হিসাব চাইলে হিসাব নাও, মিথ্যে কথা ছড়িও না

চিল-শকুনেরা ফের উড়ছে পুজোর আকাশে বিপর্যয় আনবে বলে। এবারও ডানা-ঝাপটানো সার। মমতামাখা স্পর্শে দুর্গাপুজোর আয়োজনে কোনও বিঘ্ন হতে দিচ্ছি না। লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

আকাশে চিল-শকুনের অভাব নেই, রাজ্যে ভাল কাজে বাগড়া দেওয়ার লোকের।
জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পুজো কমিটিগুলোকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার ঘোষণা যেদিন করেছিলেন, সেদিনই বাম-বিজেপি আদালতে যাওয়ার একটা ছুতো আবিষ্কার করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা পড়েছি ‘জুতো আবিষ্কার’-এর কথা, আর এ রাজ্যে আমরা দেখেছি এবং দেখছি ছুতো আবিষ্কারের উদ্ভাবনী পন্থা।
প্রথম যেবার মুখ্যমন্ত্রী পুজো কমিটিগুলোকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন, সেবার চিল-শকুনেরা (পড়ুন রামরেড আইনজীবীরা) ছুটেছিলেন সেই অনুদান বন্ধ করার জন্য।
এবারেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

আরও পড়ুন-সাইকোপ্যাথি ও অক্সিটোসিন

সেটা ছিল ২০১৮। পুজো পিছু অনুদান ধার্য হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। তাতেই ‘গেল গেল’ রব। নির্বাচিত সরকার নাকি ধর্মীয় পুজোয় এরকম অনুদান দিতে পারে না। পুজো আটকাতে তাই ঠুকে দেওয়া হল মামলা। আইনের আশ্রয়ে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবের পথটিকে কণ্টকিত করার সুচতুর আয়োজন।
ওরা পারেনি। বিকাশ উকিল সেবারে পারেননি, এবারেও পারলেন না।
এই অনুদান যে দুর্গা পুজোর মহোৎসবকে আরও জাঁকজমক পূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নয়, পুজো অর্থনীতিকে অম্লজান জোগানোর দিশায় সুচিন্তিত পদক্ষেপ, এটা সেদিন লাল পার্টির মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু তাই বলে, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পার্টির তরফে ‘মার্কসীয় সাহিত্য’ বিক্রির স্টল দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও নিরুৎসাহিতা দেখা যায়নি।
এই অনুদানের গুরুত্ব পুরো মাত্রায় বোঝা গিয়েছিল কোভিড কালে। সেসময় বহু পুজো অর্থাভাবে বন্ধ হতে বসেছিল। ওই অনুদান সেই পুজোগুলোকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
কী আসত-যেত পুজো বন্ধ হলে?
বাংলার উৎসবপ্রাণতা একটা বিরাট ধাক্কা খেত। সেই সঙ্গে বিপর্যস্ত হত বাংলার অর্থনীতি। যে অর্থনীতি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকেন্দ্রিক। যে অর্থনীতিতে বাঁচে মরে বাংলার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। যে অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখে মৃৎ শিল্পীর শৈল্পিক প্রচেষ্টাকে, আলোক শিল্পীর কুটিরের আলোটুকু, তাঁদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তাগিদ, ঢাকিদের পরিবারগুলোতে জীবনের বোল। অর্থনীতিতে একটা চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্ব আছে। সেই তত্ত্ব মেনেই পুজো কমিটিকে দেওয়া টাকা তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় না। ছড়িয়ে পড়ে সমাজের এই স্তরগুলোতেও। কোভিডে এঁরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এবং কেউ তাঁদের চোখের জলের হিসাব নিতে আগ্রহ দেখাননি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন। তাঁর মমতা স্পর্শে উজ্জীবিত গিয়েছিল বাংলার উৎসবপ্রাণতা এবং নিচুতলার অর্থনীতি।
এর গুরুত্ব এখন টের পাচ্ছেন বলেই সেদিন যাঁরা মামলা ঠুকতে আগ্রহী ছিলেন, আজ তাঁদেরই একাংশ ব্যস্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুজো অনুদানের প্যাকেজ টুকতে । মহারাষ্ট্রে ডবল ইঞ্জিন সরকার। তারা এবার গণেশ পুজোয় অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। যারা একদিন রুখতে তৎপর ছিল, তারাই এখন, কী আশ্চর্য! টুকতে আগ্রহী। বিকাশ উকিল আর তাঁর শাকরেদ এতসব বুঝেও বোঝেন না। তাই এবছরের মতো ২০২২-এও এই বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়।
সেবার দুটি ইস্যু আদালতে তুলে ধরেন ওঁরা। এক, এরকম আর্থিক অনুদান বিলানোর কোনও আইনি বৈধতা নেই। এবং দুই, কোর্টের গাইড লাইন না মেনেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কাজটি করছে।
সেবারও ধোপে টেকেনি ওসব কথা।
সেবার প্রায় ৪০ হাজার পুজো কমিটিকে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কোভিডের কারণে সেবার পুজো কমিটিগুলো যথেষ্ট বিজ্ঞাপন বা চাহিদা অনুযায়ী স্পনসর পায়নি। রাজ্য সরকারের অনুদানই তাদের ত্রাতা হয়ে দাঁড়ায়। সেবার অনুদানের ৭৫ শতাংশ কমিটিগুলোকে ব্যয় করতে বলা হয় কোভিডের টিকাকরণের কাজে আর বাকি অংশ ব্যয়িত হয় পুলিশের সঙ্গে জনগণের মেলবন্ধন রচনার কাজে।
সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার দুর্গাপুজোগুলিকে পৃষ্ঠপোষকতার যে পথ দেখিয়েছিলেন, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বোধোদয়, বেঁধে দেওয়া হল নির্বীজকরণের লক্ষ্যমাত্রা

এবারেও প্রতিশ্রুতি রেখেছেন বাংলার ‘দিদি’। সরকারের তরফে এবার শারদোৎসবের অনুদানের পরিমাণ পেরিয়ে গেছে লাখ টাকা। পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, এবছর সমস্ত পুজো কমিটিকে সরকারের তরফে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আগের বছরের তুলনায় ২৫ হাজার টাকা বাড়ানো হল এই অঙ্ক। তাঁর এই ঘোষণায় স্বভাবতই খুশি পুজো উদ্যোক্তারা। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ খরচ ৮০ শতাংশ কমবে। ফায়ার লাইসেন্স ও যাবতীয় সরকারি ফি মকুব করা হয়েছে। ২০২৪ সালে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, এরপর সরকারি অনুদানের পরিমাণ লাখ টাকা করে দেবেন। সেইমতো উদ্যোক্তারাও আশায় ছিলেন। সেই আশা পূরণে কার্পণ্য করেননি জননেত্রী।
আর এবারও পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো, রামরেড আইনজীবীরা নেমে পড়েছিলেন অনুদান আটকাতে।
তাঁদের তৎপরতা বেদনার্দ্র করেছিল জননেত্রীকে। তিনি সখেদে বলেছেন, ‘আমি যে পুজোয় টাকা দিই, তা নিয়েও ওদের (বিরোধী) আপত্তি। এটা নিয়ে মামলা করেছিল। আরে পুজোয় আমরা সবাই আনন্দ করি। একটু টাকা দিলে যদি ওদের পুজোটা আরেকটু ভাল হয়, তাহলে ক্ষতিটা কী? একদিকে বলবে, আমি নাকি বাংলায় দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো করতে দিই না। আবার আমি পুজোয় অনুদান দিলেও আপত্তি করবে।’
এই অনুযোগের কারণ, ২০১৯-এর দুর্গাপুজো কমিটিগুলোকে ২৫,০০০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা করে রাজ্য। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সেই অনুদানের পরিমাণ বেড়ে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২০২০ সালে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয় হাইকোর্টে। এবার অনুদান বেড়ে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। এবারও মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মামলা দায়ের করেন দুর্গাপুরের বাসিন্দা জনৈক সৌরভ দত্ত। গত কয়েক বছর সেই পুরনো মামলাতেই নতুন আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। যদিও সে মামলা আদালতে ধোপে টেকেনি।
তবে পুরোনো ছেঁদো যুক্তির পাশাপাশি এবার ফের বাম বিজেপি জনমানসে একটা ধারণা গড়ে তুলতে প্রয়াসী।
এই অনুদানের অর্থে জনগণের কোনও উপকার হয়না, আর এই টাকার বেহিসাবি খরচ আপত্তিকর। উপযুক্ত জায়গায় খরচ না করে জনগণের টাকা পুজো কমিটিগুলিকে বিলিয়ে দিচ্ছে সরকার।
যাঁরা হিসাব নিতে চাইছেন এবং না জেনেশুনে অযথা বিভ্রান্তি তৈরিতে নেমেছেন, তাঁদের বলি, কান পরিষ্কার করে সত্যিটুকু শুনে নিন, জানা না থাকলে জেনে নিন।
অনুদানের টাকা জনগণের স্বার্থেই ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হচ্ছে। ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পুলিশ ওই টাকা খরচ করছে। এ ছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে বেশ কিছু বিধিনিষেধের জন্য খরচ করা হয়েছিল। আর যারা হিসাব নিকাশের কথা তুলছেন, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, অধিকাংশ পুজো কমিটি পুজো শেষে আয় ব্যয় সংক্রান্ত খতিয়ান তৈরি করে। নিজেদের পুজো সুভ্যানিরের পাশাপাশি সরকারকেও তারা সেটা নিয়ম করে জানায়। বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে আদালতে রাজ্যের সওয়ালে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে মার্চ মাসে আদালতকে জানানো হয়েছিল, ৫০০টির বেশি পুজো কমিটিকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি বাদে বাকি সব পুজো কমিটি ওই শংসাপত্র জমা দিয়েছে।
এই প্রেক্ষিতে আদালতের অনুদান বন্ধের নির্দেশ দানের প্রশ্নই নেই। আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে হিসাব সংক্রান্ত প্রশ্নটা তুলেছেন মাত্র। তদতিরিক্ত কিছু নয়। কিন্তু চিল শকুনদের হতাশ আত্মাগুলো কী করবে?
সুতরাং তারা নেমে পড়েছে অপপ্রচারের আড়াল আঁকড়ে।

Latest article