মনোবিকার
জীবন এক রহস্যময় নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রতিটি মুখই যেন এক-একটি অপঠিত চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা থাকে মানুষের মনের কথা— আনন্দ, রাগ, কষ্ট, বা ভয়। মুখাবয়বের সূক্ষ্ম ভঙ্গিমায় ফুটে ওঠে আমাদের আবেগ, অনুভব আর সম্পর্কের ছায়া। বলা ভাল ব্যবহারিক জীবনে আমাদের সমাজবোধ, সম্পর্কের পরিসর আর আবেগ প্রকাশের অন্যতম প্রধান হাতিয়ারই হল মুখাবয়ব। চোখের চাহনি, কপালের ভাঁজ, ঠোঁটের হালকা কাঁপন— সবই আবেগ প্রকাশের ভাষা। কিন্তু কিছু মানুষের কাছে এই ভাষা দুর্বোধ্য। তারা অন্যের মুখাবয়বে আবেগ খুঁজে পায় না, অথবা ঠিকমতো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না। এমন ব্যক্তিত্ববিকার— যেমন সাইকোপ্যাথি, একপ্রকার মনের অসুখ যা মুখের উপর ফুটে ওঠে, সময়ের চক্রান্তে একটি সমাজবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের জন্ম দেয়!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
সাম্প্রতিক গবেষণা
সম্প্রতি ৩০ জুলাই, এবছর প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে সাইকোপ্যাথির বিভিন্ন মাত্রায় মুখাবয়বভিত্তিক আবেগ শনাক্তকরণের মনঃদৈহিক প্রক্রিয়া এবং অক্সিটোসিনের ভূমিকার মতো জটিল বিষয়ের উপর নতুন আলো ফেলেছে। গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন পর্তুগালের লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সারা ফেরেইরা নাসিমেন্টো, যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের ড. ডায়ানা প্রাটা, এবং পর্তুগালের ক্যাপ্রিকর্নে অবস্থিত এগা মনি স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড সায়েন্সের ড. ফিলিপা ফ্রেইরি। বিগত ২০০৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত ৬৬টি গবেষণা নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে, গবেষকগণ সাইকোপ্যাথির নানা মূল মাত্রা এবং মুখের উপর ফুটে ওঠা আবেগ চিনতে অক্সিটোসিনের কার্য-প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর ফলে আমাদের সামনে উঠে এসেছে এক সম্ভাব্য চিকিৎসা-উপাদান, অক্সিটোসিন, যা এই সমাজবিচ্যুত মনের মাঝে সেতুবন্ধন গড়তে পারে।
সাইকোপ্যাথির চরিত্র
সাইকোপ্যাথি হল একধরনের ব্যক্তিত্বগত সমস্যা, এক ধরনের মনোবিকার বা মনের অসুখ, যার ধারণা ১৮০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফুটে উঠেছে। এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়— যেমন মিষ্টি ও ছলনাময় ব্যবহার, অন্যকে ঠকানোর প্রবণতা, অপরাধবোধ বা অনুশোচনার অভাব, এবং সহানুভূতি না থাকা। তারা প্রায়ই নিয়ম মানতে চায় না, অবাস্তব স্বপ্ন দেখে, ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুমি বা খারাপ কাজ করে, এবং নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের মানুষদের সামাজিক জীবনে মিশে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
এখন ব্যবহারিক সমাজ টিকে থাকে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার উপর, যা ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে পেশাগত, আইনি ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র পর্যন্ত সব স্তরের মেরুদণ্ড স্বরূপ। এই মানবিক গুণগুলোকে সম্ভব করে তোলে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্নায়ুবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যা মানুষকে সহানুভূতিশীল ও সামাজিক আচরণে উৎসাহিত করে। কিন্তু সাইকোপ্যাথি প্রবণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ার উল্টো ঘটে, ফলে তাদের নৈতিক বোধ ভেঙে পড়ে। এর ফলে ক্ষুদ্র অপরাধ থেকে শুরু করে কর্পোরেট দুর্নীতি বা গণহত্যার মতো চরম অবক্ষয় দেখা দিতে পারে— যা সমগ্র সমাজের নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীদের মতে, সাইকোপ্যাথির দুটি দিক আছে— একটি আবেগ ও সম্পর্কভিত্তিক, আরেকটি জীবনধারা ও আচরণভিত্তিক। গবেষণায় উঠে এসেছে এই দুই দিকের সঙ্গে মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট কার্যকলাপ ও বিশেষভাবে অক্সিটোসিন নামক হরমোনের সম্পর্ক রয়েছে, যা মানুষকে অন্যের আবেগ বোঝার ও সামাজিকভাবে সংযুক্ত থাকার ক্ষমতা দেয়।
অক্সিটোসিন: সম্পর্কের রাসায়নিক সেতু
অক্সিটোসিন— একটি সামাজিক হরমোন বা নিউরোপেপটাইড— যা জীববিজ্ঞানের খাতায় প্রেম, বন্ধন এবং সহানুভূতির জৈবিক ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। একে প্রায়শই ‘বন্ডিং হরমোন’ বলা হয়। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, ইন্ট্রান্যাজাল অক্সিটোসিন সেবনে যে কোনও মানুষের আবেগীয় মুখাবয়বের প্রতি মনোযোগ বাড়ে, বিশেষ করে কোনও মানুষের চোখের দিকে তাকানো বৃদ্ধি পায়। অ্যামাইগডালার কার্যকলাপও এই হরমোনের প্রভাবে ‘স্বাভাবিক’ মাত্রায় ফিরে আসে— একটি অতিসংবেদনশীল মস্তিষ্ক যেন খানিকটা শান্ত হয়, আর নিস্পৃহ মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিটোসিন আবেগীয় চোখে দৃষ্টি স্থির করে, সহানুভূতির মাত্রা বাড়ায়, এমনকী আবেগীয় তথ্য সংবেদনে প্রভাব ফেলে মানব মস্তিষ্কের অ্যামাইগডালা, এন্টেরিয়র সিঙ্গুলেট্ কর্টেক্স অঞ্চলের কার্যকলাপ অনেক অংশ বাড়িয়ে তোলে এবং পুনর্বিন্যাস করতে পারে।
আরও পড়ুন-মোদি-স্মৃতির ডিগ্রি লুকনো হচ্ছে কেন, প্রশ্ন তৃণমূলের
যেখানে গবেষণা থেমে আছে: কিন্তু ইঙ্গিত স্পষ্ট যদিও এখনও পর্যন্ত সরাসরি কোনএ গবেষণায় সাইকোপ্যাথির মাত্রা ও অক্সিটোসিন থেরাপির যৌথ বিশ্লেষণ হয়নি, তবুও দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে লক্ষ করা গেছে, বিজ্ঞানীদের এমনটাই দাবি। একদিকে সাইকোপ্যাথির কারণে মুখমণ্ডলের আবেগ শনাক্তকরণে অসুবিধা, অন্যদিকে অক্সিটোসিনের প্রমাণিত ক্ষমতা; একদিকে আবেগীয় চেহারার প্রতি মনোযোগ বাড়ানো ও অন্যদিকে অ্যামাইগডালার কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ— এই দুই জটিলতার মধ্যেই বিজ্ঞানীদের নিরন্তর পরিশ্রম। আশার আলো এখানেই ফুটেছে— এই সম্ভাব্য সমান্তরাল পথেই গবেষকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, অক্সিটোসিন হতে পারে একটি মাত্রা-ভিত্তিক থেরাপিউটিক উপায়, বিশেষ করে সাইকোপ্যাথির জীবনধারা ও আচরণভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে— যেখানে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা ও আগ্রাসন রয়েছে।
মনোবিকারের মুখোমুখি বিজ্ঞান
এই পর্যালোচনাটি বৈজ্ঞানিকদের জন্য এক সুস্পষ্ট আহ্বান: মানুষের মুখের উপর ভেসে ওঠা আবেগগুলোকে চিনে নিতে মনোবিকারের ধরন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হোক। একই সঙ্গে অক্সিটোসিনের ভূমিকা সংক্রান্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হোক যেখানে সাইকোপ্যাথের সবগুলো মাত্রাই আলাদাভাবে বিবেচিত হবে। বৈজ্ঞানিক মহলের এমন ধারণা হয়তো আগামী দিনে নতুন গবেষণার দরজা খুলে দিচ্ছে। হয়তো উত্তর খোঁজার চেষ্টা হবে, অক্সিটোসিনের প্রভাবে কীভাবে চোখের দিকে তাকানোর ধরনে পরিবর্তন আসে? সাইকোপ্যাথের দেহমনে কি ধরনের নিউরোইলেকট্রিক পরিবর্তন দেখা যায়? অ্যামাইগডালায় ঘটে যাওয়া নিউরোইমেজিং কী বলে? আমরা সবাই এইসব পরীক্ষালব্ধ উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
সংযোগের রাসায়নিক পুনর্নির্মাণ
মুখাবয়ব এক সামাজিক আয়না— যেখানে প্রতিফলিত হয় মনের গভীরতম অনুভব। কিন্তু সাইকোপ্যাথিক চেতনায় সেই আয়না ফিকে। একদিকে আবেগহীনতা, অন্যদিকে অতিসংবেদনশীল উগ্রতা। এই দুটি চরম প্রান্তে দাঁড়িয়ে যদি কোনও রাসায়নিক হাত বাড়াতে পারে, তবে সে হতে পারে অক্সিটোসিন। সে হাত হয়তো সমাজকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারবে না, কিন্তু একটি দৃষ্টিপথ খুলে দিতে পারে— যেখানে মানুষ আবার মানুষের চোখে চোখ রাখবে। আর বিজ্ঞান সেই সেতুর কাঠামো নির্মাণে নীরব অথচ নিরলস কারিগর।