‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’। মধ্য কলকাতার বো ব্যারাকস-এ গেলেই মনে পড়ে যায় কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি। বৌবাজার থানার ঠিক পিছনে। চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দুই মিনিট। বো ব্যারাকস। লাল ইটের দেওয়ালের কয়েকটি বাড়ি। পাড়াটি একেবারেই অন্যরকম। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। সকলের মধ্যে থেকেও কেমন যেন আলাদা। ছোট্ট এই পাড়ায় থাকেন প্রায় ১৪০ ঘর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মনে করা হয়, এটাই কলকাতার শেষ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া। সম্ভবত এঁরাই ভারতের একমাত্র জনগোষ্ঠী, যাঁদের মাতৃভাষা ইংরেজি।
কলকাতার ব্রিটিশ এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর বসবাসের জন্য তৈরি হয়েছিল শতাব্দী-প্রাচীন বাড়ি বা ব্যারাক। ভারত ছেড়ে কবেই চলে গেছে ব্রিটিশ। চলে গেছে মার্কিন সেনারাও। তবে থেকে গেছে লাল ইটের শক্তপোক্ত বাড়িগুলো। প্রতিটি ইটে লেগে আছে ইতিহাসের চিহ্ন। এই চিহ্নগুলোকে বুকে আগলে রেখেছেন মহানগরীর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। তাঁরা ব্যর্থ করেছেন ইতিহাস ধ্বংসের অপচেষ্টাও।
কলকাতার ক্রিসমাস বা বড়দিন উৎসব বো ব্যারাকস ছাড়া ভাবাই যায় না। শীত পড়লেই ধীরে ধীরে সেজে ওঠে এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া। গলিতে জ্বলে ওঠে নানা রঙের টুনি আলো। সেই আলোয় ঔজ্জ্বল্য আছে। নেই উগ্রতা। নেই আতিশয্য। নেই নিজেকে জাহির করার চেষ্টা। এই আলো বড় বেশি আন্তরিক, মায়াবী। তাকালেই চোখের আরাম।
আরও পড়ুন-আধুনিকতা, নারী স্বাধীনতা ও প্রগতির নিখুঁত বন্ধন মা সারদা
উৎসব শুরু হয় ২৩ ডিসেম্বর। চলে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৯ দিনের উৎসব শেষ হয় বর্ষবরণের মধ্যে দিয়ে। যেন শহরে নতুন বছর আসে বো ব্যারাকস-এর হাত ধরেই। ছোট-বড় প্রত্যেকেই মেতে ওঠেন। বড়দিনের উৎসব। তাই উপহারের ঝোলা নিয়ে হাজির হয় সান্টাক্লজ। জমে ওঠে অনুষ্ঠান। চলে হইচই আনন্দ ফূর্তি। কোনও কোনও বছর আসেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্তের মতো চলচ্চিত্র তারকারা। তাঁরাও মেতে ওঠেন উৎসবে। সঙ্গে নাচাগানা, খানাপিনা। কেক, চকোলেট, পানীয় ইত্যাদি। পরিচালক অঞ্জন দত্ত এই পাড়া নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’ সিনেমাটি। অভিনয় করেছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন সেন, সব্যসাচী চক্রবর্তী প্রমুখ।
এই বড়দিন উৎসবকে সফল করতে তৎপর মূলত বো ব্যারাকস-এর মহিলারা। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তাঁরা ভুলে যান নাওয়া-খাওয়া। তুমুল ব্যস্ততা। সবকিছু ভালভাবে মিটে গেলে তবেই স্বস্তি। তাঁদের পাশে থাকেন পুরুষরাও। সুখে-দুঃখে এই পাড়ার মানুষদের পাশে আছেন আরও একজন। তিনি তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ দাবি করেছিলেন, ভারতে মাত্র ২৯৬ জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বর্তমানে বেঁচে রয়েছেন। তাঁর এই পরিসংখ্যানের সত্যতা অস্বীকার করে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ। বিজেপি সরকারের মন্ত্রীর দাবির বিরুদ্ধে দীর্ঘ বিবৃতি জারি করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। বলেছিলেন, ‘এটা ঠিক, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু অতটাও নয়, যতটা রবিশঙ্কর প্রসাদ দাবি করছেন।’ কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় ডেরেক ও’ব্রায়েনের বক্তব্যকে সমর্থন করেছিল।
গতবছর করোনার কারণে খুব বেশি আড়ম্বর হয়নি। যে যার নিজের ঘরেই ক্রিসমাস পালন করেছিলেন বো ব্যারাকস-এর বাসিন্দারা। আরাধনা করেছিলেন প্রভু যিশুর। তবে এইবছর ফিরে এসেছে উৎসবের আগের পরিচিত চেহারা। জ্বলে উঠেছে নানা রঙের আলো। সবকিছু হচ্ছে করোনাবিধি মেনেই। বো ব্যারাকস-এর বড়দিন উৎসব দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন বাইরের মানুষজন। পটাপট তুলছেন ছবি। যাঁরা যাননি, টুক করে দেখে আসতে পারেন বো ব্যারাকস-এর ক্রিসমাস সেলিব্রেশন। আলোকমালায় অতিথিদের স্বাগত জানাতে তৈরি মহানগরের এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া। চোখ মেললেই বুঝতে পারবেন, সত্যিই ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’। যেখানে লাল ইটের দেওয়ালে লেগে আছে মায়া। যেখান গেলে দেখা যায় এক অন্যরকম যাপন। যে যাপন আজ অঙ্গ হয়ে গেছে অন্য এক বঙ্গজীবনের!