আমাদের হিন্দু ধর্মে গণেশ বা গজাননকে সব দেবতার আগে পুজো করার বিধি প্রচলিত আছে। শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি হলেন অগ্রপূজ্য।
সেই বিঘ্নহর্তা, সিদ্ধিদাতা, সর্বশোকহন্তা, সংকটমোচন গণপতির যেমন বৈচিত্র্যময় নাম রয়েছে তেমনি রয়েছে তাঁর বৈচিত্র্যময় রূপ। সেই গৌরীসুত, বিনায়ক, মঙ্গলমূর্তির নানা রূপ নিয়েই এই লেখা।
দ্বিমুখী গণেশ
দ্বিমুখী গণেশ বত্রিশটি ঐশ্বরিক অবতারের মধ্যে সাতাশতম প্রকাশ। দ্বিমুখী গণেশের এই অনন্য রূপে ভগবান গণেশের দুটি মুখ প্রদর্শন করেন যা মহাবিশ্বের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয়দিকেই উপলব্ধি করায় এবং গভীর ক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
দ্বিমুখী গণেশ এমন দেবতা হিসেবে পালিত যিনি সমস্ত দিক থেকে তাঁর ভক্তদের উপর নজর রাখেন এবং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করেন।
চেহারা এবং বৈশিষ্ট্য
দুই মুখ : এই রূপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল দুটি মুখবিশিষ্ট ভগবান গণেশের প্রতিনিধিত্ব। এই দুটি মুখ তাঁর অভ্যন্তরীণ এবং বহির্মুখ উভয় দিক থেকেই দেখার ক্ষমতার প্রতীক। এটি তাঁর সর্বব্যাপী দৃষ্টি এবং সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি সচেতনাতাকে নির্দেশ করে।
সবুজ নীলবর্ণ : দ্বিমুখ গণপতির একটি অনন্য সবুজ এবং নীলবর্ণ নিয়ে আবির্ভূত হন। যা তাঁকে গণেশের অন্যান্য রূপ থেকে আলাদা করে। একেবারেই ব্যতিক্রমী তাঁর এই রূপ।
চার বাহু : তাঁকে চারটি ঐশ্বরিক বাহু দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে। প্রতিটি বাহুতে অপরিহার্য প্রতীক রয়েছে।
আরও পড়ুন-বসিরহাটে বিধায়কের উদ্যোগে জব ফেয়ার
পাশা : বিঘ্নেশ্বরের এক হাতে পাশা ধরা আছে যা নেতিবাচক প্রভাব বা বাধাগুলিকে দূর করার এবং নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
অঙ্কুশ : তিনি একটি অঙ্কুশ ধারণ করেন যা তাঁর ভক্তদের আধ্যাত্মিক যাত্রার পথ দেখানো এবং উৎসাহিত করার ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে।
ভাঙা দাঁত : দ্বিমুখী গণপতির তৃতীয় হাতে নিজের ভাঙা দাঁত রয়েছে যা ত্যাগ, আত্ম উপলব্ধি এবং বাধা অপসারণের প্রতীক।
রত্নপাত্র : গণাধ্যক্ষ মূল্যবান একটি রত্নপাত্র ধারণ করেন যা সম্পদ, প্রাচুর্য এবং আধ্যাত্মিকতা প্রদান করে।
রত্ন সজ্জিত মুকুট : দুর্দান্ত একটি রত্নখচিত মুকুট গৌরীসুতর মাথায় শোভা পায় যা তাঁর সর্বোচ্চ দেবত্বের প্রতীক।
দ্বিমুখী গণেশের উপাসনা এবং তাৎপর্য
দ্বিমুখী গণেশ দুই মুখবিশিষ্ট। দু’দিক থেকে তাঁর ভক্তদের উপর নজর রাখার জন্য একজন অভিভাবক হিসেবে তাঁর সর্বদৃষ্টি এবং প্রতিরক্ষামূলক উপস্থিতি ভক্তদের অশুভ শক্তি এবং জাগতিক বাধার বিরুদ্ধে সুরক্ষার অনুভূতি প্রদান করেন।
গণেশের অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দিকগুলি উপলব্ধি করার মাধ্যমে উদ্ভূত গভীর জ্ঞানের প্রতীক। সুরক্ষা এবং নির্দেশ দানের মাধ্যমে দ্বিমুখ বিনায়ক ভক্তদের জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং আধ্যাত্মিক দিকগুলোকে স্পষ্ট এবং বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা প্রদান করে।
ত্রিমুখী গণেশ
ত্রিমুখী গণেশ দেবতা গণেশের একটি নির্দিষ্ট রূপ। এই রূপটির তিনটি মুখ রয়েছে। প্রতিটি মুখ বিভিন্ন দিক বা গুণাবলির প্রতীক।
তিনটি মুখ তিনটি গুণের সাথে যুক্ত করে। স্বত্ত্ব রজঃ এবং তমঃ। সত্ত্ব অর্থাৎ ভাল ভাব এবং রজঃ ভারসাম্য অর্থাৎ আবেগ এবং কর্ম আর তমঃ জড়তা এবং অজ্ঞতা।
আর একটি ব্যাখ্যায়, গণেশের তিনটি মুখকে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। যার সময়ে চক্রাকার প্রকৃতি এবং ভক্তদের জীবনের যাত্রাপথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে গণেশের ভূমিকা নির্দেশ করে।
তিনটি মুখের বৈশিষ্ট্য—
সত্ত্ব : বিশুদ্ধতা স্পষ্টতা এবং মনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে।
রজঃ : কার্যকলাপ গতিশীলতা এবং লক্ষ্য অর্জনের প্রতিনিধিত্ব করে।
তমঃ : জড়তা নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রেরণার অভাবের প্রতিনিধিত্ব করে।
কেউ কেউ আবার এও বলে থাকেন যে, তিনটি মুখ ব্রহ্মা সৃষ্টি, বিষ্ণুর সংরক্ষণ এবং শিব ধ্বংস অর্থাৎ মহাজাগতিক ত্রিমূর্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে।
ত্রিমুখী গণেশের রূপ
ত্রিমুখী গণেশের তিনটি মাথা রয়েছে। ত্রিমস্তক তাঁর। এটি গণেশের একটি বিরলতম রূপ। যা সাধারণত ত্রিগুণ বা তিনটি গুণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি গুণ। যা মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই রূপে গণেশকে সাধারণত তিনটি মুখ এবং ছ’টি বাহু দিয়ে চিত্রিত করা হয়।
এই রূপে গণপতি লালচে বর্ণের। তাঁর ডান দুটি হাতে রুদ্রাক্ষের জপমালা এবং হাতির অঙ্কুশ ধারণ করেছেন তিনি। এবং তাঁর বাম হাতে অমৃতভরা একটি দড়ি এবং কলসী রয়েছে। এছাড়াও তাঁর অন্য এক হাতে বরদানকারী মুদ্রা আর অন্য হাতে অভয় মুদ্রা যা ভক্তদের সুরক্ষা প্রদান করে।
এই রূপে তিনি সোনার পদ্মের ওপর বিরাজমান থাকেন।
ত্রিমুখী গণেশের তাৎপর্য
তিন মুখ বিশিষ্ট গণেশের বত্রিশটি ভিন্ন রূপের মধ্যে আঠাশতম রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ত্রিমুখ যার অর্থ তিনমুখী ভগবান। অভিত্তম নক্ষত্র যা ধনিষ্ঠ নক্ষত্র নামে পরিচিত যা কি না ত্রিমুখ গণেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানা যায়।
ত্রিমুখী গণপতির তিনটি মুখ তিনটি দিক বা তিনটি ক্ষমতা নির্দেশ করে। এর মধ্যে একটি হল জ্ঞান অন্যটি হল কর্ম এবং তৃতীয়টি হল ভক্তি। এই তিনটে দিক একজন ব্যক্তির জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
ভক্তরা এমন বিশ্বাস করেন যে, ত্রিমুখী গণপতির পুজো করলে জীবনের তিনটি প্রধান দিকের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং জীবনের পথে আসা বাধা দূর হয়। এটি আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি জাগতিক সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে।
ত্রিমুখী গণেশ হলেন গণেশের একটি শক্তিশালী এবং প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব যা অস্তিত্বের বিভিন্ন দিককে মুক্ত করে এবং জীবনের জটিলতার মধ্য দিয়ে ভক্তদের পথ দেখায়।
চতুর্মুখী গণেশ
সাধারণত গণেশের একটি মুখ আমরা দেখে থাকি। হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে এই চতুর্মুখী গণেশ। এবং এটি বিরল মূর্তি।
হিন্দু পুরাণে পাওয়া যায় গণেশকে বিভিন্ন রূপে পুজো করার কথা। এর মধ্যে অষ্টবিনায়ক রূপ অধিক প্রচলিত।
গণেশের অন্যান্য রূপের মধ্যে চতুর্মুখ রূপ একটি। চার মুখবিশিষ্ট গণেশ সাধারণত উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এই চারটি দিকের প্রতিনিধিত্ব করেন।
যা ব্রহ্মাণ্ডের চারটি দিকের কথা বলে।
এটি গণেশের বিভিন্ন রূপের প্রতীক। সেগুলো হল জ্ঞান, সমৃদ্ধি, সৃজনশীলতা, সুরক্ষা। চারটি হাত চারটি মাথাবিশিষ্ট হাতে শিলালিপি ধ্যানের পুঁথি, জলের পাত্র এবং পাশা থাকে। কর্নাটকের কালঘিরে মন্দিরে চতুর্মুখ গণেশের বিরল মূর্তি রয়েছে।
পঞ্চমুখী গণেশ
পঞ্চমুখী গণেশ হলেন জীবদেহের পাঁচটি কোষের প্রতীক। বেদে আত্মার উৎপত্তি, বিকাশ, ধ্বংস ও গতিবিধিকে পঞ্চকোষের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই পঞ্চকোষকে আবার জীবের পাঁচ প্রকার দেহ বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম কোষ হল অন্নময় কোষ।
সমগ্র বস্তুজগৎ যেমন পৃথিবী, নক্ষত্র, গ্রহ, নক্ষত্রমণ্ডল ইত্যাদি আসলে অন্নময় কোষ।
দ্বিতীয় কোষ হল প্রাণময় কোষ। দেহের মূলে প্রাণের প্রবেশের ফলে বায়ুর উপাদানটি ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় আর তা থেকে বহু কোষের সৃষ্টি হয়। একেই বলা হয় প্রাণময় কোষ।
তৃতীয় কোষ হল মনোময় কোষ। জীবের মধ্যে মন জাগ্রত হয় আর যার মন যত দ্রুত জাগ্রত হয় তার মনুষ্যত্ব তত বেশি।
চতুর্থ কোষ হল বিজ্ঞানময় কোষ যা আসলে জাগতিক মোহের জ্ঞান। জ্ঞানী লোকের উপলব্ধি তখনই বাড়ে যখন তার বুদ্ধির বিকাশ হয়, এই বুদ্ধির বিকাশ আসলে বিজ্ঞানময় কোষের বিকাশ।
আর পঞ্চম কোষ হল আনন্দময় কোষ।
আনন্দময় কোষের জ্ঞানলাভ করে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া জরুরি।
শাস্ত্র মতে, গণেশের পাঁচটি মুখ সৃষ্টির পাঁচটি রূপ বা কোষের প্রতিনিধিত্ব করে।
আমাদের দেহে পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে। দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ এবং শ্রবণ এবং সৃষ্টিতে পাঁচটি উপাদান রয়েছে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ। পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং সৃষ্টির পঞ্চ উপাদান নিয়েই এই গণপতির পঞ্চমুখী রূপ। পাঁচটির মধ্যে যেকোনও বাধা দূর করতে সক্ষম দেবত্বের যে রূপ তাকে পঞ্চমুখী গণপতি বলা হয়। দক্ষিণ ভারতে পঞ্চমুখী গণেশ খুবই জনপ্রিয়।
পঞ্চমুখী গণেশ হেরম্ব গণেশ নামে পরিচিত। নেপালে এই হেরম্ব গণেশের পুজো হয়। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর জেলায় বিশ্বের একমাত্র নিজস্ব শৈলীর পঞ্চমুখী গণেশ মন্দির রয়েছে। স্বয়ম্ভু পঞ্চমুখী গণেশের মন্দির রয়েছে শ্রীঅর্কেশ্বর মন্দিরে। এখানে গণেশের মূর্তিটি শতাব্দীপ্রাচীন।
মহাগণপতি, মনোময়, হেরম্ব, গজকর্ণ, ধূম্রবর্ণ, বিঘ্ননাশকারী গণপতিকে অক্ষর ও জ্ঞানের দেবতা রূপে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর পুজো প্রচলিত।