বেড়ে চলেছে হার্টের অসুখ

কোভিড-১৯-এর কবল থেকে মুক্তি পেলেও বিপদ আজও কমেনি। গবেষণা অনুযায়ী কোভিড-পরবর্তীতে যতদিন গড়াচ্ছে ক্রমশ বাড়ছে স্ট্রোক এবং হার্টের অ্যাটাকের ঝুঁকি বিশেষত মহিলাদের। এর কারণ কী? এই ঝুঁকি কমাতে কী করবেন লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বাড়া স্বাভাবিক নিয়ম। শরীরের বয়স যেমন বাড়ে ঠিক তেমনই শরীরের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বয়স বাড়ে কিন্তু যদি সময়ের আগেই বয়স অনেকটা বেড়ে যায় তাহলে? একটা সময় কোভিড ১৯-এর মতো জটিল এক অতিমারির কবলে পড়েছিল গোটা পৃথিবী আজ সেই অভিশাপ-মুক্ত হয়েও সম্পূর্ণ বিপদ-মুক্ত হইনি আমরা। কারণ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে কোভিড-পরবর্তীতে যাঁরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাঁদের বেশিরভাগের ভাস্কুলার এজিং এক ধাক্কায় প্রায় ৫ বছর বেড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। ভাস্কুলার এজিং হল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালির গঠন ও কার্যকারিতার পরিবর্তন। যেমন রক্তবাহিকা নালি শক্ত হওয়া, এন্ডোথেলিয়ামের কার্যকারিতা হ্রাস ইত্যাদি অর্থাৎ খাতায়-কলমে কোনও ব্যক্তির যা বয়স তা থেকে তাঁর রক্তবাহিকা নালির বয়স পাঁচ বছর বেশি হতে দেখা যাচ্ছে কোভিড সারভাইভারদের মধ্যে। যার মধ্যে মহিলারাই সংখ্যায় অনেক বেশি। ফ্রান্সের একদল গবেষক তাঁদের গবেষণায় দেখেছেন যেসব মহিলা একটা সময় কোভিড-আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের রক্তবাহিকা নালির বয়স যাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হননি তাঁদের রক্তবাহিকা নালির বয়সের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রক্তবাহিকা নালি শক্ত হতে থাকা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু কোভিড হলে এর পরবর্তীতে এই রক্তবাহিকা নালি আরও দ্রুত শক্ত হতে শুরু করে অর্থাৎ রক্তনালির বয়স দ্রুত বাড়তে থাকে। এর ফলে স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায় একলাফে অনেকটা।
গবেষকরা ‘ক্যারোটিড-ফেমোরাল পালস ওয়েভ ভেলোসিটি’ বা (PWV) ব্যবহার করে রক্তনালি বয়স পরিমাপ করেছেন। PWV-তে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ০.৫ মিটার বৃদ্ধি ক্লিনিক্যালি তাৎপর্যপূর্ণ। এই পরিবর্তনটি মোটামুটিভাবে পাঁচ বছরের বার্ধক্যকে বোঝায়। কিন্তু মহিলাদের কেন বেশি? গবেষণা বলছে মহিলারাই বেশি এই রক্তবাহিকা নালি বা ব্লাড ভেসেলস স্টিফনেসে ভুগছেন। কারণ মহিলাদের দ্রুত এবং শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধ শক্তি যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে।
এ তো গেল গবেষণার কথা। কিন্তু কোভিড-পরবর্তীতে হৃদরোগের ঘটনা যে বেড়েছে এটা সকলেই মানবেন। খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেল সর্বত্র হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর, ছবি, ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। গবেষণা অনুযায়ী কোভিড-১৯ সংক্রমণ হবার পর হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা যাঁর কোভিড হয়নি তাঁর চেয়ে চারগুণ বেশি বেড়ে যায়। কারণ কোভিড ১৯ এন্ডোথেলিয়াম অর্থাৎ রক্তনালির ভিতরের আস্তরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, রক্তনালি লিক হতে পারে, রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে।
বেড়েছে হার্টের অসুখ
পরিসংখ্যান বলছে কোভিডের পরবর্তী বছরগুলোয় বেড়েছে হার্টের রোগের সম্ভাবনা। যে হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, হৃদরোগ একটা সময় বয়স্কদের অসুখ বলেই বিবেচিত হত সেই অসুখটাই এখন তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে এটা শ্বাসযন্ত্রের অসুখ হলেও হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলছে মারাত্মক যার প্রভাব এই ২০২৫-এও বিদ্যমান। এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে কোভিডের পরবর্তী প্রভাব হিসেবে মায়োকার্ডিয়াল ইনফেকশন, হার্ট ফেলিওর, অ্যারিথমিয়া, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এমনকী যাঁদের আগে কোনও রকম হৃদরোগের সম্ভাবনাই ছিল না তাঁদের ক্ষেত্রেও।

আরও পড়ুন-অনুপ্রবেশের জন্য শাহর মুন্ডু কাটা উচিত প্রধানমন্ত্রীর : মহুয়া

কেন এই রিস্ক থেকেই যাচ্ছে
যাঁদের একবার বা একাধিকবার কোভিড হয়েছে তাঁদের দেখা গেছে হার্টে অক্সিজেন এবং রক্ত সরবরাহ কম হচ্ছে।
অসুখ-পরবর্তী শারীরিক পরিবর্তন এবং জটিলতা।
মানসিক চাপ অনেকটা বেড়ে যাওয়া।
মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম বা এমআইএস। এটি একটি অটো ইমিউন ডিজিজ যা কোভিড ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পরে দেখা যায়।
কোভিড পজিটিভ হবার পর সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও অনেকের শরীরেই ট্রপোনিন-এর মাত্রা বেড়ে গেছে।
আগে থেকেই কোমর্বিডিটি রয়েছে অর্থাৎ শুগার প্রেশার, ডায়াবেটিস, সেই সঙ্গে শ্বাসযন্ত্র ও হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যা যাঁদের ছিল তাঁদের চাপ অনেক বেশি।
উপসর্গ বুঝুন ব্যবস্থা নিন
দ্রুত হৃদস্পন্দন বা বুক ধড়ফড়ানি শুরু হওয়া।
অনিয়মিত হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন এবং হার্টের রিদমও অনিয়মিত থাকা।
বাঁ দিকের হাত, ঘাড়, চোয়াল এবং পিঠে ব্যথা এবং অস্বস্তি।
মাথা ঘোরা-ঘোরা ভাব বিশেষ করে বসে থাকার পর যখন উঠে দাঁড়াচ্ছেন।
বুকে চাপ, অস্বস্তি বা বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, প্রচুর ঘাম।
হাত-পায়ের অসাড়তা।
নীলাভ এবং নীলচে বর্ণের শুকনো ঠোঁট।
গোড়ালি ফোলা বা পা হঠাৎ ফোলা।
হঠাৎ দুর্বলতা বা ক্লান্তি।
বমি-বমি ভাব এবং বমি।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
কথায় বলে প্রিভেনশন বেটার দ্যান কিওর। তাই প্রাথমিক ভাবে খুব সতর্ক এবং উন্নত জীবনযাপন জরুরি। বিশেষ করে মহিলাদের, কারণ তাঁরা নিজেদের নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নন।
হেলদি বিএমআই রেট মেন্টেন করা জরুরি। তাই প্রত্যেকদিন ন্যূনতম ব্যায়াম জরুরি। ব্রিদিং এক্সারসাইজ বা শ্বাসবায়ুর ব্যায়াম খুব জরুরি। নিয়মিত।
জল খেতে হবে অনেকটা অন্তত পক্ষে দিনে তিন লিটার।
স্পাইসি এবং তৈলাক্ত খাবার একেবারেই বাদ দিলে ভাল। সেই সঙ্গে ধূমপান এবং মদ্যপান বাদ দিতে হবে।
ঘুম হতে হবে পর্যাপ্ত সেই সঙ্গে খাবারের সময়সীমা ঠিক রাখতে হবে। বিশ্রামের প্রয়োজন ততটাই জরুরি যতটা সারাদিনের কাজ জরুরি।

Latest article