভাব পড়ছে সবকিছুর উপর। এই পরিবর্তনের জোয়ারে মা দুগ্গার কোলের ছেলে বাঙালির আদরের গণেশ কখন যে গুরুগম্ভীর গণপতি মহারাজ হয়ে মায়ের কোল ছেড়ে একাই প্যান্ডেল মাতাচ্ছেন, কেউ খেয়ালও করেনি। হালখাতা পয়লা বৈশাখ ছেড়ে বেওসা বাড়লে গণেশ মায়ের কোল থেকে নেমে গণপতি বাপ্পা হয়ে পাড়া দাপাবেন এ তো বলাই বাহুল্য।
গণের নায়ক হওয়া গণেশ
শিব ও পার্বতীর অনুচরদের গণ বলা হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, গণ হল শিবের অনুচর এবং তাঁদের নেতা হলেন নন্দী। পার্বতীর অনুচরদের মধ্যে জয়া-বিজয়া এবং যোগিনী উল্লেখযোগ্য। গণ হল একদল অতিপ্রাকৃত সত্তা যারা দেবতা শিবের অনুচর হিসেবে কাজ করে। তারা শিবের সেবক, রক্ষক এবং দূত হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গণের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত দেবতা গণেশ।
গণেশকে বেদে সরাসরি গণপতি বা ব্রহ্মণস্পতি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে গণপতি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তাঁকে স্তব করা হয়েছে এবং শুভ কাজের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়াও, তৈত্তিরীয় আরণ্যকের একটি শ্লোকে দন্তী শব্দটি গণেশের একটি প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা শিব পরিবারের অংশ হিসেবে বিবেচিত। এভাবেই গণের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলেন গণেশ।
অনধিকার প্রবেশ নিষেধ
শিবভূমিতে শিব-পার্বতী একসাথে একান্তে রয়েছেন। দ্বার আগলে রেখেছেন গণেশ। এদিকে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার, সে ঢুকবেই। ভারি রাগী মানুষ। গণেশ তো ভীষণ কর্তব্যনিষ্ঠ। লাগল বিবাদ বচসা। এইবার রোজের কথা, হাত থাকতে মুখে কেন। চলল লড়াই। বেচারা গণেশের একটি দাঁত গেল ভেঙে। একদন্ত হয়েও আটকেছিল পরশুরামের প্রবেশ!
যেকোনও শিব বা শক্তি মন্দিরে দ্বারপাল হিসেবে প্রথমেই থাকেন গণেশ।
মা নন্দা চলেছেন শিব-সাক্ষাতে, পথে নিজের রূপটি দেখতে ইচ্ছে হওয়ায় তৈরি করলেন এক কাকচক্ষু সরোবরের নাম তার ‘রূপকুণ্ড’। সে তীর্থের পথে রইল দ্বারপাল-রূপী গণেশ, কৈলুবিনায়ক। শিব-পার্বতী গল্প করছেন অমর গুহায়, ব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে চলছে আলোচনা। পাহারায় আছেন গণেশ। জায়গার নাম গণেশ টপ— মহাগুনাস পাস। তবে দেখার চোখ থাকতে হয়, মহাগুনাস পাসে পাথরে গণেশের অবয়ব স্পষ্ট। ট্রেকতীর্থ শিবলিঙ্গ বেসক্যাম্প থেকে শিবলিঙ্গের চূড়ায় গণেশের রূপ সবাই দেখেছে।
উচ্ছিষ্ট গণেশ
গণপতি বা গণেশের ৩২টি রূপের একটি হল উচ্ছিষ্ট গণেশ। উচ্ছিষ্ট কথাটির আক্ষরিক অর্থ এঁটো বা ভুক্তাবশিষ্ট। প্রতীকী অর্থে দেহে অবস্থিত পরব্রহ্মকে নিবেদনের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাই উচ্ছিষ্ট। ইনি তান্ত্রিক মতে পূজিত বামাচারী গণেশ। মহার্ণব তন্ত্রে ইনি লোহিতবর্ণ আবার কখনও কৃষ্ণবর্ণ। শক্তি নগ্নিকা এবং পরমা সুন্দরী, বাম কোলে উপবিষ্ট। প্রেম ও মিলনের সাথে সম্পর্ক যুক্ত এই গণেশ সৃষ্টির প্রতীক। এই গণপতি ও শক্তির মিলিত রূপে নেই কোনও ভেদ, নেই কোনও বিচার। শুধুমাত্র ভক্তি দিয়ে ভক্ত একাত্ম হন পরম শক্তির সাথে। গণপতি এই রূপে ভক্তকে সর্বসিদ্ধি প্রদান করেন। সকল রিপু হতে রক্ষা করে ভক্তের বিঘ্ন নাশ করেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাঞ্চি গণেশ উচ্ছিষ্ট গণেশ-রূপ।
আরও পড়ুন-বসিরহাটে বিধায়কের উদ্যোগে জব ফেয়ার
মুণ্ডকাটিয়া গণেশ
পার্বতী দেখেন শিবের অনুচর গণ সর্বদা শিবকে আগলে রাখেন তাই তিনিও সৃষ্টি করলেন গণেশকে। করলেন গণের অধিপতি, দ্বারপাল। মায়ের অনুগত গণেশ বিনা অনুমতিতে মায়ের কাছে প্রবেশ করতে বাধা দেবে। স্বয়ং শিব চাইলেন পার্বতীসঙ্গ, এলেন পার্বতীর কাছে। বাধা পেলেন লম্বোদরের কাছে। মহামিলনের বাধা হবে দ্বারপাল! ক্রুদ্ধ শিব মুণ্ড কেটে দিলেন গণেশের। পরে অবশ্য পার্বতীর কান্নায় গণেশের প্রাণ রক্ষা হয়, কাঁধে চাপে গজমুণ্ড। কেদারনাথের কাছে শোনপ্রয়াগের কাছে রয়েছে মুণ্ডকাটিয়া গণেশ। এই স্থানে মুণ্ড ছাড়াই গণেশের পুজো হয়।
বিদেশে গণেশ
টোকিওতে ৮ম শতাব্দীর মাতসুচিয়ামা শোডেন মন্দির রয়েছে, যা জাপানি দেবতা কাঙ্গিতেনের নামে উৎসর্গীকৃত, যা গণেশকে তাঁর জাপানি অবতার নামেও ডাকা হয়। তিনি শোতেন এবং আরও মজার বিষয় হল গণবাচী এবং বিনায়াকতেন নামেও পরিচিত।
থাইল্যান্ডে গণেশ ফ্রা ফিকানেট নামে পরিচিত এবং তিনি সেখানে বিঘ্নহর্তা।
মামাবাড়িতে বাঙালি গণেশ
নিজের সন্তান নেই বলে পার্বতী নিজেই কাপড়ে ধুলোছাপ লাগাতেন। স্নানের সময় গায়ে তেল-হলুদ মাখছিলেন জয়া-বিজয়া। দেবী অঙ্গ থেকে বেরোনো ময়লা দিয়ে দেবী খেলাচ্ছলে পুতুল গড়লেন। পুত্র রূপে দুর্গার স্তনপান করতে ইচ্ছুক নারায়ণ প্রবেশ করলেন পুতুলের মধ্যে। দুর্গা ছেলে পেয়ে আত্মহারা। অন্নপ্রাশন উপলক্ষে সব দেবতার আগমন হয়েছে, শনি ছাড়া। মামা জানেন দৃষ্টিপাতে জাতকের ক্ষতি, তাই আসেননি। দুর্গার আদেশে যদি-বা এলেন, ভাগনার দিকে চাইতেই মুণ্ডপাত! কেঁদেকেটে পার্বতী একশা। নন্দী শিবের আদেশে ছুটল, কে শুয়ে আছে উত্তর দিকে মাথা করে, তার মুণ্ড কেটে আনতে! নন্দী গণেশের দেহে স্থাপন করল গজমুণ্ড। শিবের বরে প্রাণ ফিরে পেল এবং দুর্গাকে শান্ত করতে সব দেব অগ্রে সিদ্ধিদাতা পুজো প্রচলন হল। ছেলেকে কোলে উমা মেনকার কাছে এলেন, বললেন দুর্গাষষ্ঠীর দিন যে মহিলা ব্রত পালন করবে তার সন্তান জীবিত থাকবে। সেই থেকে মর্ত্যে দুর্গা ষষ্ঠীর ব্রত প্রচার হল।
বিধর্মী গণেশ
বৌদ্ধ ধর্মে প্রথম দিকে মূর্তিপুজো ছিল না। তন্ত্র প্রভাবে বৌদ্ধদের মধ্যে মূর্তিপুজোর চল দেখা যায়। গণেশ রয়েছেন বৌদ্ধমতে, সেখানে তিনি বিনায়ক। এখানে তিনি বাধা অপসারক, বিঘ্ননাশক এবং রক্ষক হিসেবে পুজো পেয়ে থাকেন। কখনও তিনি সম্পদ প্রদান করেন কখনও-বা কোনও মন্ত্রে তাঁকে শত্রুদের ক্ষতি করার জন্য আহ্বান করে হয়। নানা চিত্রে তাঁর গাত্রবর্ণ লাল এবং তিনি নৃত্যরত।
গণেশ তিব্বতে ইন্দো-তিব্বতি বৌদ্ধ দেবতাদের দেবতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁকে বাধা, রাক্ষস এবং সম্পদের দেবতা হিসেবে দেখা হয় এবং কখনও কখনও তাঁকে নৃত্যরত তান্ত্রিক রূপেও দেখানো হয়।
তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে গণেশের সাথে সম্পর্কিত ত্রিশটি গ্রন্থ রয়েছে। এই গ্রন্থগুলিতে, যা তিব্বতী অনুবাদে সংরক্ষিত ভারতীয় গ্রন্থ, গণপতিকে একজন সম্পদের দেবতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যিনি যৌনতা এবং খাদ্যের মতো পার্থিব আনন্দও প্রদান করতে পারেন। তাঁকে নেতিবাচক শক্তি, রাক্ষস এবং অসুস্থতা থেকে রক্ষাকারী হিসেবেও চিত্রিত
করা হয়েছে।
এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ উৎসগুলিতে, গণেশকে সাধারণত বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের উদ্ভব হিসাবে উপস্থাপন করা হয়।
জাপানে, একটি জনপ্রিয় চিত্র হল দুটি গণেশ আলিঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে যা দ্বৈত কাঙ্গিতেন বা আলিঙ্গনকারী কাঙ্গিতেন নামে পরিচিত। উচ্ছিষ্ট গণেশের সাথে সাদৃশ্য বেশ চোখে পড়ার মতো।
আরও পড়ুন-মিড-ডে মিলে একাধিক পদ ইলিশে ভূরিভোজ পড়ুয়াদের
গজবেশে জগন্নাথ
পুরীতে শ্রীজগন্নাথের নানা রহস্য নানা লীলা কথা। জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমায় হয় স্নানযাত্রা, রত্নবেদি থেকে নেমে প্রভু একেবারে জনগণের সামনে। একশো আট ঘড়া জলে স্নান করেন তিন বিগ্রহ। বিকেলে গণপতি রূপ গজবেশ পরেন তাঁরা। এখন তিনি জনগণের মাঝে, গণদেবতা তাই গণপতি বেশ।কেউ জানেন জগন্নাথ আসলে বৌদ্ধ দেবতা আর বৌদ্ধ ধর্মে বিনায়ক আছেন জাঁকিয়ে, তাই একদিন সে রূপে। আবার মারাঠা আধিপত্যের সময়, তারা গণপতি-ভক্ত হওয়ায় এই পোশাকের ব্যবস্থা। এভাবে যেকোনও উপায়ে আক্রমণ ঠেকানোর ব্যবস্থা। আসল কথা জগতের নাথ তাই সর্বদা সমন্বয়ের একটা দায়িত্ব নিতেই হয় জগন্নাথকে। এক গাণপত্য ব্রাহ্মণ পুরীতে এসেছে স্নানযাত্রার দিন। জগন্নাথের মধ্যে সে খুঁজে পায় না তার ইষ্টদেবতাকে। আনন্দময় দেবতা ভক্তের দুঃখ দেখতে পারেন না। তাকে খুশি করতে প্রভু গণপতি বেশ ধারণ করেন।
গণনায়ক লেখেন গণবার্তা
মানা গ্রামে গণেশ গুহা, ব্যাস গুহা আর সরস্বতী নদী এখনও পর্যটকদের আকর্ষণ। ব্যাস মহাভারত লেখার জন্য ব্রহ্মার নির্দেশে গণেশকে অনুরোধ করলেন। ব্যাস বলবেন ভারত কথা লিপিবদ্ধ করবেন গণনায়ক। গণেশ লিখতে রাজি তবে ব্যাসকে বলতে হবে একটানা। ব্যাস রাজি তবে চাপালেন শর্ত, না বুঝে লেখা যাবে না। যে সময়ে গণেশ বোঝার জন্য থামছিলেন, ব্যাস ভেবে নিচ্ছিলেন পরবর্তী শ্লোক। আর এই বোঝার মাঝে ঘটল বিপর্যয়। সরস্বতী বইছিল প্রবল গর্জনে, মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল গণেশের। সরস্বতীকে শান্ত হতে বলেন গণেশ, সরস্বতীর খেয়াল থাকে না। গণেশ সরস্বতীকে অভিশাপ দেন, তাই সরস্বতী অন্তসলিলা। এখনও ভীমপুলের কাছে সরস্বতীর রুদ্ররূপ আর তীব্র গর্জন বর্তমান।
শুঁড় দিয়ে যায় চেনা
গণেশের শুঁড় বেশির ভাগ তাঁর বাম হাতের দিকে। এই রকম গণেশ মা-ঘেঁষা, ভাল ছেলে। কখনও গণেশের শুঁড় ডানদিকে বাঁকা, এ-গণেশ বউ-ঘেঁষা, কিছুটা দুষ্টও বটে। উচ্ছিষ্ট গণেশ প্রকৃতির। ডাইনে লম্বাপানা লালপাড় ঘোমটা দেওয়া কলাগাছকে কলাবউ আর গণেশের বউ বলা হত। আসলে যদিও সেটি নবপত্রিকা, দুর্গার এক বৃক্ষরূপ। গণেশের ডান দিকে ঘোরানো শুঁড় খুবই কম দেখা যায়। ডান দিকে শুঁড় ঘোরানো গণপতিকেই সিদ্ধিবিনায়ক বলা হয়ে থাকে। গণেশের এক স্ত্রী হলেন সিদ্ধি। তিনি গণেশের ডান দিকে অবস্থান করেন। তাই ডান দিকে শুঁড় ঘোরানো গণেশ মূর্তিকে সিদ্ধিবিনায়ক বলা হয়।
সব পুজো শুরুর আগে উচ্চারণ হোক— ওঁ গণেশায় নমঃ। গণেশ তো জনগণমন অধিনায়ক